ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাহসী শাবাবুদ্দিন ॥ এক হাতে রং তুলি আর হাতে রণ তূর্য

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ৫ অক্টোবর ২০১৮

সাহসী শাবাবুদ্দিন ॥ এক হাতে রং তুলি আর হাতে রণ তূর্য

উত্তরায় আগেভাগেই পৌঁছে গেছেন তিনি, আমাদেরই দেরি হয়ে যায়। কথা ছিল তাঁর বাসা থেকেই একসঙ্গে যাব আমরা। জনকণ্ঠ ভবনের নিচে বাহন নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন নিজেকে আর্ট এজেন্ট বলে পরিচয় দেয়া অনুজতুল্য এ আর কে রীপন। আসলে শিল্পপ্রেমী, শিল্পরসিক। শিল্পীদের কাজ নিয়ে ঢাউশ সব এলবাম প্রকাশনার কাজে নিযুক্ত হয়ে ইতোমধ্যেই যিনি শিল্পীমহলে সুপরিচিত। কর্মময় ব্যস্ত দিন বৃহস্পতিবার। উত্তরার সাত নম্বর সেক্টরে শান্ত-মারিয়াম ফাউন্ডেশন ভবন আমাদের গন্তব্য। ভবনটি অত্যাধুনিক। এটির পঞ্চম তলায় ক্রিয়েটিভ আর্ট গ্যালারি। তবে শিল্পী আছেন অন্য ফ্লোরে। আগে শিল্পীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, তারপর শিল্পদর্শন। প্রদর্শনী উদ্বোধনের আগে অনুষ্ঠিত এই প্রীতি সম্মিলনীতে মূলত শিল্পীরাই আমন্ত্রিত, লেখক-সাংবাদিক মাত্র কয়েকজন। ঝাঁকড়াচুলো শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে ঘিরে আড্ডা জমে উঠেছে। শার্ট-ট্রাউজার দুটোর রংই তাঁর প্রিয় রং লাল, তবে দুরকম লাল। সদাহাস্যোজ্জ্বল, দিলদরাজ শাহাবুদ্দিনের দিকে আমরা ঘুরে ঘুরে তাকাই। রীতিমতো এক আইকন। তাঁর পাশেই আছেন গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা ও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ইমামুল কবীর শান্ত। আমরা সৌজন্য বিনিময় করে ছুটি গ্যালারিতে। সুন্দর সাহস, গূঢ় গতিময় ফিগার এবং ক্রিয়েটিভ গ্যালারি সুপরিকল্পনা ও সুরুচির ছাপ রয়েছে গ্যালারির সজ্জায়। দর্শকের দৃষ্টি ও চলাচল বাধাপ্রাপ্ত না হয়ে স্বস্তিকর চিত্রপাঠের জন্য যে পরিসর এবং আলোক প্রক্ষেপণ আবশ্যকÑ একটি আধুনিক গ্যালারির সব দাবিই পূরণ হয়েছে এখানে। উত্তরা দেখতে দেখতে জনভারাক্রান্ত এক শহর হয়ে উঠেছে। প্রায় দেড় দশক আগে শিল্পী কারুতিতাস একটি আর্টগ্যালারি দিয়েছিলেন এখানকার বিএনএস সেন্টারে। উদ্বোধনী দিনের কথা মনে পড়ে, এসেছিলেন তিতাসজননী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এবং শিল্পী রফিকুন নবী। সম্ভবত এক বছর চালু ছিল গ্যালারিটি। এর পরপরই শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী তাঁর বাবা খ্যাতিমান শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর বাসভবনের নিচতলায় প্রতিষ্ঠা করেন গ্যালারি কায়া। সেটির উদ্বোধনী দিনেও গিয়েছিলাম। কায়ায় প্রায় নিয়মিতভাবেই চিত্র প্রদর্শনী আয়োজিত হচ্ছে। উত্তরাবাসী জানেন ঢাকায় প্রবেশ-প্রস্থানের বড় প্রধান সড়কটি উত্তরার সেক্টরগুলোকে দুই ভাগ করেছে। গ্যালারি কায়া পড়েছে পুবদিকে। এখন পশ্চিম দিকের অধিবাসীরাও পেলেন নতুন এই আর্ট গ্যালারি ‘ক্রিয়েটিভ’। যাহোক, শাহাবুদ্দিনের ড্রইং প্রসঙ্গে আসি। টানা এক মাসেরও কম সময়ের ভেতর পঁচিশখানা ড্রইং করেছেন শিল্পী। সেগুলোই প্রদর্শিত হচ্ছে এখানে। শাহাবুদ্দিনের তেলরং ছবিতে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়ে থাকে, এই ড্রইংগুলোও সেই একই ধরনের বিষয় নিয়ে উপস্থিত। কী সেগুলো? মুক্তিযোদ্ধা, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ। তবে মানবফিগারের সমান্তরালে চিত্রপটে স্থান করে নিয়েছে গতিময় প্রাণী ঘোড়া, ষাঁড়, এমনকি বাঘও। একবারের দৃষ্টিপাতে তার মহিমার সবটা ধরা পড়ে না। বারবার দেখলেই তার গূঢ় গতিময়তা এবং চেনাজানা বাস্তব পেরুনো এক ভিন্নতর সম্ভাব্য বাস্তবের বিশালত্বের কাছে আমাদের বোধকে আবাহন করে শাহাবুদ্দিনের এসব শক্তিমতী ড্রইং। কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতায় রয়েছেÑ ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতূর্য’। এই একটি পঙ্ক্তিতেই প্রেমিক ও যোদ্ধা নজরুলচারিত্র ধরা পড়ে। