ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাবির দশম সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

যুব সমাজকে অপসংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যুব সমাজকে অপসংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে হবে

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ মতিহারের সবুজ চত্বর ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের দশম সমাবর্তনে উপস্থিত হয়ে সভাপতির ভাষণে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, জাতির অমিত শক্তি যুব সমাজ। যুব সমাজের শক্তি ও সম্ভাবনাকে দেশ গঠনের কাজে লাগিয়ে আমাদের যুব সমাজকে অবশ্যই অপসংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী হতে হবে। মানবিক ও উদার হতে হবে। তাহলেই আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব। এর সুফল জাতির কাছে পৌঁছাতে পারব। এজন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক, অভিভাবক, ছাত্রসংগঠনসহ সকলকে সম্মিলিতভাবে অবদান রাখতে হবে। শনিবার বিকেল ৪টা ৫৪ মিনিটে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণের শুরুতেই তিনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তিনি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহচর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড. সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইউমসহ সেইসব অকুতোভয় সূর্য সন্তানদের যারা মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তিনি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাতও কামনা করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আজ আপনাদের মাঝে উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। সমাবর্তন যে কোন বিশ^বিদ্যায় বিশেষত গ্র্যাজুয়েটদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় অনুষ্ঠান। কেননা সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন তাদের মেধা ও প্রতিভার অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে, তেমনি তারা ভবিষ্যত দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। তিনি রাবির ১০ম সমাবর্তনে যারা ¯œাতক হলেন, যারা গবেষণা কর্মের স্বীকৃতি পেলেন তাদের উষ্ণ অভিবাদন জানান। একই সঙ্গে তিনি অভিনন্দন জানান এবারের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডি-লিট ডিগ্রিপ্রাপ্ত দেশের দুই বরেণ্য সাহিত্যিক প্রফেসর হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেনকে। যারা তাদের সাহিত্যকর্ম দিয়ে বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। রাষ্ট্রপতি তার বক্তব্যে বলেন, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি বাঙালী জাতিসত্তা বিকাশে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অনেক জ্ঞানী-গুণী, প-িত ব্যক্তিবর্গ এই বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেছেন। এদের মধ্যে ছিলেন বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, ইতিহাসবিদ ড. এআর মল্লিক, ডক্টর আব্দুল করিম প্রমুখ। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজকে যারা এই বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করছেন তারাও সমাজের জ্ঞানী ও আলোকিত মানুষ। এসব আলোকিত গুণী ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তরুণ শিক্ষার্থীরা যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে- এ বিশ^াস আমার রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে শিক্ষকতা কেবল পেশা নয়, একটি আদর্শ। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা তাদের গর্বিত উত্তরাধিকারের বিষয়টি মনে রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রেখে যাবে। রাষ্ট্রপতি বলেন, বিশ^বিদ্যালয় মূলত মুক্তচিন্তা বিকাশের জায়গা। জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মধ্যে দিয়ে এখানে নতুন নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তির উদ্ভব হয়। এসব জ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্রমে সমগ্র বিশে^র সম্পদে পরিণত হয়ে যায়। এর ফলে পৃথিবী সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বিশ^বিদ্যালয়ের এই মহান ব্রতের বিষয়টি আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। তিনি বলেন, কারিকুলামভিত্তিক শিক্ষার পাশাপাশি মুক্তচিন্তা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা, জাতিগঠনমূলক কর্মকা-, সমকালীন ভাবনা, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলা ইত্যাদি সৃজনশীল কর্মকা-ে শিক্ষার্থীদের কেবল দক্ষ ও পরিপূর্ণ করে না, কূপম-ুকতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকেও পরিপুষ্ট করে। এর প্রভাব ব্যক্তি জীবন তো বটেই, সামষ্টিক জীবনকেও গভীরভাবে রেখাপাত করে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ বলেন, আজকাল বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসহিষ্ণুতা, উগ্রবাদ, জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের মতো নেতিবাচক কর্মকা- জাতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছে। আমি মনে করি, এর উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে, মুক্তচিন্তা সংস্কৃতি চর্চার অভাবে। যুগের চাহিদাকে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান ও গবেষণা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, সময়ের বিবর্তনে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ও দেশের দ্রুত উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালসমূহ বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে জনগণের অনেক প্রত্যাশা। তিনি বলেন, বিদ্যমান অবকাঠামো, পদ্ধতি ও মূল্যবোধকে বহন করেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তৈরি করতে হবে আগামী দিনের নেতৃত্ব, সুদক্ষ মানবসম্পদ। আমাদের সম্পদ সীমিত, কিন্তু চাহিদা অনেক। তাই সীমিত সম্পদ ও সুযোগ সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞান চর্চার অনুকূল পরিবেশ, উন্নত মান ও ভাল ফলাফল যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে তীব্র প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে বিশ্বমানের গুণগত শিক্ষা ও গবেষণার বিকল্প নেই। তাই বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হালনাগাদ করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে ও শিখতে পারে সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। মুক্তিসংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা-উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর স্বাধীনতাবিরোধী চক্র শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মৌলবাদ ও উগ্রবাদকে উসকে দিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে ক্ষুণœ করার অপচেষ্টা চালায়। তিনি বলেন, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। আর স্বাধীনতা বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। তাই শিক্ষার্থীসহ প্রতিটি নাগরিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিজেদের সমৃদ্ধ করতে পারে সে ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমাদের আজকের এই অবস্থা পৌঁছানোর পেছনে রয়েছে তোমাদের শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা, শিক্ষকম-লীসহ সমাজ, দেশ ও জনগণের বিপুল অবদান। তোমরা তাদের কাছে ঋণী। তোমরা সমাজ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তোমাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও কর্ম দিয়ে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সবসময় নৈতিক মূল্যবোধ, বিবেক ও দেশপ্রেম জাগ্রত রাখবে। কখনো অন্যায় অসত্যের কাছে মাথা নত করবে না। মনে রাখতে হবে নিজেদের আত্ম পরিচয়ের কথা, মাতৃতুল্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা, অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা, আমাদের প্রিয় দেশটির কথা। ভুলবে না তোমাদের শিকড়ের কথা। কারণ শিকড় ভুলে কেউ বড় হতে পারে না। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে বক্তৃতা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ইমেরিটাস আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। সমাবর্তনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর এম. আব্দুস সোবহান। অনুষ্ঠানে স্থানীয় সংসদ সদস্যগণ, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ, শিক্ষাবিদ ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। সমাবর্তনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখায় উপমহাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেনকে সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচর (ডি-লিট) ডিগ্রি প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাদের হাতে ডিগ্রী তুলে দেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পৌঁছার আগে রাষ্ট্রপতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছাত্রীদের জন্য একটি ও শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের নামে ছাত্রদের জন্য একটি করে বহুতল আবাসিক হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
×