ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

গ্যালিলিও ও মঞ্চনাটক

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ১৯ অক্টোবর ২০১৮

গ্যালিলিও ও মঞ্চনাটক

আশির দশকের পর গত ১৪ অক্টোবর নতুনভাবে গ্যালিলিও এর ২য় মঞ্চায়ন হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। ‘সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে।’ এই সত্য আবিষ্কার করাও ছিল পাপ। তথাকথিত রাষ্ট্রনীতির বিপরীতে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক গ্যালিলিও তার এই আবিষ্কারকে উপস্থাপন করতে পারেননি। প্রচলিত বিশ্বাস ভঙ্গে যদি ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে যায় সেই ভয়ে চার্চ এই আবিষ্কারকে অস্বীকার করে। খড়গ এসে পড়ে তারই মাথার ওপর। ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বীকার করাতে বাধ্য করে এতদিন যা বলেছেন সবই ভুল। পরিণতি বন্দীদশা। তবে বন্দী অবস্থায় রাত জেগে লিখেছেন এবং তা কপি করে রেখেছেন গ্লোবের ভেতর। এরপর তার ছাত্র আন্দে সার্তির হাতে পাচার করে দেন দেশের বাইরে। তিনি যা বিশ্বাস করতেন বা আবিষ্কার করেছেন, ‘ডিসকোর্সি’ নামের লেখায় তাই তিনি বর্ণনা করেছেন। তার এই কাহিনী নিয়েই নাটক লেখেন বার্টল্ড ব্রেখট। নাটকের নাম দ্য গ্যালিলিও গ্যালিলি। নাটকটি অনুবাদ করেছেন আবদুস সেলিম। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় এ নাটকটি প্রথম প্রযোজনা করেছিল ১৯৮৮ সালে। খ্যাতিমান নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা আতাউর রহমান তখন নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এবার ২০ বছর পর নাগরিকের প্রযোজনায়ই মহিলা সমিতির নবনির্মিত নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে গত শুক্রবার মঞ্চায়িত হয় নাটকটি। এবার নির্দেশনায় ছিলেন পান্থ শাহরিয়ার। আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির নাটকটি এবার কমিয়ে আনা হয়েছে দেড় ঘণ্টায়। মঞ্চের বলিষ্ঠ অভিনেতা, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূর, কাওসার চৌধুরী প্রমুখ নাটকটিতে অভিনয় করেন। নতুন করে নাটকটি প্রযোজনায় যে ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হয়েছে তা হলো দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। টিকেটের জন্য হাহাকার। দর্শকদের নানা আকুতি মিনতি যেন দাঁড়ানোর টিকেট দেয়া হয়। সত্যি ভাল শিল্পের গ্রহণ যোগ্যতা কমে যায়নি। গল্প এবং অভিনয় যদি শিল্পমান বজায় রাখতে পারে তবে দর্শকের কমতি হয় না। বেঁচে থাকে শিল্প। বছর দুই আগে ঈদের ছুটির মধ্যে সৈয়দ জামিল আহমেদের রিজওয়ান নাটকটি সাড়া ফেলেছিল নাট্যাঙ্গনে। অনেকেই টিকেট না পেয়ে ভারাক্রান্ত মনে ফিরে গিয়েছিল সেদিন। আজ অনেক কথা হয়ত ওঠে মঞ্চপাড়ায়। দর্শকরা নাটক দেখতে চায় না। কথাটা একেবারে সত্যি নয়। এমনকি চলচ্চিত্রের বেলায়ও ঠিক একই দৃশ্য দেখা যায় মাঝে মাঝে। অর্থাৎ ভাল প্রযোজনা সে যে ফরমেটেই হোক না কেন তার দর্শক চাহিদা থাকবেই। মনোমুগ্ধকর এই প্রযোজনায় আলী যাকের যেভাবে চরিত্রায়ন করেছেন, তা নতুন শিল্পীদের আবারও উজ্জীবিত করবে। নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে জয় করে তিনি যা উপহার দিলেন ওই নীলিমা ইব্রাহিম মঞ্চে এ যেন চোখ ধাঁধানো, মন মাতানো। এ কেবল কিংবদন্তি নাট্যাভিনেতার দ্বারাই সম্ভব। কাহিনীর পরিবর্তন অর্থাৎ চার্চের বন্দী জীবনে প্রবেশের পূর্বাপর নিজেকে পরিবর্তন অর্থাৎ চরিত্রায়নে ছিল যথাযথ উপস্থাপন। একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে নিজের ভেতর ধারণা করা আর তার বহির্প্রকাশ ঘটানো যেন আলী যাকের দ্বারাই সম্ভব। অন্যদিকে পোপের ভূমিকায় ছিলেন আরেক বলিষ্ঠ অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। অভিনেতা হিসেবেই যিনি মানুষের হৃদয় কেড়েছেন। সকলের কাছে নন্দিত হয়েছেন। যে বাকের ভাইকে শাস্তি প্রদানে সারা বাংলায় মানুষ মিছিল বের করেছিলেন তার সঠিক দৃশ্যায়ন হয়েছে এই নাটকে। ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে এক মানবিক পোপ থেকে যে স্বৈরাচারী পোপের রূপান্তর তার শতভাগ সফলভাবে তিনি দর্শকদের দিতে পেরেছেন। এ অভিনয় শুধু অভিনয়ই নয়, নাট্যজগতের উদাহরণ। আমাদের তরুণ শিল্পীদের পাথেয়। মঞ্চনাটকের অবস্থান বিগত এক দশক হতে কিছুটা উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যকলা বিভাগ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষতজনেরা সেখানে পাঠদান করছেন। পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে উন্নত কারিগরি সহযোগিতা। আলোক প্রক্ষেপণে যুক্ত হয়েছে নানামাত্রিকতা। গবেষণা হচ্ছে নাটক নিয়ে। নতুন নতুন তরুণ নাট্য লেখক ভাল ভাল নাটক লিখছেন সেই সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষিত তরুণেরা যুক্ত হচ্ছে অভিনয় ও নির্দেশনায়। সর্বোপরি মঞ্চ শিল্প উন্নতমাত্রা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছে। এ অবস্থায় এই গ্যালিলিও নাটকটি কলাকুশলীদের নতুনভাবে প্রাণের সঞ্চার করে দিয়েছে। এবার একটু ইতিহাস পর্যালোচনা করা যাক। স্বাধীনতা-উত্তর মঞ্চনাটক চর্চা আবার নতুন পথ দেখতে শুরু করে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। সেই প্রতিযোগিতার একটি বড় শর্ত ছিল নাটকের পা-ুুলিপি হতে হবে দলের অভ্যন্তরীণ নাট্যকারের লেখা। তৈরি হয়ে যায় বেশ কিছু নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। যেমন সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ম. হামিদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নাট্যজন। অন্যদিকে স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই যারা নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, নাট্যচর্চাকে নাট্যধারায় অক্ষুণœ রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার। এই গুণী নাট্যব্যক্তিত্বদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় মঞ্চনাটকের জৌলুস ফিরে আসতে থাকে। নাটকের নির্মাণ, অভিনয় প্রয়োগে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের ছাপ দেখা দেয়। সামাজিক, বৈপ্লবিক নাটকের পাশাপাশি নাটকে স্থান পায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাস্তবতা, রোমান্টিকতা কমেডি। তবে লক্ষণীয় যে যুদ্ধপরবর্তী নাট্য জগতের রথী, মহারথীদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তৎকালীন নাটকগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাকসেনাদের এক দোসরকে কেন্দ্র করে সৈয়দ শামছুল হক রচনা করেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়।’ এটিকে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম কাব্য নাটকও বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া ‘এখানে এখন’ নাটকেও তিনি ফুটিয়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাকে। ‘জয়জয়ন্তী’ নাটকে মামুনুর রশীদ তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রাম্যজীবন ও শিল্পীদের জীবন সংগ্রাম। ড. এনামুল হক রচনা করলেন সেই সব দিনগুলো।’ এসএম সোলায়মানের এ দেশে এ বেশে নাটকের বিষয়বস্তু ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নও প্রাপ্তি। নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু রচনা করলেন, ‘একাত্তরের পালা’ ও টিটোর স্বাধীনতা। মমতাজউদ্দিন আহমেদের ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ কি চাহো শঙ্খচিল, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা ও বর্ণচোরা নাটকে উঠে আসে স্বাধীনতার ইতিহাস। সে সময় মঞ্চের পাশাপাশি নাটক পথেও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এসএম সোলায়মান ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’ পথনাটকে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছিলেন। মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য পথনাটক। স্বাধীনতা উত্তর দশ বছরে মঞ্চ নাটকে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সে সময় স্ব-স্ব দলের প্রযোজনার পাশাপাশি নাট্যকর্মীরা একটি ছাতার নিচে আসার তাগিদ অনুভব করলেন। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উল্লেখযোগ্য নাট্যদলগুলো আলোচনায় বসে এবং তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা হাতে নেয় যা বাস্তবায়ন হয় ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে। ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে নির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দু মজুমদার ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। নাট্য আন্দোলন আরও বেগবান হলো, সংযোজিত হলো নাট্যবিষয়ক শিক্ষাগ্রহণকারী পেশাদারী নাট্যকর্মী। (দিল্লীর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) এনএসডি থেকে সদ্য বের হওয়া কিছু নাট্যকর্মী তাদের শ্রম এবং শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে লাগলেন মঞ্চ প্রযোজনায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাবে মঞ্চনাটক নতুন মাত্রা পেল। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে সেলিম আল দীনের কীর্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, চাকা, মামুনুর রশীদের ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, এখানে নোঙর, খোলা দুয়ার, গিনিপিগ, আব্দুল্লাহ আল মামুনের সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস, মমতাজউদ্দিনের বিবাহ, কি চাহ শঙ্খচিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। বাংলা নাট্য ইতিহাসে অপর এক মাইলফলক হচ্ছে ‘মুক্ত নাটক’। নগরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চাকে মধ্যবিত্তের বলয় থেকে বের করে বৃহত্তর শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে একাত্ম প্রকাশ করে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরণ্যক নাট্যদলের নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে শুরু হয় মুক্ত নাটক আন্দোলন। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক প্রসেনিয়াম আর্চ ভেঙ্গে রাজপথে এসে জায়গা করে নিল, নাট্যচর্চা মঞ্চের পাশাপাশি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে শহীদ মিনার উদ্যান, পার্ক, ময়দানে। বাংলাদেশে পথনাটকের গোরাপত্তন ঘটে ঢাকা থিয়েটারের চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি নাটকটির মাধ্যমে। সেলিম আল দীনের রচনায় ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় টিএসসির সড়ক দ্বীপে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। তৎকালীন স্বৈর সরকারের পুলিশ বাহিনী নাটকটির ওপর হামলা চালায়। তবে নব্বইয়ের স্বৈরসরকারের পতন ও গণআন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটারের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি, স্বৈরাচারের কীর্তিকলাপ ও গণতন্ত্রের মুক্তি নিয়ে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়। মমতাজউদ্দিন আহমেদের সাতঘাটের কানাকড়ি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট প্রমাণপত্র। ’৯০-এর দশকে ঢাকা থিয়েটার তাদের চিন্তাভাবনাকে একটু ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়েছিল। হাজার বছরের বাঙালীর ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টায়। সেলিম আল দীনের রচনায় ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় যৈবতি কন্যার মন, হাতহদাই বনপাংশুল প্রভৃতি। এর মাধ্যমে নাট্যরীতি বহুমাত্রিকতা লাভ করে যেমন বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি, পাঁচালী রীতির প্রবর্তন হয়। গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনায় এই উপমহাদেশীয় নাটকের পাশাপাশি সংযোজিত হয় পাশ্চাত্যের অনুবাদ নাটক। যেমন সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাসের’ মতো ধ্রুপদী নাটক থেকে শুরু করে স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কা, বার্টল্ট ব্রেখট, জ্যাঁ পল সার্ত, এলবেয়ার ক্যামু, এডওয়ার্ড এলবি, হেনরিক ইবসেন, শেক্সপিয়ার, হাইনার ম্যূালার, হ্যারল্ড পিন্টার, আর্থার মিলার, মলিয়ের প্রমুখ নাট্যকারদের নাটক উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে মলিয়েরের