ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইঞ্জিনিয়ার এম এ মান্নান

সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আজকের শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ৬ অক্টোবর ২০১৮

 সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আজকের শেখ হাসিনা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এক কঠিন সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে তিনি আজ নিজ প্রতিভায় বিকশিত। পিতার সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাঁকে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বদরবারে আসন দিয়েছে। বিশ্বমানবের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক হিসেবেও তাঁকে গণ্য করা হয়। ৩৭ বছর ধরে একটানা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা, তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া এবং এখনও প্রধানমন্ত্রী পদে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা, সত্যিই জাতির জন্য গর্বের। পিতার মতো দুর্জয় সাহস নিয়ে দেশের রাজনীতি ও জনগণের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন, সংগ্রাম করছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এখনও এগিয়ে চলছেন। বিদেশে থাকায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের নির্মম ট্র্যাজেডি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা। গত ৩৭ বছর ধরে তাঁকে হত্যার জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাও হয়েছে তাঁর ওপর। সেদিন তিনি বেঁচে গেছেন সৃষ্টি কর্তার অপার কৃপায়, অলৌকিকভাবে। মহান স্রষ্টার সমস্ত কৃপা সেদিন তাঁর প্রতি বর্ষিত হয়েছিল। তাই ঘাতকের ঘৃণ্য তৎপরতা কাজে আসেনি। চারদিকে এখনও পরাক্রান্ত বহু শত্রু তাঁর। বলা চলে যুদ্ধের ময়দানে একাই লড়ছেন শির উঁচু করে। দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে তাঁর দৃঢ়তার কারণে, সাম্রাজ্যবাদের পদলেহন, স্বৈরাচারের কাছে আত্মসমর্পণ এবং দেশ ও জনগণের বিপদের মুহূর্তে দেশত্যাগ বা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার কোন ঘটনাই তাঁর জীবনে ঘটেনি। শত নির্যাতন ও হুমকির মধ্যেও তিনি ছিলেন এবং আছেন অবিচল। তাই তিনি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের একজন সফল রাজনৈতিক নেত্রী ও রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হয়েছেন। তিনি আমাদের জননেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী এবং একইসঙ্গে বিশ্ব নেত্রীও। বিশ্বজুড়ে জঙ্গীবাদ, দ্বন্দ্ব, হানাহানি, সংঘাত, সংঘর্ষের বিপরীতে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। নিজ দেশের সন্ত্রাসী ও জঙ্গীদের তিনি দমন করছেন সাহসের সঙ্গে। বিশ্বজুড়ে যে জঙ্গীবাদের বিস্তার, তার নির্মূলেও সবসময় সোচ্চার তিনি। নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক উচ্চতায় তিনি নিয়ে গেছেন, যে কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের জন্য রোল মডেল। তাঁর ৩৭ বছরের রাজনৈতিক জীবনে কিছু সাহসী ও দায়িত্বশীল কাজের চিত্র আজকের লেখায় তুলে ধরছি। সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো, জাতির জনকের নেতৃত্বে প্রণীত ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে আসা, অনগ্রসরতা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ, জাতির জনকসহ সব নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারের জন্য সোচ্চার হওয়া এবং সর্বশেষ বিচার করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিতকরণ এবং রায় বাস্তবায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণ, সড়ক-মহাসড়ক ও জনপদের ব্যাপক উন্নয়ন, রেলপথ উন্নয়ন ও মেট্রোরেল স্থাপন, ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা এবং উপবৃত্তি প্রদান, ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারী সম্পত্তি ভোগ-দখলমুক্ত করা, নারী শিক্ষাসহ নারী অগ্রগতি এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং খাদ্য রফতানি করে অতীতের সব অপবাদ ঘোচানো, কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং সময়মতো সার বিতরণ, প্রতিবছর ১ জানুয়ারি বিনা মূল্যে বই বিতরণ এবং একযোগে সারাদেশে বই উৎসব, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি এবং ভাতা ও বেতন অক্ষুণ্ণ রাখা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি, বিদ্যুত উৎপাদনে অসামান্য অর্জন, বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রাস্তাঘাট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো, সবজি উৎপাদন ও রফতানিতে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ, রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন, তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা এবং পরিবার পরিকল্পনার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রতি ৬০০০ জনের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও উপদেশ প্রদান, ভূমি সংস্কার, ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্রের খাদ্য সংস্থান, পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ ও কাজের অধিকার সুনিশ্চিত