ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে ফিরেও ভাল নেই মাঘ-নিশীথের মগ্ন কোকিল

দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ২২ অক্টোবর ২০১৮

দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস

মোরসালিন মিজান ॥ কবি ফিরেছেন। আরও রিক্ত নিঃস্ব একাকী হয়ে কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন কবি মহাদেব সাহা। প্রবাস জীবনে ইতি। ঢাকায় যে বাসাটি ছিল, নেই আর। ‘সেই বৃষ্টিভেজা পথ হারানো বালক’ তবু ফিরেছে। আপন পরিবেশে সুর তুলেছে ‘মাঘ-নিশীথের মগ্ন কোকিল।’ শরীরের পুরনো অসুখ সারেনি। উপরন্তু নতুন জুটেছে। সবই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। কী খাবেন? জানেন না। ভাঙাচোরা শরীর। চিকিৎসা নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা। এর পরও নিজের মাটিতে ফিরতে পেরে খুশি। অপার আনন্দ। তবে দেখা করছেন না কারও সঙ্গে। ফোন করলে বলছেন, ‘দেখা দেব, সে অবস্থায় আমি নেই।’ তার মানে, দেশে ফেরার আনন্দ উপভোগ করলেও নতুন করে টিকে থাকার সংগ্রাম করতে হচ্ছে কবিকে। স্বীকার করুন, না করুন, পুনরায় সঙ্গী হয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রবাস জীবন কবিকে কিছুই দেয়নি, দেশে ফেরার মানসিক শক্তি আর সাহসটুকু ঠিক দিয়েছে। তা-ই নিয়ে চলে এসেছেন তিনি। এখন দেশ কী করবে কবির জন্য? জরুরী প্রশ্ন। মহাদেব সাহা ষাটের দশকের অগ্রগণ্য কবি। বাংলা কবিতায় তার দান অনস্বীকার্য। দীর্ঘ লেখালেখি জীবন। বহু অমর কবিতার জন্ম দিয়েছেন। তার বিশুদ্ধ আবেগ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি। দেশের প্রতি গভীর প্রেম। বঙ্গবন্ধুর জন্য কান্না। সবই ধারণ করেছে তার কবিতা। হয়ে উঠেছে মহৎ শিল্প। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর শোকে মুহ্যমান এ কবিই তো সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটি তুলেছিলেন। লিখেছিলেন- প্রিয় শেখ মুজিব/তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি/তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,/দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না/বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের/গুলিতে উড়ে গেল কেন...। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি। নতুন করে কাঁদিয়েছে শুধু। মহাদেব সাহার কবিতা মানুষ আর মানবিক পৃথিবীর কথা বলে। হৃদয়ে ভালবাসার বোধ জাগাতে বিখ্যাত পঙ্ক্তির জন্ম দেন তিনি। লিখেন- করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও/আঙুলের মিহিন সেলাই...। তার কবিতার আবৃত্তি শোনে করতালীতে ফেটে পড়েন মিলনায়তন ভর্তি স্রোতা। অথচ দৃশ্যমান এ ছবির বিপরীতে কাল কী হবে জানেন না এমন একজন কবি, কপালের ভাঁজ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন! দাঁড়িয়ে আছেন। আশ্রয়হীন প্রবীণ নিয়তির কাছে, মন চায় না, তবুও পরাভব মানতে চলেছেন। মহাদেব সাহার নিয়তি আসলে বার্ধক্য। ৭৫ পেরিয়েছে বয়স। কবিতা লিখলেও, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। অবসরে যাওয়ার পর থেকেই খারাপ সময়ের শুরু। জানা