ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

ব্রেটন উডসের কথা

প্রকাশিত: ০৪:৪৭, ৮ অক্টোবর ২০১৮

ব্রেটন উডসের কথা

এই বছরের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য নিউ হাম্পশায়ারের ব্রেটন উডসে গিয়েছিলাম। নিউ হাম্পশায়ারের উত্তর-পূর্ব দিকে আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় লাগোয়া শৈলাবাস ব্রেটন উডস শহর। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে ব্রেটন উডস আমার ও আমার স্ত্রী সিতারার মনে গুরুত্বের মাপকাঠিতে সেঁটে থাকা এক শহর। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হওয়ার পথে এখানে যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বাণিজ্যরত দেশসমূহের আর্থিক লেনদেনের প্রক্রিয়া নির্দিষ্টকরণ ও সহায়তা প্রদান এবং অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়ন অর্থায়ন নিশ্চিত করার বহুজাতিক কাঠামো নির্ধারণের লক্ষ্যে অর্থনীতিবিদদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয় এই শহরে। এই সম্মেলনে যুক্তরাজ্য থেকে যোগ দেন সে শতাব্দীর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন সে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থ ব্যবহারজীবী হ্যারি ডেস্কটার হোয়াইট। এই সম্মেলনে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং পুনর্নির্মাণ ও উন্নয়নের আন্তর্জাতিক ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠাকরণের চুক্তি স্থাপিত হয়। ঐকমত্যভিত্তিক এই চুক্তিই তখন থেকে ব্রেটন উডস চুক্তি নামে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করে। যুদ্ধোত্তর নতুন পৃথিবীর আর্থিক পরিচালনা ও উন্নয়নের তীর্থ স্থান হিসেবে এই প্রেক্ষিতে প্রায় সব অর্থনীতিবিদের কাছে স্বীকৃতি পায় ব্রেটন উডস। ব্রেটন উডস সম্মেলনে ৪৪টি দেশের মোট ৭৩০ জন প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১-১২ জুলাই ১৯৪৪-এ ব্রেটন উডস শহরের মাউন্ট ওয়াশিংটন হোটেলের সম্মেলনের জন্য সজ্জিত স্বর্ণ কক্ষে। আমি, স্ত্রী সিতারা, ছেলে জয়, বউমা হিমি, আমাদের নাতি অনিম ও অর্ন এবং নাতনি অড়িকে নিয়ে এই ঐতিহাসিক হোটেলেই উঠি আমরা। ১৯০২ সালে নির্মিত এই হোটেলটি বিশাল, কয়েক তলা মিলে এর ১০০০ অতিথি কক্ষ এবং নিচতলার চারদিকেই প্রশস্ত বারান্দা। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমতলে নেমে যাওয়া সবুজ ঘাসে মোড়া লন, হাঁটার আঁকা-বাঁকা পথ আর তার মাঝখানে বসানো বিশাল সুইমিং পুল। এটি এখন পরিচালনা করেন প্রখ্যাত হোটেল ব্যবস্থাপনা গ্রুপ অমনি। অদূরে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রকৌশলীয় অর্জনের এক নিদর্শন-খাড়া পাহাড়ী পথ ধরে ওঠা-নামার মাউন্ট ওয়াশিংটন কগ রেলপথ। হোটেলের সেবাযত্ন ও সুযোগ-সুবিধা উচ্চতম মানের। আমরা এখানে থেকে বুঝেছি কেন এই হোটেলকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর আর্থিক পরিচালন, পুনর্গঠন ও উন্নয়নের বিষয়ে সেই সম্মেলনের স্থান বলে নির্বাচিত করা হয়েছিল। ব্রেটন উডস চুক্তির তাত্ত্বিক সূচনা যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মধ্যে ১৯৪১-এ গৃহীত আটলান্টিক চার্টার থেকে উৎসারিত হয়েছিল। এই চার্টারে হিটলারীয় জার্মানির অযৌক্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিকূলে সকল দেশের বাণিজ্য প্রসারণ ও কাঁচামাল আহরণে সমতাভিত্তিক প্রবেশাধিকার স্বীকৃত হয়েছিল। একে ভিত্তি করে সময়ান্তরিক আলোচনার ভিত্তিতে ব্রেটন উডস সম্মেলনে প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যারি ডেকসটার হোয়াইট ও ব্রিটিশ অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি ১৯৩০-এর দশকের পৃথিবীব্যাপী মন্দা কাটানো এবং কর্মসংস্থান প্রসারণ তত্ত্বের প্রবক্তা অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের মধ্যে আলোচনার আলোকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং পুনর্গঠন ও উন্নয়নের আন্তর্জাতিক ব্যাংক (আইবিআরডি বা পরবর্তীকালের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক) প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্য দেশসমূহের