ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৩ অক্টোবর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

(গতকালের সম্পাদকীয় পাতার পর) মন্ত্রী মহোদয় প্রথমেই জানতে চাইলেন আমরা ওই সময়ে কি ধরনের কি কি কাছ করছি? আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে আমরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি কিনা এবং বিশেষ কোন অসুবিধা আছে কি না আমাদের দৈনিন্দন কার্যাদি সুচারুরূপে করে চালিয়ে যাবার জন্য? প্রতিরক্ষা সচিব সব কিছু তাকে বুঝিয়ে বললেন। তিনি মন্ত্রী মহোদয়কে অবহিত করলেন যে আমাদের অফিসে বসার জায়গার কিছুটা অসুবিধা থাকলেও সে ব্যাপারে আপাতত কিছু করা সম্ভবপর নয়। আমাদের কাজের সুবিধার জন্য আপাতত একটা ছোট রেডিও কিনে দেয়া হয়েছে বলে তিনি মন্ত্রী মহোদয়কে জানালেন। তিনি মন্ত্রী মহোদয়কে বললেন যে উক্ত রেডিওর মাধ্যমে ওদের পক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশ বাণী বিবিসি, ভযেস অব আমেরিকা, কানাডিয়ান রেডিও অস্ট্রেলিয়ান রেডিওর সব খবরাখবর মনিটর করা সম্ভবপর হয়; বিশেষ করে রেডিও পাকিস্তানের মিথ্যা, বানোয়াট ও তাদের মনগড়া প্রচারণামূলক খবরাখবর ও আলোচনামূলক অনুষ্ঠানের সারমর্ম মনিটর করা তাদের জন্য খুবই দরকার সেগুলো যথাযোগ্যভাবে কাউন্টার করার উদ্দেশ্যে। আলাপকালে মন্ত্রী মহোদয় দুটো বিষয় আমার কাছে জানতে চাইলেন। সেটা হলো প্রথমত হানাদার পাকবাহিনীও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর লোকেরা সারাদেশে দৈনন্দিন যে সমস্ত সাধারণ নিরীহ মানুষদের বিশেষ করে আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের এবং হিন্দুধর্মীয় লেখকদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মহিলাদের ইজ্জত নষ্ট করছে এবং শিশুদের হত্যা করছে আমরা এসব খবরাখবর কিভাবে সংগ্রহ করে থাকি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সেক্টরের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশের ভেতরে অবস্থানকারীকে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত অপারেশনগুলোর খবরাখবর আমরা কিভাবে সংগ্রহ করে থাকি? বিভিন্ন চ্যানেলে আমরা কিভাবে দেশের ভেতরে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত অপারেশনের বিষয়বস্তু খবরাখবর সংগ্রহ করে থাকি বিশেষ করে বিভিন্ন সেক্টরে দেশের ভেতর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগদান করার জন্য আগত ছেলেদের কাছ থেকে বিভিন্ন ক্যাম্পে সদ্য দেশের ভেতর থেকে আগত পুরুষ ও মহিলাদের কাছ থেকে এবং কলকাতার কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে অবস্থিত অস্থায়ী আওয়ামী লীগ অফিসে আগত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের কাছ থেকে সারা দেশে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ, মহিলা ধর্ষণ ও জ্বালাও পোড়াও এর বিস্তারিত তথ্য যেমন সংগ্রহ করে থাকি তেমনিভাবে সেক্টর কামান্ডারদের অফিসের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করে ৮নং থিয়েটার রোডের কম্পাউন্ডের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত যে টিন শেডে আমরা অফিস করতাম তার পশ্চিম দিকে তখন বিএসএফে একটা অফিস ছিল, যেখান থেকে ও কিভাবে আমাদের নিয়মিত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের খবরাখবর দেয়া হতো ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য মন্ত্রী মহোদয়কে দেয়া হলে তিনি মোটামুটিভাবে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আমাদের ধন্যবাদ জানান নানাবিধ অসুবিধার মধ্যেও স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার জন্য। মন্ত্রী মহোদয় অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর বিস্তারিতভাবে প্রচার ও প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদের সভায় গৃহীত সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, কূটনৈতিক এবং দেশের ভেতর থেকে আগত লোকদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত খবরগুলো যথাযোগ্যভাবে দেশে বিদেশে প্রচার ও প্রকাশ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আমাদের যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বার বার বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন সেটা হলো যে প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হলো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের দ্বারা গঠিত সরকার এবং তাদের গঠন প্রক্রিয়া ছিল সর্বতোভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং সাংবিধানিক উপায়ে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে। তিনি এ কথাটাও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে বললেন যে এমনকি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক কর্নেল এমএজি ওসমানী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের চীফ অব স্টাফ লে. কর্নেল এমএ রব দুজনই জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি (এমএনএ)। তৎকালীন মুক্তিবাহিনীর চীফ অব স্টাফ লে. কর্নেল এমএ রব ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একজন এমএনএ নির্বাচিত হন। তিনি যুদ্ধকালীন সময়ে আগরতলায় একটা আঞ্চলিক অফিসে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন বলে আমাদের পক্ষে তার সাক্ষাতকার নেয়া তখন সম্ভবপর হয়নি। স্বাধীনতা উত্তরকালে কর্নেল রবকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং নবগঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান প্রতিরক্ষা সচিব সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনা ও পরামর্শ গ্রহণের জন্য নিয়ে যান মুজিবনগর সরকারের সর্বদলীয় মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান সাহেবের কাছে। ঐ দিনই দুপুর তিনটার দিকে তার ৮নং থিয়েটার রোডের অফিসে। প্রতিরক্ষা সচিব মহোদয় আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি জানতে চাইলেন আমার দেশের বাড়ি কোথায় এবং ঢাকায় কি করতাম। এরপর তিনি জানতে চাইলেন প্রকৃতপক্ষে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারটা কি এবং আমরা কি কাজ করছি? চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×