যায়, দুই ছেলের একজন কোন উপার্জনে নেই। অন্যজন কানাডায় স্থায়ী। প্রবাসী পুত্র পার্থ সাহা সেখান থেকেই বাবা মাকে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু সন্তানেরও স্ত্রী সন্তান আছে। খরচ কমানো গেলে সুবিধা হয়। তাছাড়া মহাদেব সাহা নানা রোগে ভুগছিলেন। উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন ছিল। সব দিক বিবেচনা করে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট পিতা মাতাকে কানাডায় নিজের কাছে নিয়ে যান পার্থ। কবি লিখেছিলেন, ‘বিচ্ছেদ ব’লো না,/একসাথে/লক্ষ লক্ষ বজ্রপাত হবে।’ বজ্রপাতই হয়েছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বদেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল মহাদেব সাহার। কঠিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে কানাডার ক্যালিগরিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। সুদূরের দেশে বাঙালী কবির জন্য, না, কিছুই অপেক্ষা করে ছিল না। নির্মম এ সত্য কবিই সবচেয়ে ভাল জানতেন। তাই চশমার ফাঁকে আঙুল দিয়ে চোখ মুছেছেন। স্বদেশের সঙ্গে বিচ্ছেদ বিচ্ছিন্নতা ঠেকাতে পারেননি। বিদেশে পাড়ি জমানোর ঠিক আগের দিন জনকণ্ঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মাঠে নেই। মাঠ ছেড়ে দিয়েছি। রেসে নেই। প্রতিযোগিতায় নেই। ভাগ্য মেনে নিয়েছি আমি। এখন আমি প্রায় নিয়তিবাদী। বলতে পারেন, অনেকটাই পরাজিত।’ এ-ও বলেছিলেন, ‘বাংলার আকাশ আমার বুকপকেটে। আমি ভাঁজ করে নিয়ে যাচ্ছি।’ এ কারণেই বিদেশে গিয়েও মুহূর্তের জন্য বাংলাদেশকে ভুলে থাকতে পারেননি মহাদেব সাহা। যত দিন যাচ্ছিল ততই দেশের জন্য ছটফট বাড়ছিল তার। সে সময় ফোনে কানাডায় যোগাযোগ করে জানা যায়, বাঙালী কবি অন্যের সমাজ ও জীবনের সঙ্গে নিজেকে একদমই মানিয়ে নিতে পারছেন না। একাকিত্ব কুরে কুরে খাচ্ছে তাকে। প্রতিদিন সকালে ছেলে, ছেলের বউ কাজে বেরিয়ে যায়। শূন্য ঘরে বাকি সময়টা একরকম দমবন্ধ করে কাটান কবি ও কবিপতন্ডী। বুড়ো বয়সে নিজেদেরই করতে হয় সব কাজ। পাড়া প্রতিবেশী বলতে কেউ নেই। যেখানে ছিল অসহনীয় ঠান্ডা। এ কারণেও প্রচন্ড ভুগতে হচ্ছিল। তবে লেখালেখি অব্যাহত ছিল। দুহাতে লিখছিলেন। শুনে অবাকই হতে হয়, কানাডায় বসে লেখা কবিতা নিয়ে ঢাকায় প্রকাশিত হয়েছে তার ৭টি কাব্যগ্রন্থ। কাব্য সংগ্রহ- ৬ এসেছে। গদ্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়েছে। এসবের বাইরে পাঁচ শতাধিক গান রচনা করেছেন। প্রথম খন্ডটি ‘আমার গান’ নামে বাজারে এখন। এর পরও কবি বিদেশে থাকতে নারাজ। তার ভাষায়- এখানে মানুষেরা এক সঙ্গে হেঁটে যায় কেই কাউকে চেনে না, মানুষ/এখানে থাকে?/ঢের হয়েছে বিদ্যা, ঢের হয়েছে প্রাপ্তি, তবু যেটুকু জীবন/আছে, বুকে নিয়ে/এবার আপন মানুষদের কাছে ফিরে যাবো...। অবশেষে দিন তারিখ ঠিক হয়। ২৯ আগস্ট দেশের উদ্দেশ্যে ওড়াল দেয়ার প্রস্তুতি নেন কবি। কিন্তু বিষয়টি নিশ্চিত হতে কানাডায় ফোন করতেই মন খারাপ। কবিপত্নী জানান, মহাদেব সাহা গুরুতর অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। আহা, দেশে ফেরা! আর হবে