করা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, অটিজমসহ স্নায়ুবিক দুর্বলতার স্বীকার শিশুদের ভাতা এবং বিশেষ যত্ন এবং বিশেষ সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন, মহাকাশ জয় অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রগতিও সমতা অর্জন এবং কল্যাণকর রাষ্ট্রের মতো বিভিন্ন সেক্টরে ভাতা প্রদান ইত্যাদি অনেক উন্নয়নমূলক কাজ। রাষ্ট্রের এই অগ্রযাত্রা, সার্বিক উন্নয়ন সূচকের উন্নতি, কৃষিতে সমৃদ্ধি তাঁর আজকের জনমনে অবস্থান দৃঢ় করেছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরে দারিদ্র্য হ্রাস, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়নে বাংলাদেশের বড় সাফল্য অর্জন করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারের উন্নয়ন নীতি-কৌশল বাস্তবায়নের ধারাবাহিতকায়। অবকাঠামো খাতে দৃশ্যমান উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকেও এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০০০ সালে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। অর্থাৎ প্রতি ১০ জনে পাঁচজনই দরিদ্র। ২০১৮ সালে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৪.৩ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মাথাপিছু আয়, গড় আয়ুসহ বিভিন্ন মাপকাঠিতে মানব উন্নয়ন সূচকে (এইচডিআই) তিন ধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টিসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। এই সাফল্যগুলো গড় আয়ু বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে। বিশ্বে গড় আয়ুর সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নবম আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয়। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবতাবাদী নেতা ছিলেন। সারাবিশ্বে তার পরিচিতি ছিল শোষিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায়। ইতোমধ্যে তিনিও নিজেকে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীয় অবস্থান তৈরি করেছেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি মানবিক মনোভাবের পরিচয় দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকন্যা বিশ্বে একটি আলোচিত নাম। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজের অবস্থান আগেই তৈরি করেছেন। এখন মানবিকতায়ও। নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তথা খুন-ধর্ষণ-বর্বর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়-সেবা দিয়ে বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্রিটিশ মিডিয়া চ্যানেল ফোর তাঁকে আখ্যায়িত করেছে ‘মানবতার জননী’ হিসেবে। তিনি সর্বহারা রোহিঙ্গাদের পরম মমতায়, মাতৃ স্নেহে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছেন সেই দৃশ্য বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়েছে। শেখ হাসিনাকে ব্যথিত করেছে এই মানবিক বিপর্যয়। তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। ছুটে গেছেন আশ্রিতদের পাশে। স্বচক্ষে দেখেছেন এই অমানবিক অপরাধের চিহ্ন। কথা শুনেছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই, তবে তাদের অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করা হবে না। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, শরণার্থীদের পাশে তিনি আছেন। দেশে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাদের পাশে থাকবেন। শেখ হাসিনা তার কথা রাখছেন। এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়-সেবার ছায়া এখন শেখ হাসিনা। কেবল রোহিঙ্গা প্রসঙ্গটিই নয়, এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। ২১ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়ে পাহাড়ী-বাঙালীর নিরাপদ আবাস গড়ে তুলেছেন তিনি। এই চুক্তি পাহাড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটায়। এর আগে দীর্ঘদিন এই এলাকার মানুষ নিজ দেশে পরবাসীর মতো জীবনযাপনে বাধ্য ছিল। শেখ হাসিনা প্রায় ৬৮ বছর পর ছিটমহলবাসীর বন্দী জীবনের অবসান ঘাটিয়ে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেন। ১৯৪৭ সালের পর ২০১৬ সালে এসে স্বাধীন দেশের নাগরিকত্ব পায় ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এই মানবতার মেলবন্ধন রচিত হয়। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা জয় করেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশে সামরিকতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটান। তিনি একাত্তর-পঁচাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও খুনীদের বিচার করে আইনের শাসন এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত অনুন্নত দরিদ্র দেশটি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। উন্নয়নের নানা সূচকের ক্ষেত্রে বহু উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। এসব কারণে বিশ্ব নেতৃত্বে অনেক এগিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। বলা যায়, আন্তর্জাতিক পরিম-লে তাঁর গুরুত্ব এখন অপরিসীম। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে তাঁর পথচলা যেন মসৃণ ও সুগম হয় পরম করুণাময়ের কাছে এই প্রার্থনা। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পরিচালক বিআরটিএ
×