ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রোজগারবিহীন তারেক রহমানের লন্ডনে বিলাসী জীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১০ অক্টোবর ২০১৮

রোজগারবিহীন তারেক রহমানের লন্ডনে বিলাসী জীবন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্যক্তিগত রোজগার না থাকলেও লন্ডনে পরিবার নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছেন একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মত ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাস্টারমাইন্ড বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান। প্রতিমাসে খরচ করেন বাংলাদেশী মুদ্রায় অন্তত পাঁচ লাখ টাকা। ব্যবহার করেন দুইটি বিলাসবহুল গাড়ি। বাজার করেন অভিজাত বিপণী বিতানগুলো থেকে। এমন বিলাসী জীবনযাপন নিয়ে দেশে বিদেশে এবং দলের ভেতরে বাইরে রীতিমত আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। বিলাসী জীবন যাপনে ব্যয় হওয়া টাকার অধিকাংশ অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে পাচার করা বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য তারেক রহমানের যাবতীয় সম্পদ, আয় ও ব্যয় হওয়া অর্থের উৎস সম্পর্কে তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক জরুরী সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারেক রহমানের ব্যক্তিগত সম্পদের বিষয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুদক অত্যন্ত কঠোর গোপনীয়তার মধ্যদিয়ে তারেক রহমানের সম্পদ, আয় ও ব্যয় হওয়া অর্থের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন বিষয়টি অনুসন্ধানের দায়িত্ব পালন করেছেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ। সম্প্রতি তিনি অবসরে যাওয়ায় নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে দুদক। নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে আগের তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মো. হারুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্তে অনেক বিষয়ের সত্যতা মিলেছে। তবে সেই সব বিষয়গুলো কি কি তদন্তের স্বার্থে তা তিনি প্রকাশ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। তারেক রহমানের সম্পদ ও আয় ব্যয়ের তদন্তের বিষয়ে দুদকের বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ ব্যাপারে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রবণ কুমার সাহাও কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র বলছে, যেখানে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে লন্ডনেই হোটেলের ম্যানেজার, উগান্ডার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনকে সৌদি আরবে ঝাড়ুদার, ইরানের নেতা রেজা শাহ পাহলবীকে প্রচ- অর্থকষ্টে জীবন যাপন করতে হয়েছিল, সেখানে বিনা রোজগারে তারেক রহমান বিলাসী জীবন যাপন করছেন। বিষয়টি রীতিমত আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, খোদ যুক্তরাজ্যেও বিষয়টি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা সমালোচনা। তারেক রহমানের বিলাসী জীবন যাপনের জন্য ব্যয় হওয়া অর্থ কিভাবে কোথা থেকে আসছে তা নিয়ে খোদ যুক্তরাজ্যেও ব্যাপক গুঞ্জন আছে। যুক্তরাজ্য সরকার, দেশটির একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা ও বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও বিষয়টির তদন্ত করে যাচ্ছে। যুক্তরাজ্যে অনেকটা প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়ান তারেক রহমান। প্রকাশ্যে ঘোরাফেরার কারণেই তারেক রহমানের বিলাসী জীবনযাপন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। শুধু যে মানুষের মুখে মুখে তাই নয়, রীতিমত গণমাধ্যমেও প্রকাশ পেয়েছে তারেক রহমানের বিলাসী জীবনযাপনের নানা কাহিনী। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক জনমত ম্যাগাজিনের ৪৬ সংখ্যায় প্রকাশিত এক বিশেষ প্রতিবেদনে তারেক রহমানের বিলাসী জীবনযাপন সম্পর্কে নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে মোট ২৫ মামলা ঝুলছে। ২০০৭ সালে এসব মামলা দায়ের হয়। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৪ মামলা আছে। এরমধ্যে ২০০৯ সালে একটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে তেরটি মামলা ঝুলছে। ১৩ মামলার ফেরারি আসামে হয়েও তারেক রহমান লন্ডনে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এরমধ্যে চারটি মামলা উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। বাকি নয়টি মামলা চলমান আছে। যার মধ্যে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা অন্যতম। সংশ্লিষ্ট ওই সূত্রে আরও জানা গেছে, জীবনে আর রাজনীতি না করার মুচলেকা দিয়ে তারেক রহমান চিকিৎসা সেবা নিতে প্যারোলে মুক্তি পান। ২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান। চিকিৎসা নিতে থাকেন লন্ডনের ওয়েলিংটন হসপিটালে। সেই থেকে বসবাস শুরু করেন লন্ডনেই। এদিকে বিভিন্ন মামলার শুনানিতে আদালতে উপস্থিত না থাকার কারণে আদালত তারেক রহমানকে পলাতক বিবেচনা করে তার জামিন বাতিল করে। সেই মোতাবেক তারেক রহমান পলাতক আসামি। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার পলাতক আসামি হিসেবে তারেক রহমানকে গ্রেফতার করতে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইন্টারপোলে বার্তা পাঠায় বাংলাদেশ পুলিশ। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল তারেক রহমানকে ধরিয়ে দিতে রেড নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ ইন্টারপোল কর্তৃপক্ষ রেড নোটিশের তালিকা থেকে তারেক রহমানের নাম প্রত্যাহার করে নেয়। বাংলাদেশ সরকারের আইনমন্ত্রী বিশিষ্ট ফৌজদারী আইন বিশেষজ্ঞ এ্যাডভোকেট আনিসুল হক ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই। এজন্য তারেক রহমানকে ফেরত আনতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চলছে। শুধু তারেক রহমান নয়, এুকশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিদেশে পলাতক ১৮ আসামিকেই ফেরত আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে। সূত্রটি বলছে, তারেক রহমান লন্ডনে যাওয়ার পর থেকেই এনফিল্ড টাউন ও সাউথ গেট এলাকার মাঝামাঝি অবস্থিত যুক্তরাজ্য বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতার কেনা একটি বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে দীর্ঘ সময় বসবাসের সুযোগ করে নেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। এজন্য তিনি ২০০৮ সালেই লন্ডন থেকে বার এট ল ডিগ্রী (ব্যারিস্টার) সম্পাদনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তারেক রহমান বাংলাদেশী গ্র্যাজুয়েট হওয়ায় বিপত্তি দেখা দেয়। ব্রিটেনের নিয়মানুযায়ী তাকে প্রথমেই লন্ডনের কোন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। তিনি ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জন করতে ব্যর্থ হন। এক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক সুবিধাও পাননি তিনি। এরপর তিনি সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটি এবং কুইন মেরী ইউনিভার্সিটিতে ব্যাচেলর ডিগ্রী ছাড়াই বার এট ল করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তারেক রহমানকে সরাসরি ফিরিয়ে দেয়। এরপর থেকে অনেকটা স্থায়ীভাবেই উক্ত বাড়িতেই বসবাস শুরু করেন তিনি। বাড়িটি ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে উল্লেখিত বিএনপি নেতা কিনেন। এক সময় বাড়িটির মাসিক মর্টগেজ হিসেবে ৩৩৫ পাউন্ড দিতে হতো সেদেশের সরকারকে। তা কমে ২২০ পাউন্ডে ঠেকেছে। বাড়িতে থাকলেও মর্টগেজের টাকাও তারেক রহমান দেন না। লন্ডনে যাওয়ার পর আলোচ্য বিএনপি নেতা তার ব্যক্তিগত জাগুয়ার গাড়িটি