তো? উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কেটে যায় এক সপ্তাহর বেশি সময়। তার পর কিছুটা সুস্থ। ওই ‘কিছুটা’ নিয়েই গত ২ অক্টোবর স্বপ্নের শহর ঢাকায় পা রাখেন তিনি। ফিরতি বিমানে পুত্র চলে গেছে কানাডায়। স্ত্রী ছোট ছেলেকে নিয়ে উত্তরায় এক আত্মীয়র বাসায় উঠেছেন কবি। এখানে থেকেই তিনি ফোনে বলছেন, কারও সঙ্গে দেখা করার অবস্থায় আমি নেই! অগত্যা দুই দফা ফোন করে বিস্তারিত জানার চেষ্টা। এ প্রতিবেদকের পুরনো লেখায় কবিকে দেশে ফেরার আন্তরিক আহ্বান জানানো হয়েছিল। আলাপের শুরুতে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ফিরে এসেছি। দূরে ছিলাম। দেশের বাইরে ছিলাম না। দেশের মাটিকে আবার মাথায় নিতে পেরেছি। বুক ভরে গেল। এটাই আমার আনন্দ।’ আর তার কবিতা বলছে: ভাসমান একটু শ্যাওলা আমি;/এই যে জীবন দেখছো এ জীবন আমার নয়/ভাল আছি বলি কিন্তু ভাল নেই চেয়ে দেখো...।’ হ্যাঁ, বার্ধক্যজনিত নানা রোগে এখনও ভুগছেন কবি। হার্টের অসুবিধা। খেতেটেতে পারেন না। গ্যাস্টিক। এসিডিটি। শ্বাসকষ্ট। পায়ে পানি জমেছে। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলা ফেরা করতে পারছেন না। এর পরও কী আবেগি কবি! অসুস্থতাকে সেই যে বলেছিলেন ‘নির্জন শিল্প’, এখনও তা-ই মানছেন। বলছেন, ‘বাংলাদেশে আমার সুস্থতা আছে। এই প্রকৃতির মধ্যে, নিসর্গের মধ্যে আলো বাতাসের মধ্যে, মানুষের ভালবাসার মধ্যেই আমার সুস্থতা।’ ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন কবিতার মধ্যে থাকতে চাই। সংগঠনের সঙ্গে থাকতে চাই। অনুষ্ঠানে যেতে চাই।’ আপনার সুহৃদরা বন্ধুরা কেউ কি যোগাযোগ করছে? সরকারের কেউ? এমন প্রশ্নে কিছুটা বিব্রত করে কবিকে। ইতস্তত করে বলেন, ‘এগুলা আমি বলতে চাচ্ছি না। এইটুকু বলি, খুব বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।’ এর পর নিজেই যেন সান্ত¦না দেন নিজেকে। বলেন, ‘হয়তো সবাই ব্যস্ত।’ আসলেই কি? প্রকৃত উত্তরটি কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়, যেখোনে কবি লিখেছেন : কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,/শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস...। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহাদেব সাহার অনুপস্থিতি এই শূন্যতার জন্ম দিয়েছিল। সব ছেড়ে ছুঁড়ে গিয়েছিলেন তিনি। এমনকি নিজের জমিয়ে রাখা বই বাংলা একাডেমিতে দান করে গিয়েছিলেন। কবিতার খাতা, ব্যবহৃত কলম দিয়ে গিয়েছিলেন জাদুঘরে। অবশিষ্ট কী থাকে আর? বস্তুত কিছুই নেই মহাদেব সাহার। ভাল থাকার কী হবে তাহলে? এ মুহূর্তে এটি খুব জরুরী প্রশ্ন। প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার জোর প্রচেষ্টা চালান কবি। বলেন, ‘একভাবে চলে যাবে। আমার চেয়েও দুঃখী মানুষ নাই? আমার এতগুলো বই। সরকারের প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি আছে। চলে যাব একভাবে। সবার যদি চলে, এই দেশের কত উন্নতি হয়েছে, সেখানে আমি কি না খেয়ে থাকব?’ অন্যদিকে তার কবিতা বলছে : আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,/উদ্যানে উঠেছে ক্যাকটাস...। কবির পুরনো কবিতা কেউ কি আজ আবার পড়ে দেখবেন?
×