ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘সোনার মেয়ে’ আঁখির ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প

প্রকাশিত: ০৬:৫৪, ১৭ অক্টোবর ২০১৮

‘সোনার মেয়ে’ আঁখির ফুটবলার হয়ে ওঠার গল্প

বাংলাদেশের নারী ফুটবলে বর্তমানে বয়সভিত্তিক দলে সবচেয়ে নির্ভরতার প্রতীক আঁখি খাতুন। বয়স তার মাত্র ১৫। তাকে কি? বয়স কম হলেও প্রতিভায় ছাড়িয়ে গেছেন অনেক বড় ফুটবলারকে। তার নজর কাড়া নৈপুণ্য দেখতে মুখিয়ে থাকেন দর্শক। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার পাটখোলা গ্রামে। একেবারে দরিদ্র ও সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয়া এই ক্ষুদে মেয়ে ফুটবলারের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ফুটবলার হওয়ার। তাই স্বপ্নের পেছনে ছুটেছেন অবিরাম। আর্থিক টানাপোড়েন, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা সব বাধা তিনি জয় করেছেন অদম্য পরিশ্রম আর সাহসের মাধ্যমে। এই আঁখি খাতুন এখন বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে অতি পরিচিত একটি নাম। অজপাড়াগাঁয়ের সেই আঁখি খাতুন এখন ‘সোনার মেয়ে’। আঁখি খাতুন মূলত একজন ডিফেন্ডার। কিন্তু গোল করতেও পটু তিনি। এমনকি গোল করাতেও। আঁখি খাতুনের শারীরিক উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। শারীরিক গঠনে অন্যদের চেয়ে লম্বা হওয়ায় তাকে ফ্রি-কিকের দায়িত্ব নিতে হয়। লম্বা ফ্রি-কিক নিতে তিনি দারুণ দক্ষ। তাই ফ্রি-কিকের সুযোগ এলে দলও নির্ভর করে আঁখি খাতুনের ওপর। এ ছাড়া প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে কর্নার লাভের সময় ছুটে যান গোলমুখে। উচ্চতা তার বাড়তি সুবিধা। সুযোগ পেলে কর্নার থেকে উড়ে আসা বলে গোল করার দৃষ্টান্তও তার রয়েছে। অর্থাৎ একজন ডিফেন্ডার হলেও সারা মাঠই দাপিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। আর এই কাজটি ভালভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই করেন তিনি। রক্ষণে যেমন শক্ত দেয়ালের ভূমিকা পালন করেন, ঠিক তেমনই প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে গোল করেন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর-৭ অক্টোবর ভুটানে অনুষ্ঠিত হলো সাফ অনুর্ধ-১৮ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ। এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে বড় অবদান রয়েছে আঁখি খাতুনের। দলের এই ডিফেন্ডার পেয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। তার হাতে উঠেছে গোল্ডেন বুট। ‘সোনার মেয়ে’ আঁখি খাতুন গত আগস্টে ভুটানে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপেও আসর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপেও সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন আঁখি খাতুন। অর্থাৎ, একের পর এক স্বর্ণ গোল্ডেন বুট) জিতে চলেছেন তিনি। তাই তো তাকে ‘সোনার মেয়ে’ বলাটা মোটেও ভুল হবে না। বয়সভিত্তিক ফুটবলের যে কোনও আসরে বাংলাদেশের মেয়েরা প্রতিপক্ষ দলকে পাত্তাই দিচ্ছে না। প্রতিপক্ষদের বড় ব্যবধানে উড়িয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ। সে তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েরা গোল হজম করছে না বললেই চলে। যা হচ্ছে তা খুবই নগণ্য। দল যাতে গোল হজম না করে সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন ডিফেন্ডাররা। আর নারী ফুটবলে বাংলাদেশ দলের রক্ষণকে বর্তমানে নেতৃত্ব দেন আঁখি খাতুনই। প্রতিপক্ষ দলের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা যেন নিজেদের দুর্গে ঢুকে না পড়ে সেজন্য ডিফেন্সে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করছেন সুনামের সঙ্গে আঁখি। সাফ অনুর্ধ-১৮ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপে মোট চারটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের মেয়েরা ২৪টি গোল করেছে। আর মাত্র একটি গোল হজম করেছে। টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে হারানোর পর নেপালকে ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। এরপর সেমিফাইনাল ম্যাচে ভুটানকে ৪-০ গোলে ও ফাইনালে নেপালকে ১-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। গত আগস্টে ভুটানে অনুষ্ঠিত হয় সাফ অনুর্ধ-১৫ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের আসর। এই আসরে বাংলাদেশ রানার্সআপ হয়। এই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ম্যাচ ছাড়া অন্য কোন ম্যাচে হারেনি বাংলাদেশ। এই টুর্নামেন্টে গ্রুপ পর্বে পাকিস্তানকে ১৪-০ গোলে ও নেপালকে ৩-০ গোলে হারায় বাংলাদেশের মেয়েরা। তারপর সেমিফাইনালে ভুটনাকে বাংলাদেশ হারায় ৫-০ গোলে। কিন্তু ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ০-১ গোলে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ। তবে এই হারের পেছনে দল বা বাংলাদেশের মেয়েরা যত না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী দুর্ভাগ্য। গোটা মাঠে সমান তালে লড়াই করে। গোলের সহজ সুযোগও আসে। কিন্তু ভাগ্যদেবী পাশে না থাকায় জিততে পারেনি মারিয়ারা। তবে এই টুর্নামেন্টেও নজর কাড়েন আঁখি খাতুন দৃষ্টিনন্দন ফুটবল উপহার দিয়ে। আঁখি খাতুন এখন গণমাধ্যমে নিয়মিত খবরের শিরোনাম হচ্ছেন। মিডিয়ার কাছে তিনি তুলে ধরেন তার ফুটবলার হয়ে ওঠার স্বপ্নিল গল্প। একজন তাঁত শ্রমিকের ঘরে জন্ম আঁখি খাতুনের। দরিদ্র ঘরে জন্ম নিলেও বড় স্বপ্ন দেখতে তো বাধা নেই। তাই আঁখি খাতুনও স্বপ্ন দেখতেন নামকরা ফুটবলার হওয়ার। এলাকার অন্যরা আঁখি খাতুনকে নিয়ে কটু কথা বললেও আঁখির মা-বাবা তাকে সবসময় অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। সহযোগিতা করেছেন তার স্কুল শিক্ষকরাও। যার ফলে আজকের তার এই পর্যায়ে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আঁখি খাতুন বলেন, ‘যখন প্র্যাকটিসে যেতাম তখন অনেক বাধা বিপত্তি আসত। কিন্তু মা-বাবা আমাকে সাপোর্ট করেছেন। স্কুলের স্যাররা অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। এ কারণে আমি এতদূর আসতে পেরেছি। এখন গ্রামের সবাই আমার খেলা ও ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠা জীবনকে সমর্থন করেন। দেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষ, সবাই আমাকে আমাদের দলকে সমর্থন করেন। সবাই ভাবে মেয়েরাও এখন আর পিছিয়ে নেই। তারাও ভাল কিছু করছে। অবদান রাখছে দেশের জন্য। মা-বাবার সমর্থন সবসময় পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি। ভবিষ্যতেও তাদের কাছ থেকে এমন সমর্থন চাই।’ আমি যখন খেলা শুরু করি তখন এলাকার লোকজন, মহিলারা আমার মা-বাবার কাছে অভিযোগ করে বলতেন মেয়ে হয়ে ফুটবল খেলে, এটা ভাল নয়। কিন্তু মা-বাবার এসব অভিযোগ পাত্তা দিতেন না। বরং উল্টো আমাকে খেলার জন্য উৎসাহ দিতেন। কিন্তু এখন সব কিছু পাল্টে গেছে। যারা আমার ফুটবলার হওয়া নিয়ে আপত্তি করতেন তারাই এখন আমার বড় ভক্ত। বিদেশে বা দেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক খেলা শেষে আমি যখন বাড়ি ফিরি তখন গ্রামের দূর-দূরান্তের মানুষ ভিড় জমায়। আমাকে এক নজর দেখতে আসে। স্থানীয় সরকারী প্রশাসন আমাকে সংবর্ধনা দেয়। আমি মনে করি আমার খেলোয়াড়ী জীবন সার্থক। যদিও এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেক পথ। এখনই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে চাই না। আরও অনেক বড় ফুটবলার হতে চাই। সেই সংগ্রাম থেকে পিছু হটতে চাই না। একটাই স্বপ্ন, আরও এগিয়ে যাওয়া। আঁখি খাতুনের মা নাসিমা খাতুন বলেন, ‘আঁখি একদিন আমাকে বলে যে, আম্মু আমাকে একটা জার্সি ও একটা বল কিনে দাও। কিন্তু আমার তো জার্সি-বল কিনে দেয়ার মতো সামার্থ্য নেই। তখন ওর