ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী উদ্যোগ ॥ কমিউনিটি ক্লিনিক

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৯ অক্টোবর ২০১৮

প্রধানমন্ত্রীর যুগান্তকারী উদ্যোগ ॥ কমিউনিটি ক্লিনিক

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং মেডিক্যাল শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে স্থাপিত কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার চিন্তাপ্রসূত একটি যুগান্তরী প্রবর্তন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরপরই তৃণমূল মানুষের চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প, যার সুফল বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ভোগ করছে। বলা যায়, শহরের মানুষের চেয়ে গ্রামের মানুষ অধিকতর সুস্থ জীবনযাপন করছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক শেখ হাসিনা সরকারের সাফল্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ও অনুকরণীয়। জনমুখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে গৃহীত হয়, যা বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগণের জন্য একটি করে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৮-২০০১-এর মধ্যে ১০ হাজারের অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছিল, যার সুফল জনগণ পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জনগণের অতি প্রয়োজনীয় এ সুবিধা বন্ধ করে দেয় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। গ্রামীণ জনগণ ২০০৮ সাল পর্যন্ত দোরগোড়ার এ স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। উপর্যুপরি ক্লিনিকগুলো পরিণত হয় অসামাজিক কার্যকলাপ এবং পশু পালনের কেন্দ্র হিসেবে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার বিপুল ভোটে জাতীয় নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পর কমিউনিটি ক্লিনিক পুনঃরুজ্জীবিতকরণ কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম ৪র্থ সেক্টর কর্মসূচীর (ঐচঘঝচ) এর আওতায় ঈড়সসঁহরঃু ইধংবফ ঐবধষঃয ঈধৎব (ঈইঐঈ) অপারেশনাল প্লানের মাধ্যমে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কার্যক্রম হিসেবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) এক অনন্য দৃষ্টান্ত। সকল ক্লিনিক গড়ে উঠেছে জনগণের দান করা জমিতে। ১৯৯৬-এ যখন এ কার্যক্রম শুরু হয় তখন জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দেয়। জমি প্রদানের জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অনেকে জমি না দিতে পেরে মনোকষ্টে ভুগতে থাকে। সরকার ভবন নির্মাণ, সেবাদানকারী নিয়োগ, প্রয়োজনীয় যাবতীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহ করছে। সরকার ও জনগণ সম্মিলিতভাবে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা করছে। প্রতিটি ক্লিনিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে অনলাইনে রিপোর্টিং করা হয়। সেবাসমূহ : স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিনির্ভর নি¤œলিখিত সেবাকার্যক্রম কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রদান করা হয়। ১. মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতক স্বাস্থ্যসেবা। ২. অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা। ৩. প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা। ৪. টিকাদান কর্মসূচী। ৫. পুষ্টি শিক্ষা ও অনুপুষ্টি সরবরাহ। ৬. স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিষয় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও কাউন্সেলিং। ৭. বয়স্ক ও কিশোর-কিশোরীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান। ৮. শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের শনাক্ত ও রেফার করা। ৯. বিভিন্ন অসংক্রামিত রোগ শনাক্তকরণ ও উচ্চতর সেবাকেন্দ্রে রেফারেল (ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার ইত্যাদি)। ১০. সীমিত নিরাময় সেবা ও সাধারণ আঘাত ও জখমের ব্যবস্থাপনা। ১১. জরুরী ও জটিল রোগী চিহ্নিত করে উন্নত চিকিৎসার জন্য উচ্চতর সেবা কেন্দ্রে রেফার করা। ব্যবস্থাপনা : প্রতিটি ক্লিনিকে একজন করে নিয়োগকৃত প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী (সিএইচসিপি), যারা প্রতিদিন (শুক্র ও শনিবার বাদে) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য সহকারী (ঐঅ) ও পরিবার কল্যাণ সহকারী (ঋডঅ) সপ্তাহে তিন দিন সেবাদানকারীকে সহযোগিতা করেন। স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনার লক্ষ্যে কর্মরত সকল মহিলা সেবাদানকারীকে (ঈঐঈচ) পর্যায়ক্রমে ৬ মাসব্যাপী ঈড়সসঁহরঃু ঝশরষষবফ ইরৎঃয অঃঃবহফধহঃ (ঈঝইঅ) প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১৯৩৫ জন মহিলাকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। পরিচালনা : প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ নিয়ে ১৩-১৭ সদস্য বিশিষ্ট (এর মধ্যে অন্তত ৪ জন মহিলা) একটি কমিউনিটি গ্রুপ (সিজি) আছে। ক্লিনিক পরিচালনা ও জনগনকে ক্লিনিক হতে সেবা গ্রহণে উদ্বুদ্ধকরণে প্রতিটি কমিউনিটি গ্রুপকে সহযোগিতার জন্য ১৩-১৭ সদস্য বিশিষ্ট ৩টি সাপোর্ট গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। গ্রুপগুলো সমাজের সব স্তর থেকে প্রতিনিধি নিয়ে গঠন করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, জমিপ্রদানকারী, মহিলা, ভূমিহীন, কিশোর-কিশোরী। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ (ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ) কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে। জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও এনজিওসমূহ (বিশ^ব্যাংক, জাইকা, ইউনিসেফ ইত্যাদি) আর্থিক, কারিগরি ও লজিস্টিক সরবরাহের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে। কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্ট আইন-২০১৮ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে যাতে কমিউনিটি ক্লিনিক সঠিকভাবে পরিচালিত হতে পারে, সেজন্য মহান জাতীয় সংসদে কমিউনিটি ক্লিনিক সংসদে ট্রাস্ট আইন-২০১৮ অনুমোদিত হয়েছে। এতে ক্লিনিকের কার্যক্রম পরিচালনা এবং জনবলের বেতন-ভাতাতিসহ আর্থিক ব্যয়ভার নিশ্চিত করার জন্য অর্থ সংগ্রহের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রাপ্ত সুবিধাসমূহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও অসহায়/নাজুক (মা ও শিশু, কিশোর-কিশোরী, বয়োবৃদ্ধ নাগরিক) মানুষ, যারা ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত ছিল, তারা তাদের দোরগোড়ায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে মানসম্মত প্রাথমিক স¦াস্থ্যসেবা পাচ্ছে। ১. ২০০৯ হতে আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক হতে ৭৭.৫৫ কোটি ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সেবা গ্রহণ করেছেন। ২. ৩.৬৯ কোটি জরুরী ও জটিল রোগী উন্নত ব্যবস্থাপনার জন্য উচ্চতর চিকিৎসা কেন্দ্রে রেফার করা হয়েছে। ৩. প্রতি মাসে গড়ে ১ কোটি ভিজিটের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকে জনগণ সেবা গ্রহণ করে। ৪. প্রতিদিন প্রতি ক্লিনিকে গড়ে ৪০-৪২ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে। ৫. রোগীদের শতকরা ৮০ ভাগ নারী ও শিশু। ৬. সারাদেশে ৩০৫৮টি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব পরিচালিত হচ্ছে এবং ২০০৯ হতে এ পর্যন্ত কোন রকম জটিলতা ছাড়াই ৬৫৯১৯টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। ৭. সকল ক্লিনিকে মাসে একবার মহিলা ও শিশুদের টিকা দেয়া হয়। ৮. প্রতিটি ক্লিনিকে ৩০ রকমের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। প্রতি বছর প্রায় ২০০ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। মোট কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৪,৮৯০টি। তার মধ্যে বর্তমানে ১৩,৭০০টি চালু আছে, যা লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৯০ ভাগ। কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম এমডিজি-অর্জনে বিশেষ করে এমডিজি ৪ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং এসডিজি অর্জনেও (এসডিজি-৩ : সব বয়সের সবার জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ) ভূমিকা রাখবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, যেসব মানুষ এ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা গ্রহণ করছেন, তাদের মধ্যে ৮০%-৯৮% মানুষই সেবার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ট্রাস্ট আইনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের আরও উন্নয়ন ও কার্যকর করার জন্য নি¤œলিখিত সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দরকার- ১. কমিউনিটি গ্রুপ ও সাপোর্টিং গ্রুপ ক্লিনিকের কর্মকা-ে নিয়মিত সহযোগিতা ও পরিদর্শন করবেন। ২. মনিটরিং ও সুপারভিশন : উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স/ ইউনিয়ন চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসকদের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে টেকনিক্যাল সুপারভিশন ও মনিটরিং করতে হবে। ৩. ক্লিনিকের কার্যক্রম যেন কখনও বিঘিœত না হয় সে বিষয়ে স্থানীয় জনগণকে সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সঠিক সেবাদানের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নিশ্চিতভাবেই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। তখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং উৎপাদনে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×