তারেক রহমানকে দেন। মাসিক ৮শ’ পাউন্ড বেতনে গাড়িটির চালক হিসেবে নিয়োগ পান শরীফুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। পরে তারেক রহমান ক্যাব্রিজ হিথ রোড থেকে দুটি বিলাসবহুল গাড়ি কিনেন। এর মধ্যে একটি বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের। অপরটি অডি। তারেক রহমান নিজের গাড়িতে করে প্রায়ই মেয়ে জাইমা রহমানকে স্কুল থেকে আনার জন্য গাড়ির চালকের সঙ্গে স্কুলে যেতেন। মাঝে মধ্যে তিনি পরিবার নিয়ে বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা করতেন পন্ডার্স এ্যান্ডের টেসকো দোকান থেকে। কেনাকাটায় সহায়তা করতেন আলোচ্য বিএনপি নেতার রেস্টুরেন্টের কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। প্রায় প্রতিদিনই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আসত তারেক রহমানের পরিবারের জন্য। প্রতিমাসে লেক সাইড ও ব্লু ওয়াটার এবং সেন্ট্রাল লন্ডনের সেলফ্রিজেস থেকে শপিং করতেন। এছাড়া সেলফ্রিজেসের হোম এক্সেসরিজেও যেতেন। সেলফ্রিজ ও ব্লু ওয়াটার যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে বিলাসবহুল এবং ব্যয়বহুল শপিং মল। ব্রিটেনের ধনীরাই সাধারণত সেখানে কেনাকাটা করে থাকেন। এছাড়া তারেক রহমান প্রায়ই সপরিবারে উডগ্রিন সিনে ওয়ার্ল্ডে সিনেমা দেখতেন। মাঝেমধ্যে আপ্টন পার্কের বলিনেও সিনেমা দেখতেন। তিনি লন্ডন বিএনপির নেতার মেয়ের বিয়েতে হাজির হয়েছিলেন। সেখানে তাকে ছড়ি হাতে দেখা গিয়েছিল। উল্লেখিত বিএনপি নেতা অবশ্য মারা গেছেন। তিনি এখন বসবাস করছেন লন্ডনের কিংসটনে। এ এলাকার ৩/৪ বেডরুমের বাসার মাসিক ভাড়া ১২শ’ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। সি ব্যান্ডের বাসার জন্য কাউন্সিল ট্যাক্স ১৪৭৪ পাউন্ড ৬৭ পেন্স। বিদ্যুত গ্যাসসহ ইউটিলিটি বিল ন্যূনতম ১৫০ পাউন্ড। পরিবারের যাতায়াত খরচ ন্যূনতম একশ পাউন্ড। এছাড়া লন্ড্রি, পোশাক, সংবাদপত্র, মোবাইল ও টেলিফোন বিলসহ আরও ন্যূনতম ৭ থেকে ৮শ’ পাউন্ড খরচ আছে। সব মিলিয়ে ন্যূনতম ৪ হাজার পাউন্ড খরচ রয়েছে তারেক রহমানের। বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ে তিনি কোন অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত নন। স্ত্রী ডা. জুবাইদা গুলশান আরাও কিছু করেন না। উপরন্তু মেয়ে জাইমা লন্ডনে পড়াশোনা করছে। সাধারণত বাইরে বের না হলেও মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য প্রায়ই চালকের সঙ্গে বাইরে যান। সূত্রটি বলছে, তারেক রহমান ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। বাংলাদেশে তারেক রহমান ও তার মা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকটি ব্যাংক এ্যাকাউন্ট জব্দ করা আছে। সে সুবাদে তারেক রহমানের একমাত্র বৈধ রোজগার হিসেবে তাঁর মা খালেদা জিয়ার সংসদের বেতন। বেতনের টাকা দিয়ে তারেক রহমানের এমন বিলাসী জীবন যাপনের জন্য ব্যয় হওয়া একাংশও মেটানো সম্ভব নয়। তারপরেও তারেক রহমানের বিলাসী জীবনযাপন করে যাচ্ছেন। যা রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার। গোয়েন্দা সূত্রে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সহযোগিতায় সিঙ্গাপুরে ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাচার করা হয়েছে। যা পরবর্তীতে তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সেই টাকা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে ফেরত আনা হয়েছে। এছাড়া তারেক রহমানের বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে ৬ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা পাচার করার অভিযোগ রয়েছে। বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের অভিযোগে তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ঢাকার বিশেষ আদালতে তথ্য প্রমাণ দাখিল ও সাক্ষীদের জবানবন্দীর ভিত্তিতে চার্জ গঠন করা হয়েছে।
×