আব্বু পাশের মাঠে খেলা অবস্থায় ছেলেদের জার্সি চাইতে গেল। কিন্তু তারা জার্সি দেয়নি। তখন ওর বাবা বাড়ি এসে ওকে বলল যে, আম্মু আমি তোমাকে জার্সি কিনে এনে দিব। পরে জার্সি ও বলের জন্য ওর বাবা বাজারে গেল। পকেটে টাকা ছিল মাত্র ৫০০। কিন্তু দোকানে জার্সি-বলের দাম চাইল ৭০০ টাকা। তখন ওর বাবা বাজার থেকে ফিরে এসে স্কুলের শিক্ষককে বললে তিনি সহযোগিতা করেন। এরপর কেনা হয় প্রত্যাশার বল-জার্সি। এভাবে কষ্ট ক্লেশ করে খেলাধুলা করতে করতে বিকেএসপি থেকে আমার মেয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেল।’ আঁখি খাতুনের বাবা বলেন, ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ না হলে এসব মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ পেত না। ক্রীড়াপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি এই উদ্যোগ না নিলে আঁখির মতো অনেক মেয়ে ঘরের কোনায় পড়ে থাকত। দেশবাসীর কাছে আমার মেয়ের জন্য দোয়া চাই। আর দলও যেন ভাল করে সেটাও কামনা করি।’ আঁখি খাতুন যখন অনুশীলন করতেন তখন পাশের অনেকেই এসে তার মা-বাবাকে বলত, আপনার মেয়েকে ফুটবল খেলতে যাইতে দেন কেন? ওকে নিষেধ করতে পারেন না। কিন্তু আঁখির মা-বাবা কাউকে পাত্তা দেননি। তারা উত্তরে বলে দিতেন, আঁখি মেয়ে তো কী হয়েছে? এখন যিনি দেশ চালাচ্ছেন তিনিও তো নারী। আঁখি খাতুনকে এক সময় যারা বকা দিয়েছেন, যারা আড় চোখে তাকিয়েছেন এখন তারাই সুনাম করেন আঁখি খাতুনের। বাড়িতে গেলে অনেকেই এক নজর দেখতে আসেন আঁখি খাতুনকে। টেভিলিশনের পর্দায় নিজেদের গ্রামের ফুটবলার মেয়েটিকে দেখে পুলকিত হন এলাকাবাসী। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপের মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছে সিরাজগঞ্জের আঁখি খাতুন। এই টুর্নামেন্টে ভাল করার পর তিনি বিকেএসপিতে ভর্তির সুযোগ পায়। মূলত তারপরই সুযোগ পেয়ে যায় নারীদের বয়সভিত্তিক জাতীয় ফুটবল দলে। ২০১৫ সালে তাজিকিস্তানে অনুষ্ঠিত এএফসি অনুর্ধ-১৪ গার্লস রিজিওনাল চ্যাম্পিনশিপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। এই দলে ডাক পান আঁখি খাতুন। এই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। গ্রামের বাড়িতে আঁখি খাতুনদের টিনের ঘর। বাবা তাঁতশ্রমিক। মা সুঁতা বোনার কাজ করেন। দরিদ্র পরিবারে আঁখির কল্যাণে এখন ফিরেছে বেশ সচ্ছলতা। আঁখির মতো তার অন্য অনেক সতীর্থও উঠে এসেছেন দরিদ্র পরিবার থেকে। কিন্তু এখন ফুটবল খেলেই তারা পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফুটাচ্ছেন। আঁখি খাতুন ভবিষ্যতে সিনিয়র দলে খেলতে চান। তার ইচ্ছা দেশের বড় মাপের একজন ফুটবলার হওয়া। আর দলকে একের পর এক সাফল্য এনে দেয়া। ভবিষ্যতে অন্য মেয়েরাও যেন ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহী হয় সে বিষয় নিয়েও কাজ করতে চান আঁখি খাতুন। সময়-সুযোগ পেলে প্রশিক্ষণ দেন স্থানীয় মেয়েদের। যারা আঁখিকে দেখে রঙিন স্বপ্ন দেখছে ফুটবলার হওয়ার। সাফ অনুর্ধ-১৮ চ্যাম্পিনশিপের কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৯ সালের এএফসি অনুর্ধ-১৬ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশের মেয়েরা। এরপরই ভুটনে অনুষ্ঠিত সাফ অনুর্ধ-১৮ আসরের শিরোপা জয়। পরপর এই দুই টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন নারী দলকে সম্প্রতি গণভবনে সংবর্ধনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জয়ী দলের প্রত্যেক ফুটবলারকে দশ লাখ টাকা করে আর্থিক সম্মাননা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সংবর্ধনা নারী দলকে সামনে আরও ভাল পারফরম্যান্স করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করবে। সেই সাঙ্গে দেশের শিল্পপতিরাও যদি সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন তাহলে বাংলাদেশের নারী ফুটবল এগিয়ে যাবে বহুদূর।
×