কমেডি বিশেষভাবে দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যেমনÑ লোকনাট্যদলের কঞ্জুস, কুশীলবের গিট্টু, নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু অন্যতম। বলতে দ্বিধা নেই যে, মলিয়েরের কমেডি নাটক দিয়ে দর্শক ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা ছিল নাট্যাঙ্গনে। যাহোক, জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বার্টল্ট ব্রেখটের অনুবাদ নাটকগুলো যেমনÑ নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের গ্যালিলিও, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিস্সা, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘জনতার রঙ্গশালা’ অন্যতম। এপিক থিয়েটারের যে ধারা ব্রেখট সৃষ্টি করে গেছেন তা দর্শকদের নাটকের সঙ্গে যুক্ত রাখার চমৎকার উদাহরণ। বিদেশী নাটকের মধ্যে আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি ও কমেডি। ঢাকা থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দর্পণ, থিয়েটারের ম্যাকবেথ। ঢাকার মঞ্চে নিরীক্ষাধর্মী নাটক স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ সফল মঞ্চায়নও হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর মঞ্চে অভিনয়ের পাশাপাশি আলোক পরিকল্পনা ও মঞ্চসজ্জা, রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব পড়েছে নাটকের এই শাখাগুলোতে আলোক পরিকল্পনার আধুনিকায়নে যারা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার তারা হচ্ছেন ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামরুজ্জামান। জামিল আহমেদের আলোক পরিকল্পনায় প্রযোজিত হয়েছে ফণিমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, ইনস্পেক্টর জেনারেল, ইডিপাস, গিনিপিগ, অচলায়তন, বিসর্জন, বিষাদ সিন্ধু। ড. জামিল আহমেদ প্রথম বাংলা নাটককে দেশের গ-ি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে মঞ্চায়িত করেন। সেলিম আলদীনের রচিত চাকা নাটকটি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করে ডেনি প্যাট্রেজের সঙ্গে যৌথভাবে নির্দেশনা দেন আমেরিকায় এবং এটি তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন। এরপর ১৯৯১ সালে ঢাকার মঞ্চে নাটকটির নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া তিনি বিষাদ সিন্ধু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন যার পা-ুলিপি রচনা করেছিলেন ড. বিপ্লব বালা। নাটকটির স্থিতিকাল ছিল ৬ ঘণ্টা। এ ছাড়া তার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় লোকনাটক কমলা রানীর সাগরদীঘি, বেহুলার ভাসান, সংভংচংয়ের মতো প্রযোজনা যা দর্শককে আকৃষ্ট করেছিল দারুণভাবে। কিন্তু এ ধরনের কাজের অপ্রতুলতা মঞ্চনাটক থেকে দর্শকবিমুখতা তৈরি হয়েছে। ২০১০ সালে তিনি পুনরায় এনএসডিতে নির্দেশনা দেন ম্যাকবেথ নাটক এবং ২০১২ সালে কলকাতায় শ্যামার উড়াল। তার রচনায় রয়েছে প্রথম গ্রন্থ ‘হাজার বছর বাংলাদেশের নাটক ও নাট্যকলা’, ৭০টি লোকনাট্যরীতি নিয়ে গ্রন্থ অচিন পাখি এবং উন্নয়ন নাট্য নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী গ্রন্থ তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা : উন্নয়ন নাট্য : তত্ত্ব ও প্রয়োগ। নিরীক্ষাধর্মী নাটক নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে কিন্তু অনিয়মিত মঞ্চায়নের ফলে এগুলোর সম্প্রসারণ বা প্রচার হচ্ছে না। ড. ইস্রাফিল শাহীন ম্যাকবেথ নাটকটিতে প্রচলিত প্রসেনিয়াম রীতি ভেঙ্গে পরীক্ষণমূলকভাবে একটি সফল প্রযোজনা করেছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের বদৌলতে নাট্যচর্চা এ ভূখ-ে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। এখন ছোট-বড় মিলে দুই শতাধিক নাট্যদল রয়েছে, প্রযোজনাও হচ্ছে নিয়মিত। মঞ্চের অপ্রতুলতা যদিও এর অন্তরায়, আরও মঞ্চের প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক নাট্যমঞ্চ এখন যুগের চাহিদা। তবে পেশাদারিত্বের অভাব এখনও মঞ্চনাটকে পরিলক্ষিত হয়। মঞ্চ নাটকে পেশাদারিত্ব এনে দিতে না পারলে এ শিল্পের ধারাবাহিকতায় যথেষ্ট