ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমি এ আদালত মানি না, আর আসব না- যা খুশি শাস্তি দিন ॥ খালেদা

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  আমি এ আদালত মানি না, আর আসব না- যা খুশি শাস্তি দিন ॥ খালেদা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে শুনানি শুরু হয়েছে। পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর। রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতের বিচারক মোঃ আখতারুজ্জামান এই আদেশ প্রদান করেন। শুনানি চলাকালে খালেদার পক্ষে কোন আাইনজীবী আদালতে যাননি। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা না এলেও ঢাকা বারের সভাপতি বিএনপিপন্থী আইনজীবী গোলাম মোস্তফা খান আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাষ্য, পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি আদালতে আসেন। শুনানি সামনে রেখে গোটা এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরনো এই কারাগারের দুই দিকের সড়কেই যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। বন্ধ রাখা হয় আশপাশের দোকানপাটও। এছাড়া যেকোন অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি এড়াতে মোতায়েন করা হয় বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। সামনে প্রস্তুত ছিল ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও। এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমার শারীরিক অবস্থা ভাল না। আমার পা ফুলে গেছে। ডাক্তার বলেছে, পা ঝুলিয়ে রাখা যাবে না। এখানে আমি আদালতে বারবার আসতে পারব না। আপনাদের যা মন চায়, যতদিন ইচ্ছা সাজা দিয়ে দেন।’ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কেন্দ্রীয় কারাগারে অস্থায়ী এই আদালত বসানো হয়। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায়ে এই কারাগারেই সাজা ভোগ করছেন খালেদা জিয়া। শুনানির আগের দিন আদালত স্থানান্তর করতে গেজেট জারি করায় ক্ষোভ জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, এই মামলায় শুনানির জন্য আজকের দিন তো আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু একদিন আগে তড়িঘড়ি করে আদালত স্থানান্তর করে গেজেট দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ন্যায়বিচার বলে কিছু নেই। অবিচার হচ্ছে। কথা বলা যায় না। ইচ্ছামতো আপনারা যা খুশি সাজা দিয়ে দেন। আদালতে পুরোটা সময় খালেদা জিয়া ছিলেন হুইল চেয়ারে বসা। তার পরনে ছিল গোলাপি শাড়ি, পায়ে সাদা জুতা। বুক থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ছিল সাদা একটি কাপড়ে। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার শুনানি এতদিন চলছিল কারাগারের কয়েক শ’ গজ দূরে বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা সংলগ্ন কারা অধিদফতরের মাঠে বিশেষ এজলাসে। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রশাসনিক ভবনের ৭ নম্বর কক্ষকে ‘আদালত’ ঘোষণা করে সেখানেই দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার শুনানি করার নির্দেশ দেয়। এ কারাগারেই আরেকটি ভবনের দোতলার একটি কক্ষে সাত মাস ধরে বন্দী আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা। এতিমখানা দুর্নীতি মামলায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি একই বিচারক তাকে পাঁচ বছর কারাদ- দেন। এতিমখানা দুর্নীতি মামলার রায়ের পর খালেদা জিয়াকে একদিনও দাতব্য ট্রাস্ট মামলার শুনানিতে হাজির করা হয়নি। প্রায় প্রতি তারিখেই আদালতকে তার অসুস্থতার কথা জানানো হয়েছে কারাগারের পক্ষ থেকে। ফলে এ মামলায় যুক্তিতর্কের শুনানি আটকে রয়েছে সাত মাস ধরে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সকাল দশটার দিকে আদালতকক্ষে হাজির হন। দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল, আবদুল্লাহ আবু, শাহ আলম তালুকদারকে আদালতে তাদের নির্ধারিত জায়গায় বসে থাকতে দেখা যায়। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা না এলেও ঢাকা বারের সভাপতি বিএনপিপন্থী আইনজীবী গোলাম মোস্তফা খান আদালতকক্ষে ছিলেন। তার ভাষ্য, পর্যবেক্ষক হিসেবে তিনি আদালতে এসেছেন। এ মামলার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানকে আদালতের কার্যক্রম শুরুর আগেই আসামির কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। সোয়া বারোটার দিকে কারাকক্ষ থেকে প্রধান আসামি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসা হয় আদালত কক্ষে। আসামিদের কাঠগড়ার সামনে যেখানে খালেদা জিয়া হুইল চেয়ারে বসে ছিলেন, তার পাশেই টি টেবিলে ছিল টিস্যু আর পানি। তাকে কয়েকবার টিস্যুতে মুখ মুছতে দেখা যায়। খালেদা জিয়াকে আদালত কক্ষে হাজির করার পরপরই বিচারক মামলার কার্যক্রম শুরু করেন। