ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের দুর্গে ভাগ বসাতে চায় বিএনপি ॥ গাজীপুর

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আওয়ামী লীগের দুর্গে ভাগ বসাতে চায় বিএনপি ॥ গাজীপুর

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, গাজীপুর ॥ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন শেষ। বিজয় এসেছে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার প্রতীক নৌকার ঘরে। এখন জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনেই বইছে ভোটের হাওয়া। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের ঘর গোছাতে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী বিজয়ী হওয়ায় জেলার ৫টি সংসদীয় আসনেই নৌকার পালে যেন নতুন করে হাওয়া লেগেছে। ইতোমধ্যেই গাজীপুরের পাঁচটি সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। কর্মী-সমর্থকরাদের নিয়ে নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা দলের হাইকমান্ডসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলে ধর্না দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা তৃণমূল নেতাদের সমর্থন আদায়েও নানা তৎপরতা শুরু করেছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছবিসম্বলিত নানা রংয়ের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার আর বিলবোর্ডে জেলার বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়ক ও হাট বাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ছেয়ে গেছে। সেই সঙ্গে জনসাধারণের মাঝেও শুরু হয়েছে গত নির্বাচনে জয়ী হওয়া এমপিদের সাড়ে চার বছরের নানা কার্যক্রমের ফলাফল নিয়েও চুলচেরা বিশ্লেষণ। ফলে নির্বাচনী উত্তাপ জেলার পাঁচটি আসনেই ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের দূর্গ হিসেবে খ্যাত গাজীপুরের পাঁচটি সংসদীয় আসনের সবক’টিতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (দশম) জয়ী হন। বিএনপি প্রার্থীরা তাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এবারের জাতীয় সংসদের একাদশ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ তাদের আসনগুলো ধরে রাখতে চায়। অপরদিকে ২০ দলীয় জোট তথা বিএনপি চায় তাদের হারানো আসন ফিরে পেতে। তাই আগামী নির্বাচনেও জেলার সবক’টি আসনই নিজেদের দখলে রাখতে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সংসদ সদস্যগণ। তবে কোন কোন আসনে নতুন মুখের নেতারা প্রার্থী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ইতোমধ্যে গণসংযোগ শুরু করেছেন। তারা আলোচনাসভা, মতবিনিময়, জনসভাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করে ভোটারদের পাশাপাশি এলাকার সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। গাজীপুরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই শক্তিশালী। নির্বাচনে এ দু’দলের মনোনীত প্রার্থীদের মাঝে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। তবে উভয় দলেই মাঠ পর্যায়ে রয়েছে গ্রুপিং ও কোন্দল। কাজেই প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগের খুব হিসেব নিকেশ করতে হবে এখানে। সাংগঠনিক পরিস্থিতিকেও বিবেচনায় নিতে হবে। তা না হলে এবারের নির্বাচনে কোন কোন আসনে দলটিকে বেকায়দায় পড়তে হতে পারে। তবে দলীয় কোন্দল মিটিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবারের লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি বলে অভিজ্ঞজনদের অভিমত। তবে পরিস্থিতি যা-ই হোক, সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মতো গাজীপুরের ভাসমান ভোটাররাই এবারেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারকের ভূমিকা পালন করবেন। তবে গাজীপুরের এই পাঁচটি আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে ভোটারদের অভিমত হচ্ছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ যদি একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারে এবং সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে আবারও সবকটি আসনেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই নির্বাচিত হতে পারবেন। এবার জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে কয়েকটিতে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চমক আনতে পারে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা গুঞ্জন। তাই নানা হিসাব-নিকাশ করে সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের পথ চলছেন। তবে অধিকাংশ আসনেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যরাই মনোনয়ন পেতে পারেন বলে আলোচনা চলছে। তবে ২/১টি আসনে নতুন মুখ আসতে পারে বলেও এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। গাজীপুর-১ (সিটির ১৮ ওয়ার্ড ও কালিয়াকৈর) ॥ এ আসনটি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ১ হতে ১৮ নম্বর পর্যন্ত মোট ১৮টি ওয়ার্ড এবং কালিয়াকৈর উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ১৯৪ নম্বর আসন। এ আসনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক নির্বাচিত হন। গত নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের এ নেতা নির্বাচিত হন। তিনি বর্তমানে সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের এই এমপি মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে দৃঢ় আশাবাদী। তার দাবি, পরপর দু’বার নির্বাচিত হওয়ার পর এক যুগের বেশি সময় ধরে অসমাপ্ত থাকা সেতুসহ বেশ কয়েকটি সড়ক নির্মাণ ছাড়াও বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকা- তার জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তিনি ছাড়াও আসন্ন নির্বাচনে এ আসনের প্রার্থী হিসেবে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম বাবুল, কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন শিকদার, গাজীপুর জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান এসএম মোকসেদ আলম এবং তরুণ ব্যবসায়ী নূরে আলম সিদ্দিকীর দলীয় মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যেই তারা প্রচার ও গণসংযোগ শুরু করেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। নূরে আলম সিদ্দিকী বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক ও দাতব্য সংগঠনের কার্যনির্বাহীর পদে রয়েছেন। এরই মধ্যে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে তার সম্পৃক্ততা এলাকাবাসীর নজর কেড়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কালিয়াকৈর উপজেলার সভাপতি কামাল উদ্দিন শিকদার বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ তথা গাজীপুর-১ আসনে আমাদের কোন সমস্যা নেই। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই সবাই কাজ করবে। অন্যদিকে, এ আসনে কমপক্ষে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত বিএনপি। দলটির মধ্য বিদ্যমান অন্তর্দ্বন্দ্ব, কোন্দল দীর্ঘদিন থেকে বিরাজ করে আসছে। গত ২০০৯ সালের ৯ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপার্সনকে নিয়ে মন্তব্য করেন তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী। এর জের হিসেবে ওই বছরের ১৭ মার্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকেই এ নির্বাচনী এলাকায় নেতাকর্মীরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। বহুধা বিভক্ত হয়ে পড়ে দলটি। তার অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও কোন্দল থামেনি। ইতোমধ্যেই একাধিকবার বিএনপির দলীয় নেতা কর্মীদের মাঝে প্রকাশ্যে সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি, কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সভাপতি ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খান, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সভাপতি কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও গাজীপুর সদর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আলহাজ সুরুজ আহমেদ, কালিয়াকৈর পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন এবং সাবেক কাশিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত হোসেন। বিএনপির এরা সকলেই সংসদ সদস্যের প্রার্থীর ক্ষেত্রে নতুন মুখ। তবে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হলে চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীও প্রার্থিতার জন্য দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে তার সমর্থকরা দাবি করেন। তাদের মতে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে শীঘ্রই এ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। এছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে শরীক দল জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও গাজীপুর মহানগর কমিটির সভাপতি সাবেক বাসন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার আব্দুস সালাম, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর এ্যাডভোকেট আব্দুল কাইয়ুম, জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি সুলতান আহমেদসহ ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান এবং জামায়াতের গাজীপুর মহানগরের সহকারী সেক্রেটারি মোঃ হোসেন আলীর নাম শোনা যাচ্ছে। গাজীপুর-২ (সদর) ॥ এটি জেলা সদরের আসন হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টারের নির্বাচনী আসন এটি। নানা কারণে এ আসনটি গুরুত্বপূর্ণ। জেলা শহর ও টঙ্গীসহ গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের (জিসিসি) অধিকাংশ এলাকা নিয়ে এ সংসদীয় আসন গঠিত। ১৯৯১ সালে বিএনপি এবং ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন পরবর্তী সব ক’টি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এ আসনটিতে জয়ী হয়ে আসছে। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে এ আসনে বিজয়ী হন জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি আহসান উল্লাহ মাস্টার। এরপর হতে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপির পরিবার থেকে বিএনপি এ আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। আহসান উল্লাহ মাস্টার সংসদ সদস্য থাকাকালে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেন। তিনি ছিলেন গরিব দুখি সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল। জনপ্রিয় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার ২০০৪ সালের ৭ মে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত তারই জ্যেষ্ঠ পুত্র জাহিদ আহসান রাসেল এ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসছেন। প্রতিবারই তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা হাসান উদ্দিন সরকার। বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে এমপি রাসেল তার বাবার মতোই এলাকাবাসীর আস্থা ও ভালবাসা অর্জন করতে পেরেছেন বলে স্থানীয়দের অভিমত। সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা- করেছেন। বিশেষ করে তার হাত ধরে গাজীপুর শহরে ৫০০ শয্যার শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, টঙ্গীতে ২৫০ শয্যার শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার হাসপাতাল এবং স্টেডিয়াম, বোর্ডবাজারে নার্সিং কলেজ, পুবাইলে ১০ শয্যার স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও চিকিৎসক সহকারীদের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, পিটিআইতে আধুনিক শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার অডিটরিয়ামসহ বহু প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এ ছাড়া বিদ্যুত লাইন, ইজতেমা ময়দানের উন্নয়ন, এলাকার প্রতিটি স্কুল-কলেজে বহুতল ভবনসহ সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে তিনি বদলে দিয়েছেন এলাকার চেহারা। এসব উন্নয়ন কর্মকা-ের কারণেই একরকম অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন জাহিদ আহসান রাসেল। এবারের নির্বাচনেও জাহিদ আহসান রাসেল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে তার নাম অনেকটা চূড়ান্ত। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক টঙ্গী পৌরসভার মেয়র এ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান। তিনি সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন চেয়ে বঞ্চিত হন। এ আসনে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও হাসান সরকার গ্রুপের নেতৃত্ব ও আধিপত্যের বিরোধের কারণে কর্মীরা অনেকটা দিশেহারা। অপরদিকে সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মধ্যকার দীর্ঘ দিনের স্থানীয় বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করা হলেও সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তাই দলীয় অন্তঃকোন্দলের কারণে বিপুল ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন বিএনপি প্রার্থী। গুঞ্জন রয়েছে, এবারের সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপি প্রার্থী পরিবর্তন আনতে পারে। তবে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বেশ কয়েকজন। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ মান্নান এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন চাইতে পারেন। তবে তার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করবে। অপরদিকে সদ্য অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত হলেও সংসদ নির্বাচনে এ আসন হতে হাসান উদ্দিন সরকারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন তালিকায় আরও রয়েছেন- কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ডাঃ মাজহারুল আলম, গাজীপুর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট ডক্টর মোঃ সহিদ উজ্জামান, কেন্দ্রীয় শ্রমিক দলের কার্যকরী সভাপতি ও জেলা বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি সালাহ উদ্দিন সরকার, গাজীপুর সদর বিএনপির সভাপতি নাজিম উদ্দিন আহমেদ, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হান্নান মিয়া হান্নু ও গাজীপুর মহানগর বিএনপির সভাপতি প্রভাষক বশির উদ্দিন। এছাড়া সম্প্রতি জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা সাবেক সচিব নিয়াজ আহমেদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) কাজী মাহমুদ হাসানের আকস্মিক মৃত্যুর পর এ আসনে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে দলটির কার্যক্রম। কিন্তু সাবেক স্বাস্থ্য সচিব এম নিয়াজ আহমেদ গত বছর দলে যোগ দেয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে জাতীয় পার্টি। এছাড়াও তৃনমূল জনতা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ডাঃ নাজিম উদ্দিন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরার সদস্য আবুল হাসেম খান প্রার্থী হবেন বলে শোনা যাচ্ছে। গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর-সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন) ॥ শ্রীপুর উপজেলা ও গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন নিয়ে সংসদীয় আসন গাজীপুর-৩ গঠিত। আগে এ আসনটি শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল। সীমানা পুনর্গঠনে বাদ পড়ে কালিয়াকৈর উপজেলা। সংসদীয় এ আসনে শ্রীপুর উপজেলার সঙ্গে যুক্ত হয় গাজীপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর, ভাওয়াল গড় ও পিরুজালী ইউনিয়ন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১০টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টিতেই জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। বাকি দুইবার বিএনপি ও দুইবার জাতীয় পার্টি জয়লাভ করেছে। ১৯৯১ সালে দলের মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা এ্যাডভোকেট রহমত আলী। এরপর ১৯৯৬ সালে (১৫ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন বাদে সব কটি নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে তিনিই জয়লাভ করেন। তবে বার্ধক্যজনিত কারণে রহমত আলী এমপি এবার দলীয় মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হলে তার আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন কে পাবেন তা নিয়ে গাজীপুরের রাজনীতিতে বইছে গরম হাওয়া। রহমত আলী ও তার ছেলে দুর্জয়ের সমর্থকরা দাবি করেন, রহমত আলী এমপি তার নির্বাচনী এলাকাজুড়ে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ওই উন্নয়নের কারণে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। নানা উন্নয়ন কাজ করে নির্বাচনী এলাকাকে ঢেলে সাজিয়েছেন বলেই স্থানীয়রা ভালবাসার স্বীকৃতিস্বরূপ বার বার ভোট দিয়ে ’দাদা’কে নির্বাচিত করছে। আর তাই এবারের নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে প্রবীণ এ নেতার বিকল্প হিসেবে তার ছেলে এ্যাডভোকেট জামিল হাসান দুর্জয়ও প্রার্থী হতে পারেন। জামিল হাসান দুর্জয়ের নেতৃত্বের প্রতি বর্তমানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনসমূহের একটি বড় অংশের সমর্থন রয়েছে। বাবার পর তিনিই দলের প্রার্থী হবেন এ লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন তিনি। ইতোমধ্যেই দুর্জয় এলাকার ‘ভোটকেন্দ্র ভিত্তিক’ তৃণমূল উন্নয়ন সভা করেছেন। যা এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এবারের নির্বাচনে জামিল হাসান দুর্জয় আওয়ামী লীগের মনোয়ন চাইবেন বলে জানান তিনি। জেলার এ আসনে আওয়ামী লীগের গণভিত্তি বেশ মজবুত হলেও দলের স্থানীয় পর্যায়ে রয়েছে বেশ গ্রুপিং ও কোন্দল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নির্যাতিত নেতা-কর্মীসহ স্থানীয়দের পাশে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন তাদের হৃদয়ে স্থান করে নেন। গড়ে তোলেন নিজের শক্ত অবস্থান। ফলে শ্রীপুর উপজেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হয়ে তিনি গণসংযোগ ও উন্নয়ন কর্মকা-ের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। জনসমর্থনের ওপর ভর করে তিনি ২০০৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন দাবি করেন। এতে রহমত আলী ও তার ছেলে জামিল হাসান দুর্জয়ের সমর্থকদের সঙ্গে ইকবাল হোসেন সবুজের সমর্থকদের বিরোধ প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দলের স্থানীয় নেতা কর্মীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দু’পক্ষের বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের হামলা পাল্টা হামলায় হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তিনি এবারের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে তার কর্মী সমর্থকরা দাবি করেছে। ইকবাল হোসেন সবুজের সমর্থকরা জানান, এরই মধ্যে নেতৃত্বে প্রায় প্রতিটি এলাকায় ‘উঠোন বৈঠক’ করে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- তুলে ধরা হয়। তার এ কর্মকা- দলে ও স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তিনি তৃণমূল নেতা-কর্মীদের চাঙ্গা করে মন কেড়েছেন ও ভোটারদের মন জয় করেছেন। তিনি তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ করাসহ দলের কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করার কৌশল নিয়ে এগিয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ওই তিনজন ছাড়াও এ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় রয়েছেন- আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট হারিছ উদ্দিন আহমেদ, শ্রীপুর থানা আওয়াম লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট শামসুল আলম প্রধান ও গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবু আক্তার হোসেন খান বুলু। তারা প্রত্যেকেই নির্বাচনের জন্য দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। অপরদিকে বিএনপি এবার গাজীপুর-৩ আসনে হেভিওয়েট প্রার্থীর অভাবে ভুগছে। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও কম নয়। এ তালিকায় রয়েছেন- বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহীর কমিটির সহ স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ও ড্যাবের যুগ্ম সম্পাদক ডাঃ এসএম রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা এসএম রুহুল আমীন, গাজীপুর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান ফকির, জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সাখাওয়াৎ হোসেন সবুজ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার ফজলুল করিম ম-ল জুয়েল। এ ছাড়াও এ আসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী, গাজীপুর জেলা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক মোঃ জহিরুল হক ম-ল বাচ্চু, ইসলামী ঐক্যজোটের কেন্দ্রীয় কমিটির বহির্বিশ্ব সমন্বয়ক আল্লামা সাইয়্যেদ রফিকুল ইসলাম মাদানী রয়েছেন। গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) ॥ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের জন্মভূমি এটি। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত গাজীপুর-৪ আসন। জাতীয় নির্বাচনে এ আসনে ৬ বার জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। এরমধ্যে ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তানজীম আহমেদ সোহেল তাজ এ আসন থেকে নির্বাচিত হন। সোহেল তাজের পদত্যাগের পর ওই আসন থেকে তারই বোন সিমিন হোসেন রিমি ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও সিমিন হোসেন রিমি এ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের অনেকটা নিরাপদ আসন এটি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য সিমিন হোসেন রিমিও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হলেও এ আসনে দলের মধ্যকার কোন্দল ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দলের এক গ্রুপের নেতা কর্মীরা অপর গ্রুপের উপর একাধিকবার হামলা চালিয়েছে। দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় এ গ্রুপিং দেখা দিয়েছে। এবার আওয়ামী লীগের এই ‘বিভক্তি আর বিরোধ’ থেকেই সুবিধা নিতে চায় বিএনপি। কারণ বরাবরই জয়-পরাজয়ে ভোটের ব্যবধান হয় কম। আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীদের দাবি ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনের পরপরই নিজেদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে রূপ নেয়। দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে নেতা-কর্মীরা। বহিষ্কৃত ও কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলের পুরনো, পরীক্ষিত ও ত্যাগী অনেক নেতাকর্মী। দলের কোন্দল না মিটিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিলে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি আওয়ামী লীগের হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এ আসনে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ছাড়াও একাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থিতার জন্য শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভাগ্নে কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের উপদেষ্টা ও মরিয়ম ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আলম আহমেদ দীর্ঘদিন ধরে গণসংযোগ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করে যাচ্ছেন। কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মোল্লা, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন মেহেদী, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এ্যাডভোকেট আমানত হোসেন খানের মনোনয়ন চাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদের ভাই সাবেক এমপি আফসার উদ্দিন আহমেদ খান। বর্তমান সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমির কাছে এলাকার পরিস্থিতি ও দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগে কোন বিভক্তি নেই। যারা জনগণের সঙ্গে মিশতে পারে না, তারাই দূরে সরে থাকে। এটা নির্বাচনে কোন প্রভাবই ফেলবে না। অপরদিকে বিএনপিতেও দীর্ঘদিন থেকে বিরাজ করছে কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং। দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় স্থানীয় নেতা কর্মীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দলের অনেকেই মনে করেন। এবারের নির্বাচনে এ আসনেও বিএনপি হেভিওয়েট প্রার্থী শূন্যতায় ভুগছে। বিএনপির কা-ারি বলে খ্যাত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে মৃত্যুবরণ করায় এ শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। হান্নান শাহর অবর্তমানে এবারের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে তার ছেলে শাহ রিয়াজুল হান্নানের নাম শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়াও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জামাল উদ্দিন আহমেদ এলকায় জনপ্রিয় প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। তিনিও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আজিজুর রহমান পেরার নামও বিএনপিতে আলোচনায় আছে। এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে শামসুদ্দিন খান ও মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, বিএনএফর কেন্দ্রীয় নেতা এ্যাডভোকেট সারোয়ার-ই-কায়েনাত, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সহযোগী সংগঠন বাংলাদেশ কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মানবেন্দ্র দেব এবং গাজীপুর মহানগর জামায়াতের আমীর এসএম সানাউল্লাহ দল থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী বলে জানিয়েছেন। গাজীপুর- ৫ (কালীগঞ্জ, সিটির ৫টি ওয়ার্ড ও সদরের বাড়িয়া ইউনিয়ন) ॥ গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৯নং হতে ৪২নং ওয়ার্ড এবং গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়ন নিয়ে এ আসন গঠিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ ময়েজ উদ্দিন আহমেদের জন্মস্থান এটি। তিনি বর্তমান সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী এমপির পিতা। আওয়ামী লীগ এ আসন থেকে জয় পায় ৫ বার, আর বিএনপি পায় ৪ বার এবং জাতীয় পার্টি পায় একবার। ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত হন সাবেক সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দিন আহমেদ। তার মেয়ে মেহের আফরোজ চুমকী গত দু’টি সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। এর আগে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। এবারও তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশী। এ আসনের আওয়ামী লীগের আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য, ডাকসু’র সাবেক ভিপি এবং গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ’৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। তিনিও এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও চিত্রনায়ক ফারুকও এ আসনে প্রার্থী হতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে তার কর্মী সমর্থকরা দাবি করেছে। এ আসনের সংসদ সদস্য প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি এ নির্বাচনী এলাকার ব্যাপক উন্নয়নও করছেন বলে দলীয় নেতাকর্মীদের দাবি। তার প্রচেষ্টায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মুসলিম কটন মিল হামীম গ্রুপের নিকট হস্তান্তরের মাধ্যমে পোশাক কারখানা চালু করা হয়। এতে এলাকার বহু লোকের চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছে এবং কালীগঞ্জে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। এদিকে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য একেএম ফজলুল হক মিলন এ আসন থেকে দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে দলের স্থানীয় সূত্র জানায়। তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়াও জাতীয়তাবাদী যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এলবার্ট পি. কস্টা এবার বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা মনিরুজ্জামান এ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তিনি নবম সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে এ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। মনিরুজ্জামান বিএনপির সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত বলে জানা গেছে। এছাড়াও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) অঙ্গ সংগঠন জাতীয় শ্রমিক পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি আনোয়ারা বেগম, জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) সাবেক নেতা আজম খান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জেলা শাখার সেক্রেটারি আতিকুর রহমান, জামায়াতের গাজীপুর মহানগর সেক্রেটারি মোঃ খায়রুল হাসান, জাকের পার্টির মোঃ এখলাস উদ্দিন ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’র (চরমোনাই) গাজী আতাউর রহমান সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় রয়েছেন। এ আসনটি আওয়ামী লীগের শক্তিশালী ঘাঁটি হলেও নেতৃত্বের কোন্দলের জেরে দলের প্রভাবশালী দু’নেতার রশি টানাটানির কারণে দলের স্থানীয় ত্যাগী নেতা কর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় এখানকার নেতা কর্মীরা দৃশ্যমান দু’টি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘদিনের এ কোন্দল ক্রমেই বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে। আসন্ন নির্বাচনের আগেই এ কোন্দল না মেটালে নির্বাচনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে বলে স্থানীয়রা মনে করেন। একই অবস্থা বিরাজ করছে স্থানীয় বিএনপির মাঝেও। একনায়কতন্ত্র সিস্টেম বাস্তবায়নের জন্য দলের ত্যাগী নেতা কর্মীদেরকে স্থানীয় বিভিন্ন কমিটিতে রাখা হয়নি। প্রতিপক্ষ ভেবে ওইসব নেতা কর্মীদের হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়েছে। এসব নিয়ে দলের স্থানীয় কর্মী সমর্থকদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ ও কোন্দল বিরাজ করে আসছে।
×