টান পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পেশাদার নাট্যদল গঠনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল বাংলা থিয়েটার (১৯৯১) থিয়েটার আর্ট ১৯৯২ এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) ১৯৯৪। সিএটি ছাড়া বাকি দুটি দল ব্যর্থ হয়েছে। কামালউদ্দিন নিলুর উদ্যোগে বিদেশী কিছু পেশাদারী নাট্যকর্মীর সহযোগিতায় ঢাকার মঞ্চে নাট্যচর্চা শুরু করেন। এখন দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বাংলা নাটক ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের নাটকও প্রযোজিত হচ্ছে এ বাংলায়। এপারের সঙ্গে ওপারের তৈরি হয়েছে সেতুবন্ধন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই কমনওয়েলথ গেমসের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে মঞ্চস্থ হয়েছে থিয়েট্রেক্সের প্রযোজনায় শাহমান মৈশানের রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত নাটক দক্ষিণা সুন্দরী। দেশের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর উদ্যোগে দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও যুবদের নিয়ে তার পিপলস থিয়েটার একটি যুগান্তকারী প্রয়াস। ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর হতে ১০ সেপ্টেম্বর প্রতিদিন বিকেল ৪টায় ও রাত ৮টায় দুটি করে পরিবেশনা হয়েছিল রিজওয়ান নাটকের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান নিয়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়াতে নাটবাঙলা আয়োজন করেছিল ১০ দিনব্যাপী নাট্যোৎসব। দীর্ঘ বিরতির পর ঢাকার মঞ্চ আবার সৈয়দ জামিল আহমেদের বদৌলতে দর্শকমুখর হয়ে উঠার পাশাপাশি ঈদের ছুটিতেও নিরব শিল্পকলা যে সরব হতে পারে তার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল। সৈয়দ জামিল আহমেদ যেন এ সময়ের ঘটনাগুলোই তার নিপুণ কৌশলে মালা গেঁথে সাজিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। আর সে সঙ্গে পরীক্ষণ থিয়েটার যেন সার্থক হয়েছিল। রিসোর্স শুধু থাকলেই চলবে না, তার যথাযথ ব্যবহার করার দক্ষতাও প্রয়োজন। তাই বলতে চাই এটি আমাদের দেশের একটি বড় সম্পদ যা জামিল আহমেদের হাতে পড়ে এর ভিন্ন মাত্রিকতা প্রকাশ পেয়েছে। এ থেকে যেন পরবর্তী নাট্য কলাকুশলীরা এই মঞ্চটাকে আরও ভালভাবে ব্যবহার করতে পারেন। ‘রিজওয়ান’ নামক এই নিরীক্ষা বাংলা নাট্যকে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এ বছর মহাকাল নাট্যসম্প্রদায়ের ৪০তম প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চায়ন হয়েছে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকা- নিয়ে গবেষণালব্ধ নাটক ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক আননজামান রচিত নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার ও পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আশিকুর রহমান লিয়ন। এটিকে শুধু একটি প্রযোজনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই নাটকের মধ্য দিয়ে মঞ্চ নাটকে নতুন মাত্রা যুক্ত হলো। সৃষ্টি হলো নতুন ইতিহাস। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই খুনী চক্র জাতির পিতার চিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিল। তাদের অপছায়া এতটাই শক্তিশালী যে শ্রাবণ ট্র্যাজেডির মতো নাটক তৈরি হতে সময় লেগেছে ৪৭ বছর। পরিশেষে বলা যায় আশাহত হওয়ার কিছু নেই, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নাট্যকলা বিভাগে বিএ সম্মান ও মাস্টার্স পড়ানো হচ্ছে। তাই মেধার বিকাশ অবিস্বম্ভাবী। এ ছাড়া তরুণ নাট্য নির্মাতা যেমনÑ আজাদ আবুল কালাম, শুভাশিষ সিনহা, সুদীপ চক্রবর্তী, তিতাস জিয়া, আহমেদুল কবির ইয়াং, রুহুল আমিন, রিয়াজউদ্দিন মাহমুদরা তরুণ নাট্যকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পূর্বসূরিদের দিকনির্দেশনায় মঞ্চনাটককে আধুনিকায়নের সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই রিজওয়ান, শ্রাবন ট্র্যাজেডি, ম্যাকবেথ ও গ্যালিলিও এর মঞ্চায়ন আগামী দিনের পথ প্রদর্শক।
×