ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

যাহিদ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৭ অক্টোবর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গতকালের পর) পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমাদ সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনার শুরুতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমাদ আমাদের বলেন যে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃক পরাজিত নির্মূল করার সবচেয়ে বেশি ধারালা অস্ত্র হবে সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সংহতি ও ইস্পাত কঠিন ঐক্য বজায় রাখা। প্রতিরক্ষা সচিব তার সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য সময় চাইলে অন্য দু’জন মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপের পরবর্তী সপ্তাহে সময় দেয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতকারের জন্য নির্ধারিত তারিখ ও সময়ের কথা যখন আমাকে প্রতিরক্ষা সচিব জানালেন তখন আমি চুপিসাড়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠন বিষয়ের ষড়যন্ত্রের কথা মনে রেখে তার কাছে আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা? তিনি এ বিষয়ে আমাকে কোন কিছু চিন্তা-ভাবনা না করে আলাদা আলোনার প্রস্তুতি নিতে বললেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা বিষয়টি নিয়ে সচিব প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়েছিলেন। তবে মন্ত্রী মহোদয় তার বক্তব্যকে আরও ব্যাখ্যা করে বললেন যে কোন সময় কোনভাবে যদি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তেমন কোন বিভক্তি অথবা নিজেদের সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয় তাহলে পাকিস্তানের সামরিক সরকার সেটাকে ব্যবহার করে তিলকে তাল বানিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিশ্ব জনমত কিছুটা হলেও তাদের স্বপক্ষে নেয়ার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। তাই তার উপদেশ ছিল যে কোন সেক্টরে অথবা দেশের ভেতরে কোন অঞ্চলে হানাদার বাহিনী এবং তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীকে প্রতিহত অথবা নির্মূল করার অভিযানের বিষয়ে সামরিক অথবা বেসামরিক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কখনও কোন দ্বিমত অবা কোন মতবিরোধ দেখা দিলে সেটা যেন অবিলম্বে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে অথবা উর্ধতন অধিনায়কের সাহায্য সহযোগিতায় মীমাংসা করে সম্মিলিতভাবে পরবর্তী অপারেশন অথবা কার্যক্রম পরিচালনা করার উদ্যোগ নেয়া যাতে হানাদার পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের যে কোন ছোটখাটো মতবিরোধী অথবা সামান্যতম দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয়টাও কোনভাবে যেন অপব্যবহার করে পাকিস্তানের সামরিক সরকার যেন কোন প্রকার ফায়দা লুটতে না পারে। এ জন্য অবশ্য মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদের সুপ্রিয় কমান্ডার, চীফ অব স্টাফ ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফের স্টাফ অথবা কমান্ড থেকে নিয়তিভাবে সেক্টর কমান্ডারদের এবং তাদের অধীন এলাকায় হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত সব কার্যক্রম অথবা প্রতিহত বা নির্মূল করার অভিযানসমূহ নিয়মিতভাবে কঠোরভাবে নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনা করার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বল্পতম সুযোগ-সুবিধায় বিগত কয়েক মাস ধরে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার ইউনিটের তরফ থেকে আমরা যে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে চলেছি এবং দেশের ভেতরে অবস্থানরত আমাদের জনগণের এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল কতটা সজিব রাখতে সমর্থ হয়েছি ওপাকিস্তান রেডিও অন্যান্য গণমাধ্যমে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর কার্যক্রম বিষয়ক তৎপরতার মিথ্যা, অতিরঞ্জিত ও বানোয়াট খবরা-খবর বিষয়ে কতটা জোরালোভাবে প্রতিউত্তর দিতে সক্ষম হয়েছি সে বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তাকে বলা হলে তিনি এতে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং মন্ত্রী মহোদয় এই ধরনের কার্যক্রম আরও জোরদারভাবে চালিয়ে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। পরে তিনি জানতে চান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্প্রচার চাপ, দিল্লী, লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেপাল, ব্যাঙ্কক প্রভৃতি স্থানে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা বাঙালী কূটনৈতিকদের স্থাপিত অস্থায়ী বাংলাদেশ মিশনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে কিনা এবং তারা আমাদের কার্যক্রম বিষয়ে অবহিত রয়েছেন কিনা? মন্ত্রী মহোদয় জেনে খুব খুশি হন যে আমরা গত কয়েক মাস ধরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আলাপ-আলোচনার মধ্যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি এবং অনেক সময় তাদের চাহিদার মোতাবেক তাদের আমাদের প্রতিবেদন পাঠানো হচ্ছে। তবে মন্ত্রী মহোদয় আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, তথ্য মন্ত্রণালয়াধীন প্রেস ইনফরমেশন বিভাগ ও মুজিবনগর সরকারের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমাদের কার্যক্রম ভবিষ্যতে আরও বেশি জোরদার করা যায় কিনা সেটাও চিন্তা-ভাবনা করার কথা বললেন। তিনি আলোচনার শেষ দিকে আর একটা বিষয় আমাদের ভেবে-চিন্তে দেখার জন্য প্রস্তাব দিলেন প্রতিরক্ষা সচিবের কাছে আর সেটা হলো যে রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই হয়ত একটা চাকরির লোভে অথবা অন্য কোন প্রলোভনে প্রভাবিত হয়ে রাজাকার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে তারা নিজেদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজাকার বাহিনী পরিত্যাগ করে তাদের দেয়া অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করতে ইচ্ছুক। তাই তাদের রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যায় কিনা ও প্রতিরক্ষা সচিব সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি খুবই লাজুক বিষয় বলে অভিহিত করে এটা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদে আলাপ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দিলেন এবং প্রস্তাবটি মন্ত্রিপরিষদের সভায় গৃহীত হলে বিষয়টি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সম্প্রচারিত করা যেতে পারে বলেও তিনি জানান মন্ত্রী মহোদয়কে। সপরিবরে বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে নির্মমভাবে হত্যা করার পর স্বঘোষিত হত্যাকারীরা খন্দকার মোশতাককে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×