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে কবিতার এই চরণটিই অন্যভাবে মনে আসেÑ এক হাতে রং তুলি আর হাতে রণ তূর্য। পিছনে ফিরে দেখি, স্বাধীনতাপূর্ব আমলে পনেরো বছর বয়সে শাহাবুদ্দিনের আঁকা ছবি করাচিতে পাঠিয়ে দেন আর্ট ক্লাসের টিচাররা। সেই ছবি প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল পায় অনুর্ধ ষোলো বিভাগে। রেডিওতে সে খবর শুনে উচ্ছ্বসিত হন শাহাবুদ্দিন। তারও অনেক পরে তাঁর আর্ট কলেজে পড়া। এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে যোগ দেন যুদ্ধে। রীতিমতো প্লাটুন কমান্ডার। ষাটের উত্তাল দিনগুলোতে, গণঅভ্যুত্থানেও এই শাহাবুদ্দিন ছিলেন প্রথম সারির প্রতিবাদী তরুণ। রংতুলি নিয়ে যুদ্ধের ছবি আঁকা আর রাইফেল হাতে রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়াÑ দুটোর পৃথক বৈশিষ্ট্য সম্মন্ধে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। যুদ্ধশেষে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছে। শাহাবুদ্দিন ছবি আঁকেন শুনে তখনই আলাদা চোখে দেখেন তাঁকে বঙ্গবন্ধু। শাহাবুদ্দিনের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন মহান নেতা। দেখানোর সুযোগ মিলল। সেটি ১৯৭৩ সালের কথা। ক্যাবিনেট মিটিং চলছিল। সেখানে নিজের আঁকা ‘প্রিজনার’ ছবি নিয়ে হাজির হন শাহাবুদ্দিন। থিম হলো রাজবন্দী। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনের বিষয়টি তাঁর মাথায় ছিল ছবিটি আঁকার সময়। বঙ্গবন্ধু অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, আমি ছবি খুব ভাল বুঝি না। কিন্তু ছবিটা দেখে আমার কষ্ট হচ্ছে। সারা জীবনতো জেলেই কাটালাম। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। তারপর থেকে ভূলুন্ঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। চললো ইতিহাসবিকৃতির কৃষ্ণকাল। সমাজের বিবেক হিসেবে খ্যাত শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা কি সে সময় প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করেছিলেন? এক্ষেত্রেও শিল্পী শাহাবুদ্দিন সাহসের স্বাক্ষর রাখলেন। একের পর এক এঁকে চললেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। সত্তরের প্রথমার্ধে ফরাসী সরকারের বৃত্তি নিয়ে যান চিত্রশিল্পীদের স্বপ্নপুরি প্যারিসে। সেখানেই থেকে যান এবং একের পর চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেন। অর্জিতও হতে থাকে আন্তর্জাতিক সব পুরস্কার। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক পেয়েছিলেন শিল্পী ২০০০ সালে। এর আগে ফরাসী সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান নাইট উপাধি পেয়েছেন। বিরাট খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন শাহাবুদ্দিন। কিন্তু থেকে যান মেঘনা পাড়ের বালকের মতোই সদা সরল আর আন্তরিক। সাহসী তো বটেই। সমালোচকের অভিমত গত মাসে ১১ সেপ্টেম্বর শিল্পীর ৬৯তম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি যে ক্যাটালগ প্রকাশ করে সেটিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকারের বক্তব্য রয়েছে। তাঁর চিত্রকর্ম সারা বিশ্বকে আলোড়িত এবং আলোকিত করুকÑ এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শাহাবুদ্দিনের শিল্পকর্ম নিয়ে দেশে-বিদেশে বহু সমালোচকই প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করেছেন। মইনুদ্দীন খালেদ বারবার শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে লিখেছেন। জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশিত ক্যাটালগে ‘শাহাবুদ্দিনের ছবি : মানুষের আকাশ আলিঙ্গন’ শিরোনামে দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সেখান থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘বাংলাদেশের শিল্পাকাশে শাহাবুদ্দিনের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। শিল্পীর চিত্রপটে দৃষ্টিপাতমাত্র দর্শকের শিহরিত সত্তা তা অপার বিস্ময়ে অনুভব করে। এক অভূতপূর্ব গতিময় ইমেজ যেন আকাশের অনন্ততার পরিমাপ নিতে চায়। ওই ইমেজ উড়ে-চলা মানুষের। বিশাল ডানার পাখির মতো মানুষ শাহাবুদ্দিনের চিত্র পরিধির মধ্যে স্পেস-ক্রাফট হয়ে গেল কেন? কেন তার ছবির মানুষ ভূমি থেকে উৎক্ষেপিত রকেটের মতো, কিন্তু পরিণামে মহাকাশের শূন্যতায় সচ্ছলতা পায়? মানুষী শক্তি কোন তুরীয় অবস্থায় গেলে বস্তু থেকে রূপান্তরিত হয়ে অগ্নিগোলক হয়ে যায়? এসব প্রশ্নের উত্তর পদার্থবিদ্যার গতিসূত্রের আলোকে ব্যাখ্যা করা চলে। কিন্তু আমরা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারি না। কারণ নিরপেক্ষ গতিসূত্র নয় শুধু, আমরা এ শিল্পীর ছবি নিরীক্ষণ করে শিল্পসত্য ও ইতিহাসের সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে চাই।...একথা সত্য, জীবন বাজি রেখে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে জীবন-মৃত্যুর ভয়ঙ্কর পথ পাড়ি দিয়ে শক্তি-সংকল্প, জেদ-রাগের অভিঘাতে মানুষের দেহ যে কত বিচিত্র মুদ্রায় ঝলকায় তা-ই শাহাবুদ্দিনের ছবির বেগবান মানুষের বৈচিত্র্যের প্রধান উৎস। এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমাদের চেতনার আমূল পরিবর্তন হয়। যুদ্ধোত্তর দেশে শিল্প যে নতুন জন্ম লাভ করে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ শাহাবুদ্দিনের চিত্ররাশি।’ ‘...তাঁর ছবি পশ্চিমের মানুষের কাছে মিথ হয়ে যায় এজন্য যে ওই দুরন্ত-উড়ন্ত বলশালী নগ্নপ্রায় মানুষের মধ্যে তারা প্রমিথিয়ুসের ছায়া দেখতে পেয়েছে। শাহাবুদ্দিনের ছবিতে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরস্পরিত হয়ে যে অভূতপূর্ব ন্যারেশান বা আখ্যান রচিত হয় তা গ্রীক ও রোমান মিথ পাঠে অভিজ্ঞ পশ্চিমের চোখ মিথের আলোকে পাঠ করে। যুদ্ধংদেহী মানুষের মেলবন্ধন তো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। যত সময় যাবে তাতে ক্রমে সঞ্চিত হবে মিথের শক্তি। শাহাবুদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্ররাশি যেন এক নবপুরাণ। কেননা একমাত্র এই শিল্পীর ছবিতেই মানুষী অভিব্যক্তি শিল্পীর আবেগের তোড়ে মিথের অদ্ভুতদর্শন শক্তিমত্ত চরিত্রের পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।’ মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ছবির বিষয় বা থিম নিয়ে কিছু বলতে গেলে এক কথায় বলা যাবে তিনি এঁকে চলেছেন মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শিল্পী এঁকে চলেছেন বহু মাত্রায়। হুঙ্কার-প্রকম্পিত ভাষণরত সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধু, বেদনামথিত বঙ্গবন্ধু, চিন্তাক্লিষ্ট বঙ্গবন্ধু, হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু, সংক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু, গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু- কত রকম বোধেই না শাহাবুদ্দিন চলচ্চিত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই মহানায়ককে এঁকেছেন। চলতি বছরের মার্চে ঢাকায় শিল্পী শাহাবুদ্দিনের একটি একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় যার শিরোনাম ছিল ‘শান্তি’। ‘শান্তি’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ওই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেছিলেন। ভারতের কোন রাষ্ট্রপতির সেটিই