ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার

কাস্তে হাতে ধানকাটার ছন্দ এখন বিশাল যন্ত্রে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৪ অক্টোবর ২০১৮

কাস্তে হাতে ধানকাটার ছন্দ এখন বিশাল যন্ত্রে

সমুদ্র হক ॥ ধান ওঠার মৌসুমে কামলা কিষানের ছোটাছুটির দিন শেষই হয়ে এলো। গৃহস্থ ও কৃষকের আঙ্গিনায় কিষান কিষানীর কাজ অনেক কমে এসেছে। ফসলের মাঠে সারিবদ্ধ হয়ে বসে ভাওয়াইয়া ও ভাটিয়ালি সুরের টান ধরে কাস্তে হাতে দ্রুততার সঙ্গে ধান গাছ কাটার ছন্দ এখন বিশাল যন্ত্রে একই সঙ্গে অনেকগুলো কাজের অনেকগুলো ছন্দে পরিণত। একই সঙ্গে কাটা মাড়াই ঝাড়াইয়ের পর ধান বস্তায় ভরে খড় আলাদা করে দেয়ার যন্ত্রটি এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে ফসলের মাঠে। বিশাল কর্মযজ্ঞের এই যন্ত্রটির নাম কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার। এই যন্ত্র কৃষকের হাতে তুলে দিতে সরকার ভর্তুকিতে বিক্রি করছে। কৃষি যন্ত্র শৈলী এতই এগিয়েছে যন্ত্রই সকল কাজ করে দিচ্ছে। হালের বলদের চাষ উঠে গিয়ে পাওয়ার টিলার (কলের লাঙ্গল) এসেছে অনেক আগেই। অধিক জমিতে চাষের জন্য এই কলের লাঙ্গলেও আর হচ্ছে না। এসেছে ট্রাক্টর। এর অনেক আগেই এসেছে সেচ যন্ত্র (শ্যালো ইঞ্জিন)। কৃষিযন্ত্রবিদরা দেখলেন কৃষির সকল কাজই তো যন্ত্রে করা যায়। তাহলে আর দেরি কেন! এগিয়ে যাওয়ার এই পালায় একে একে উদ্ভাবিত হতে থাকে হরেক রকমের যন্ত্র শৈলী। যে যাত্রা আর থেমে নেই। ধান কাটার পর মাড়াই করে ঝেড়ে বস্তায় তুলে খড়গুলো আলাদা করা হচ্ছে একটি বড় যন্ত্রে। ফসলের মাঠে রোদে পুড়ে কৃষককে আর এত খাটুনি করার কি দরকার। অধিক কামলা কিষানেরও দরকার নেই। জনা তিনেক মানুষ হলেই চলবে। যা করার তা যন্ত্রটিই করবে। সেই চেনা ছবি ধানের আঁটি কাঁধে করে গৃহস্থের আঙ্গিনায় উঁচু করে রাখার দৃশ্য হয়তো আর কিছুটা সময় থাকবে। গরুর পা দিয়ে খঁচিয়ে ধান মাড়াইয়ের দিনও প্রায় শেষ। খড়ের পালা থাকছে না। অনেকগুলো কাজ একই সঙ্গে করে দেয়ার কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার বগুড়া অঞ্চলে কয়েকজন এনেছেন। ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের তৈরি বেশি ক্ষমতার বড় কম্বাইন্ড হারভেস্টরের দাম ২০/২৫ লাখ টাকা। কম ক্ষমতার কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার এসেছে। যার দাম ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা। বগুড়ার শিবগঞ্জের পিরব ইউনিয়নের জানগ্রামের তরুণ আল আমিন (২৬) উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর পরিচিত জনের কাছে জানতে পারেন, সরকার ভর্তুকিতে প্রতিটি উপজেলায় দুইটি করে কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার দিচ্ছে। তিনি যোগাযোগ করেন ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। মাঝারি আকারের ১৮ লাখ টাকা দামের কম্বাইন্ড হারভেস্টরে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে ৫ লাখ টাকা। কৃষি বিভাগের মাধ্যমে তিনি ১৩ লাখ টাকার কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কেনেন প্রায় দেড় মাস আগে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতিটি এলাকায় গিয়ে গৃহস্থ ও কৃষকের জমির ধান কেটে দিচ্ছেন। বগুড়া সদরের শাখারিয়া গ্রামে প্রতিবিঘা জমির ধান কেটে বস্তায় ভরে রেডি করে দিতে নিচ্ছেন ৬শ’ টাকা থেকে ৮শ’ টাকা। যাদের জমি কম তাদের ধান কেটে দিচ্ছেন। কোন হারভেস্টরের সঙ্গে ট্রলি আছে। ট্রলিতে বস্তা বোঝাই করে একেবারে কৃষকের আঙিনায় পৌঁছে দিচ্ছেন। এই যন্ত্রে কৃষকের কামলা খরচ অনেক কমেছে। গ্রামের কিষানীদের ধান ঝাড়াই করার জন্য শ্রম দিতেও হয় না। এক চালকল মালিক বললেন, চাতালের কাজও দ্রুত করতে পারছেন। আগে যে চাতালে মাঠ থেকে ধান আসতে সময় লাগত ১৫/১৬ দিন তা এখন ২/৩ দিনের মধ্যে চলে আসে। কৃষিতে চারা রোপণ ও শস্য কর্তন ঝাড়াই বাছাই অতিরিক্ত শ্রম নির্ভর। সকল কাজেরই যন্ত্র এসেছে। শস্য সংগ্রহের সার্বিক ব্যবস্থার কম্বাইন্ড হারভেস্টরে আছে ৫টি অংশ। শস্য কর্তন বা আহরণ, থ্রেসিং বা মাড়াই করা, ঝাড়াই বা পরিষ্কার করা, দানাদার শস্য আনলোড করে বস্তায় ভরানো ও খড় নির্গত করা। কোন জমির ন্যুইয়ে পড়া ধানও সহজেই কাটতে পারে এই যন্ত্র। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার কয়েক ধরনের। হুইল ক্রোলার রিপিং ধরনের হারভেস্টারে ২ থেকে ৬ সারি পর্যন্ত সেট করে কাজ করা যায়। আবার ঘুরিয়েও করা যায়। থ্রেসিং বা মাড়াই অপারেশন আলাদা করেও করা যায়। শুকনো ও উঁচু ভূমিতে ব্যবহারের জন্য হুইল টাইপ এবং জমে থাকা পানি কর্দমাক্ত জমিতে ব্যবহারের জন্য ক্রোলার টাইপ ব্যবহার হয়। শস্যকে ট্রান্সমিশন চেনের মাধ্যমে মাড়াই ড্রামে পৌঁছায়। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার ৪ সিলিন্ডারের। ৪৮ থেকে ৭৫ অশ্ব ক্ষমতা (হর্স পাওয়ার)। প্রতি মিনিটে ২ হাজার ৮শ’ বার ঘূর্ণনের এই ইঞ্জিন ডিজেলে চালিত। যন্ত্র চালাতে প্রতি ঘণ্টায় ৬.৫ লিটার থেকে ৭ লিটার ডিজেলের প্রয়োজন। ঘণ্টায় এক একর জমির ধান ও গম কাটাই মাড়াই বাছাই ঝাড়াই ও বস্তায় ভরানো যায়। এই হারভেস্টরে ট্রাক্টরের একটি কম্পোনেন্ট আছে। হারভেস্টিং শেষে চাষ দেয়ার কাজও করা যায়। ট্রাক্টর মাউন্টেড হারভেস্টরের ইঞ্জিন বাড়তি পাওয়ার হিসেবে কাজ করে। যন্ত্র চালাতে একজন মেকানিক্স সহ মাত্র তিন জন শ্রমিক দরকার। বগুড়া অঞ্চলে হেড ফিড অপারেশনের ক্রোলার টাইপ কম্বাইন্ড হার্ভেস্টার অধিক গ্রহণযোগ্য হয়েছে। মাড়াইয়ের পর খড় লম্বা থাকে। শুকনো কর্দমাক্ত ও জলাবদ্ধ জমিতে ব্যবহার করা যায়। ক্রোলার টাইপ হওয়ায় অল্প পরিসরে বাঁক (টার্ন) নিতে পারে এবং আইলের ওপর দিয়েও চলতে পারে। কোন হারভেস্টরের সঙ্গে ট্রলি আছে। ট্রলিতে বস্তা বোঝাই করে একেবারে কৃষকের আঙিনায় পৌঁছে দিচ্ছেন। এই যন্ত্রে কৃষকের কামলা খরচ অনেক কমেছে। গ্রামের কিষাণীদের ধান ঝাড়াই করার জন্য শ্রম দিতেও হয় না। চালকল মালিক মোস্তাফিজার রহমান বললেন, চাতালের কাজও দ্রত করতে পারছেন। আগে যে চাতালে মাঠ থেকে ধান আসতে সময় লাগতো ১৫/১৬ দিন তা এখন ২/৩ দিনের মধ্যে চলে আসে। যন্ত্রপাতির ব্যবহার এতটাই বেড়েছে যে কৃষক দ্রুত কাজ সেরে বাড়তি সময়ে বাড়তি অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে পাচ্ছে। প্রতিটি এলাকায় আধুনিক যন্ত্র কৃষির ছোঁয়া পড়েছে।
×