মধ্যে ফ্রান্স ও জাপান এই সম্মেলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেও প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন এই সম্মেলনে। ইউরোপ ও এশিয়ায় আমাদের অর্থনীতির পাঠনায় কেইনস ছিলেন সম্ভবত সবচেয়ে পরিচিত নাম। হোয়াইট অর্থনীতির ওপর তেমন কিছু লেখেননি, তবে ব্যবহারবিদ হিসেবে আটলান্টিকের ওপারে প্রসিদ্ধি ছিল তার। হোটেলের ছড়ানো বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে এবং ডেক চেয়ারে কফির কাপ সামনে নিয়ে বসে থেকে মনে আসছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এবং এতে এই দুই কালজয়ী অর্থনীতিবিদদের ভূমিকার কথা। এই হোটেলের স্বর্ণ কক্ষে (সম্মেলন কক্ষের ওই ছিল নাম) আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার চুক্তি মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের ঐকমত্যের ভিত্তিতে স্থাপিত হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বিষয়ক চুক্তি অনুযায়ী এই সংস্থার প্রাথমিক ২৯ সদস্য দেশের (সমকালীন সদস্য দেশ সংখ্যা ১৮৯) মধ্যে বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেন নির্বাহ করার সূত্রাদি গৃহীত হয়। এসব সূত্র মূলত যুক্তরাষ্ট্রের তরফ হতে হোয়াইট কর্তৃক প্রস্তাবিত হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে বাণিজ্যরত সকল সদস্য দেশ তাদের মুদ্রার বিনিময় হার স্বর্ণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে স্বর্ণের সঙ্গে নির্ধারিত মানের ১%-এর মধ্যে তাদের স্ব-স্ব মুদ্রার মূল্য সংরক্ষণ করার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং আইএমএফ এই মান অনুযায়ী বিনিময় হারভিত্তিক দেনা-পাওনার স্থিতিতে সাময়িক অসমতা কাটিয়ে ওঠানোর জন্য স্বল্পমেয়াদী ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। আইএমএফের মূলধন স্বর্ণমান অনুসারে মার্কিন ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরের সূত্র অনুযায়ী সদস্য দেশসমূহ হতে কোটা নামে আদায়ী হয়। প্রতিটি সদস্য দেশ হতে স্বর্ণ ও তাদের স্ব-স্ব মুদ্রার অবয়বে আইএমএফ-এ তাদের নির্ধারিত কোটা বা প্রস্তাবীয় মূলধনের ২৫% প্রদানীয় হয়। ২০১৬ সালের হিসাবে আইএমএফের মূলধনের পরিমাণ প্রায় ৬৬৬ বিলিয়ন ডলার। মূলধনে অবদানের অংশের মাপে এই সংস্থার পরিচালনা প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় ভোটাধিকার যুক্তরাষ্ট্রের (১৭.৬৮%)। এর পরে আছে জাপান (৬.৫৬%) ও চীন (৬.৪৯%)। আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী বাণিজ্যরত দেশসমূহ যাতে তাদের মুদ্রা পারস্পরিক অবমূল্যায়নের প্রতিযোগিতায় নেমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে অস্থির বা অসংহত না করতে পারে তার প্রতিশ্রুতি সদস্য দেশসমূহ দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্য প্রকাশ করার পর একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এই চুক্তি সই করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের অস্বীকৃতি প্রকাশ করার আগে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য প্রস্তাবিত এই সংস্থাকে নিউইয়র্কের মুদ্রাবাজার ওয়াল স্ট্রীটের প্রসারণ হিসেবে আখ্যায়িত করে। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সে সময়কার সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ তাদের মধ্যে ভিন্নতর প্রক্রিয়ার বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর এসব দেশ আইএমএফের সদস্য হয়। আইএমএফের সদর অফিস স্থাপিত হয় ওয়াশিংটনে আর এর প্রথম নির্বাহী পরিচালক হন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদ হ্যারি ডেকস্টার হোয়াইট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতার আলোকে হোয়াইটের পরে আইএমএফের নির্বাহী পরিচালক ইউরোপীয় দেশ থেকে নিযুক্ত হয়ে আসছেন। আইএমএফ প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩ দশক পরে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ডলারের অবাধে স্বর্ণে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে। ফলত ডলার আইএমএফের সংরক্ষিত বা রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে গৃহীত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশ স্বর্ণমান থেকে তাদের মুদ্রাকে রিজার্ভ এবং চাহিদা ও সরবরাহের মাপকাঠিতে অবাধে ভাসমান মুদ্রা হিসেবে রূপান্তরিত করে। প্রধানত কোটা অবয়বে প্রাপ্ত মূলধন দিয়ে আইএমএফ সদস্য বিশেষে তাদের দেনা-পাওনার স্থিতিতে সাময়িক ঘাটতি হলে তা সময়বদ্ধভাবে পূরণ করতে এগিয়ে আসে। এই প্রক্রিয়ায় তারা এরূপ ঘাটতি এড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থিক ও বাণিজ্য নীতির সংস্কার বিষয়ে পরামর্শ, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় শর্তারোপ করে। পরবর্তীকালে সংশ্লিষ্ট দেশ কর্তৃক প্রদত্ত কোটা এবং তার ব্যবহার বৈদেশিক দেনা-পাওনার স্থিতি রক্ষাকরণে অপর্যাপ্ত বিবেচিত হলে কোটার অতিরিক্ত মূলত প্রতিশ্রুতিপত্র অবয়বে বিশেষ ব্যবহার্য অধিকার বা স্পেশাল ড্রইং রাইটস প্রবর্তিত হয়। সদস্য দেশসমূহের বিশেষ গ্রহণীয় অধিকারপত্র আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারল্য বাড়ায় এবং ক্রম প্রসারিত বাণিজ্যের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হয়। মনে এলো কেমন করে এই শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে আইএমএফ তাদের অনুসরণীয় রক্ষণশীল নীতি আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে অধিকতর তারল্য সংরক্ষণের অনুকূলে ক্রমান্বয়ে শিথিল করে আসছে এবং একই সঙ্গে তার প্রাথমিক অতি মাত্রায় রক্ষণশীল পরিচালনার বৃত্তের বাইরে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পরোক্ষ সহায়তা প্রদানে প্রযুক্ত করতে চাইছে। সমকালে আইএমএফ কেবলমাত্র সদস্য দেশসমূহের বিনিময় হার নয়, এর বাইরে তাদের অর্থনৈতিক নীতিও তত্ত্বাবধান করতে এগিয়ে আসছে। হোটেলের বারান্দায় ডেক চেয়ারের কবোষ্ণ আশ্রয়ে চন্দ্রালোকিত প্রকৃতিকে সামনে রেখে মনে এসেছে ব্রেটন উডস চুক্তি অনুযায়ী আইএমএফের সঙ্গে পুনর্গঠন ও উন্নয়নের আন্তর্জাতিক ব্যাংক বা বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার কথা। যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর পুনর্বাসন ও অনুন্নত দেশসমূহের উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য মূলত কেইনসের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় এই ব্যাংক। উন্নয়ন অর্থায়নের কোমল গবাক্ষ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাও (আইডিএ) ব্রেটন উডস চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত আইবিআরডিসহযোগে পরিচিত এখনকার বিশ্বব্যাংক। এর সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফের সদর দফতরের লাগোয়া অবস্থানে (১৮০০ পেনসিলভানিয়া এ্যাভিনিউতে, ১৬০০ পেনসিলভানিয়া এ্যাভিনিউতে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হোয়াইট হাউস)। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আন্তর্জাতিক অর্থ কর্পোরেশন, বহুমাত্রিক বিনিয়োগ নিশ্চয়তা এজেন্সি ও বিনিয়োগ বিবাদ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক কেন্দ্রসহ ৫টি সংস্থাকে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ হিসেবে এখন আখ্যায়িত করা হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট প্রথাগত সমঝোতা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকেন। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দুই দশক ধরে বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল ও পুনর্গঠনীয় দেশসমূহে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আপেক্ষিকভাবে রক্ষণশীল ঋণ সহায়তা দেয়। ১৯৬৮ থেকে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারার নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক আন্তর্জাতিক বন্ড বাজার থেকে অধিকতর মূলধন আহরণ করে অবকাঠামো নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনকে কোমল সুদভিত্তিক বিনিয়োগের দ্বিতীয় প্রধান লক্ষ্য হিসেবে প্রযুক্ত করে আসছে। আন্তর্জাতিক বন্ড বাজার থেকে মূলধন আহরণে কুশলী হিসেবে ভূমিকা রাখেন বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ ইউজিন রটবার্গ। পরে এই ধারণাকে ধারণ ও প্রসারণ করে বিত্তশালী দেশসমূহের অনুদান নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ঋণ সহায়তার কোমল গবাক্ষ-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। মনে এলো ১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এর সঙ্গে একযোগ হয়ে বিশ্বব্যাংক দরিদ্র পৃথিবীর উন্নয়নের কার্যক্রম হিসেবে বাজার উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ ও সরকারের আকার কমানোকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ওয়াশিংটন ঐকমত্য জাহির করে। এর পরে এই শতাব্দীর শুরু থেকে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিচয়ের সমর্থন করে বিশ্বব্যাংক ১. দারিদ্র্য ও ক্ষুধা থেকে মুক্তি, ২. বিশ্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার, ৩. লিঙ্গ সমতা প্রসারণ, ৪. শিশু মৃত্যুর হার কমানো, ৫, মাতৃ স্বাস্থ্য উন্নয়ন, ৬. ম্যালেরিয়া, এইডস ইত্যাদি মরণব্যাধি নিরোধ, ৭. পরিবেশের টেকসই এবং ৮. উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব প্রসারণকল্পে কোমল সুদভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ প্রযুক্ত করে আসছে। সমকালে আইবিআরডির সদস্য সংখ্যা ১৮৯ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সমিতির সদস্য সংখ্যা ১৭৩। বিশ্বব্যাংকের সদস্য দেশসমূহ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও সদস্য পদধারী। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তায়ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তীয় ভোট-ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের (১৫.৮৫%)। এর পরে আছে জাপানের (৬.৮৪%) ও চীনের (৪.৪২%) ভোটাধিকার। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের অবস্থান তাদের পরে (৩.৭৫%)। সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাংকে উন্নয়নশীল দেশের ভোট-ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে গর্বের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে, বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে অন্যান্যের মধ্যে সময়ান্তরে ভূমিকা পালন করেছেন প্রখ্যাত হলিস চেনারী, এন ক্রয়েগার, লরেন্স সামার্স, যোশেফ স্টিগলিটজ, মাইকেল ব্রুনো ও ভারতের কৌশিক বসু। আমি ও সিতারা নিশ্চিত একমাত্র ক্রয়েগার ছাড়া এদের কাজ বিশ্বব্যাংকের ভূমিকায় রক্ষণশীলতা কাটিয়ে ইতিবাচক কোমলতা এনেছে। ক্রয়েগারের মতে বিশ্বব্যাংক প্রথাগত রক্ষণশীল ঋণ সঞ্চালনের বাইরে পদক্ষেপ নিলে তা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার অনুকূলে হতে পারে না। তার প্রতিক্রিয়াশীল মতে উন্নয়নগামী দেশসমূহ উন্নত দেশ হতে ভাড়া প্রাপ্তির প্রত্যাশী। ক্ষোভের সঙ্গে আমি ও সিতারা মনে করেছি যে, ২০১২ সালে ব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট জুয়েলিক একচ্ছত্রিক অহমিকায় মিথ্যা অজুহাতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক এদেশের পদ্মা সেতুর নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে মনে এসেছে বিশ্বব্যাংকের একচ্ছত্র ভূমিকা সীমিত এবং এই প্রক্রিয়ায় শাণিত করতে সাম্প্রতিককালে এগিয়ে এসেছে আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং এশীয় অবকাঠামো অর্থায়ন ব্যাংক। বাংলাদেশসহ অন্যান্য উন্নয়নকামী দেশ তাদের উন্নয়ন অর্থায়নে এসব নবপ্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের অর্থায়ন স্বাগত জানায়। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ক্রমান্বয়ে হয়েছে দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার জন্য কতিপয় বিত্তশালী দেশের উন্নয়ন তহবিল। এদের মধ্যে অনুন্নত দেশসমূহে কোমল সহায়তা বিস্তারণে এগিয়ে এসেছে সুইডেন, কানাডা, জাপান, সৌদি আরব, কুয়েত, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও অস্ট্রেলিয়া। আমাদের বিশ্বাস, এসব দেশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন তহবিল ওই সব আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকসহ পৃথিবীব্যাপী অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের উন্নয়ন কার্যক্রম এবং অর্থায়নকে সর্বজনীন করতে এগিয়ে আসলে বিশ্বব্যাংক তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন অর্থায়নে একচ্ছত্র অবস্থান নিতে আগের মতো অগ্রণী বা সক্ষম থাকবে না। দু’দিন গভীর রাত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বব্যাংকের স্থাপন ও পরিচালনা বিষয়ে বিশদ ভাবনা এবং আলোচনার পর পৃথিবীর বাণিজ্যিক প্রসারণ ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মানব সৃষ্ট এই সব সংস্থার ভূমিকা আমাদের উন্নয়ন-প্রত্যয় বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ক্রম প্রসারণশীল আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যের ফলপ্রসূতা থেকে সরে আসা, কেবল পারস্পরিক স্বার্থসংরক্ষণে বিত্তশীল থেকে বিত্তস্বল্প দেশকে সহায়তা দেয়া, শুল্কের যুদ্ধে নেমে যাওয়া, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, এমনকি জাতিসংঘ থেকে সড়ে আসার পাঁয়তারা আমাদের সকলের জন্য অশনি সঙ্কেত বলে মনে হয়েছে। এই পেছনে চলার প্রেক্ষার পটে আমাদের প্রতীতি এসেছে যে, আমরা পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্য প্রসার করে, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে সকলের অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে এগিয়ে যেতে পারি প্রবৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে। এভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথে তখনকার সময়ে বাতিঘর হিসেবে অবদান রেখেছেন অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস ও হ্যারি ডেকস্টার হোয়াইট। শ্রদ্ধাভরে স্বীকৃতি জানিয়েছি তাদের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও দূরদর্শিতার। দু’দিন দু’রাতের পর ভোরে সূর্য ওঠার সময় ধরে বিছানা ছাড়তে পারিনি। হোটেল কক্ষের দরজায় কিশলয়সম অনিম আর অড়ির করাঘাতে ফিরে এসেছি সজাগ বাস্তবের পরিমন্ডলে। এখনও ঘুমিয়ে তোমরা- ওঠো ওঠো এবার- নতুন প্রজন্মের এই ডাকে অর্থনীতির কয়েক যুগের অনুশীলনকার হয়েও মনে করেছি রবার্ট ফ্রস্টের অবিস্মরণীয় সেই পঙ্ক্তি : চিরতরে ঘুমানোর আগে যেতে হবে অনেক দূর- মাইলের পর মাইল। এখনকার আইএমএফকে আরও এগিয়ে আসতে হবে পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্য প্রসারণে প্রয়োজনীয় তারল্য বাড়ানো, মূলধনের প্রবাহ দেশসমূহের সীমান্তবিহীনতায় মুক্ত করা এবং এর ব্যবস্থাপনায় তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠের অধিকতর সোচ্চারণে। তেমনি বিশ্বব্যাংকের ক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের জন্য অধিকতর কোমল ও দীর্ঘমেয়াদী ঋণ প্রবাহ বাড়িয়ে, শ্রম এবং প্রযুক্তিকে সীমান্তবিহীন করে সব দেশের বিবর্তন ও উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসেবে প্রযুক্ত করে এবং বিশ্বব্যাপী উৎপাদনশীলতাকে উদ্ভাবনশীলতার মুক্ত কাঠামোয় ঝুঁকি মূলধনের সরবরাহ ছড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ব্রেটন উডস চুক্তি ও ঐ চুক্তিভিত্তিক সমঝোতার আলোকে বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থাকে তখনকার জ্ঞানভিত্তিক সচলতা দিয়েছিলেন কেইনস ও হোয়াইট। কুণ্ঠাবিহীন রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। সমকালীন অর্থনীতির জ্ঞান, অনুশীলন ও অভিজ্ঞান নিয়ে, মুক্ত সৃজনশীলতা নিয়ে অগ্রণী হতে হবে তাই এই শতাব্দীর কৃতবিদ্য অর্থনীতিবিদদের দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের। ব্রেটন উডস চুক্তি যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর অন্তর্ভুক্তীয় সংহতি ও প্রবৃদ্ধির পথ দেখিয়েছে, পথের শেষ টানেনি। তাই বিশ্বব্যাপী সংহতি, প্রবৃদ্ধি ও সহযোগিতা বাড়ানোর পথে অর্থনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়কদের ভাবতে হবে ও বৈষম্য-বিভেদকে দূরে সরিয়ে মার্টিন লুথার কিং-এর আহ্বান অনুযায়ী এগুতে হবে, বিশ্বাসে অবিচলতা এনে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে হবে- আমরা করব জয়। লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×