প্রথম কোন চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন। সে প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া ৩২টি ছবিই প্রদর্শিত হয়েছিল ঢাকায় মার্চে। সে সময় সংবাদ সম্মেলনে শিল্পী দারুণ একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। শিল্পী বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করা, জাতির পিতাকে হৃদয়ে ধারণ করা খুব কঠিন। আমি গত পঞ্চাশ বছর ধরে এ চেতনা বহন করে চলেছি। এ পথ খুব কঠিন। পৃথিবীকে ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন এদের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে। নতুন আশার পথ দেখিয়েছিলেন। এটা আজকের তরুণদের ভালভাবে উপলব্ধি করতে হবে। আমরা স্মরণ করতে পারি এর কয়েক বছর আগে শিল্পকলা বিষয়ক একটি সাময়িকপত্রে শিল্পীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। সেখানে বিষয়টি আরও খোলাসা করে ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘চিত্রশিল্পী হিসেবে দায়বদ্ধতার কারণেই মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু আমার ক্যানভাসে এসেছে। আজ আমি যদি চিত্রশিল্পী না হয়ে কবি-সাহিত্যিক হতাম তাহলে হয়তো লিখতাম। গায়ক হলে মুক্তিযুদ্ধের গান করতাম। যেমন শাহিন মাহমুদরা গেয়েছিলেন। সবাই তাঁদের চেনে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি তাঁরা আমার মতোই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে রাখতেন। দুর্ভাগ্য হলো, খুব কম লোকই গেছে। ওই যুদ্ধ ক্যাম্পে চিত্রশিল্পী হিসেবে আমি একাই ছিলাম। তাই আমাকেই এমন ছবি আঁকতে হয়েছে বা হচ্ছে। এদেশ থেকে যখন আমি বাইরে গেলাম চিত্রকলা নিয়ে লেখাপড়া করার জন্য, ওখানে গিয়ে তো নিজের দেশের ঐতিহ্য নিয়ে ছবি আঁকতে হতো। ধরুন, যদি আমি মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে দিই তাহলে আমাকে কী আঁকতে হতো? কী থাকত আমার ছবিতে? গাছপালা, নদীনালা আর হাড্ডিসার মানুষের ছবিÑ এই তো ছিল বাংলার মুখ। আমি তো আর গুলশান-বনানীর মানুষের ছবি এঁকে দেশের ছবি আঁকতে পারতাম না। আমাকে কুঁড়েঘর, কলাগাছ, মেঘনা নদী ইত্যাদি আঁকতে হতো। এসব কাজ অনেক হয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নন্দলাল বসু হয়ে অনেকেই এ ধরনের কাজ করেছেন বা করছেন। কিন্তু আসল পয়েন্ট বা স্পিরিট যেটাÑ যার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেটাকে কিভাবে এড়িয়ে যাবেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই তো হলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীনতাযুদ্ধ একটা জাতির জন্য একবারই হয়। বারবার হয় না। শিল্পী হিসেবে আমি হয়তো ভাগ্যবান যে আমি ধীরে ধীরে হলেও স্বাধীনতার প্রসঙ্গকে আমার ছবির বিষয় করতে পেরেছি। অন্যান্য জাতির মানুষের কাছে আমি আমার দেশের একটা বিশাল গৌরবময় অধ্যায়ের গল্প ছবিতে ব্যক্ত করতে পেরেছি। এর জন্য আমাকে শিল্পকলার এক উচ্চ স্তরের ভাষাকে রপ্ত করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমার জন্য অহংকার তো বটেই- আমার জীবনও বটে। এটার জন্যই বেঁচে আছি আমি। স্বাধীনতা সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ শাহাবুদ্দিন তাঁর সাহস, স্বকীয় চিত্রসম্ভার এবং মানুষের প্রতি আন্তরিক মমত্ববোধ- সব মিলিয়ে আমাদের প্রিয় মানুষ ও শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীসত্তায় পরিণত হয়েছেন। তাঁকে ভালবাসা জানানোর বিশেষ সুযোগ চিত্রপ্রেমীরা নিশ্চয়ই হাতছাড়া করতে চাইবেন না। ছুটে যাবেন উত্তরার শান্ত-মারিয়াম ক্রিয়েটিভ গ্যালারিতে (৪৫ সোনারগাঁও জনপথ, সেক্টর ৭, উত্তরা)। ২১ অক্টোবর পর্যন্ত সে সুযোগ তো রয়েছেই। [email protected] আলোকচিত্র: রূপম চৌধুরী ও সুবীর কুমার
×