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে বক্তব্য দেন দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং নতুন করে আদালতের স্থান নির্ধারণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তিনি। কাজল আদালতকে জানান, এই মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। মামলার দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্যেই প্রায় ৯ মাস ধরে শুনানি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের এই স্থানে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়েছে। এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আসামি খালেদা জিয়ার আইনজীবীর কাছে প্রজ্ঞাপনের কপি পাঠানো হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও তাদের ফোন করে জানিয়েছি। এছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে সকলকে অবহিত করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এখন আদালতে উপস্থিত নেই। কাজল এ অবস্থাতেই বিচার কার্যক্রম শুরু করতে আদালতের কাছে আর্জি জানান এবং মুন্না ও মনিরুলের কাছে জানতে চান তাদের আইনজীবীরা কোথায়। এরপর বিচারক বলেন, যেহেতু তারিখ নির্ধারিত ছিল, আইনজীবীরা উপস্থিত হননি। তাদের উপস্থিত হওয়ার জন্য কোর্ট এক ঘণ্টা মুলতবি করা হচ্ছে। ঢাকা বারের সভাপতি ও বিএনপিপন্থী আইনজীবী গোলাম মোস্তফা খান এ সময় দাঁড়িয়ে বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে রাতে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেউ আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে অবহিত নন। এ কারণে তারা সবাই বকশীবাজারের আদালতে গেছেন। আমি একজন অবজারভার হিসেবে এখানে এসেছি। আর আমাদের সবার ফোন বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। এখান থেকে যোগাযোগ করাও সম্ভব নয়। একজন অবজারভার হিসেবে আমার মনে হয় তারিখ পেছানোই যৌক্তিক হবে। আদালতের পরিস্থিতিও ‘বিচার কার্যক্রম শুরুর মতো নয়’ মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ৫০ ফুট বাই ২০ ফুটের এই ছোট জায়গার অবস্থাও তেমন ভাল নয়। আইনজীবীসহ সবার বসার জায়গা সেভাবে নেই। পরবর্তীতে সুবিধাজনক সময়ে ও জায়গায় বিচার কার্যক্রম চালানো হোক। বিচারক আখতারুজ্জামান তখন বলেন, প্রজ্ঞাপন তো কাল জারি হয়েছে। আর মামলার ডেট তো আগেই ছিল। তারিখ পেছাতে হলেও তো আইনজীবীদের পিটিশন লাগবে। এ সময় কোন আসামির আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় এবং ‘যোগাযোগ সম্ভব না’ বলে শুনানির নতুন তারিখ নির্ধারণের কথা বলেন ঢাকা বারের সভাপতি। তখন খালেদা জিয়া আদালতের উদ্দেশে বলেন, আমার আইনজীবীদের কেউ তো এখানে নাই। আমার শারীরিক অবস্থাও ভাল না। ডাক্তার বলেছে, এভাবে বেশিক্ষণ বসে থেকে পা ঝুলিয়ে রাখলে পা ফুলে যেতে পারে। হাতেও প্রচন্ড ব্যথা। এ অবস্থায় আদালত চলতে পারে না।’ বিচারকের উদ্দেশে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ অবস্থায় তার পক্ষে বার বার আদালতে আসা সম্ভব না, বিচারক যতদিন ইচ্ছা সাজা দিয়ে দিতে পারেন। খালেদা বলেন, সাজাই তো হবে, ন্যায়বিচার নাই এখানে। এরপর আইনজীবী গোলাম মোস্তফা এবং কাজলের কিছু বক্তব্য শোনেন বিচারক। পরে ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে তিন আসামির জামিন বাড়ানোর জন্য আবেদন জমা দিতে বলেন তিনি। ‘কারাগারের ভেতরে আদালত সংবিধান পরিপন্থী’ ॥ কারাগারের ভেতরে আদালত বসানো সংবিধান পরিপন্থী বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। বুধবার দুপুরে বকশীবাজার আদালত চত্বরে জড়ো হয়ে এমন মন্তব্য করেন তারা। সরকারী প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা বকশীবাজার কারা অধিদফতরের মাঠ থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের প্রতিবাদ জানিয়ে আদালত এলাকায় জড়ো হন তারা। ‘খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারা সবই জানেন’ ॥ আদালত স্থানান্তরের কথা না জানার কারণে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে উপস্থিত হননি জানালেও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, তারা সবই জানেন। আদালত স্থানান্তরের কথা জেনেও আদালতে হাজির হননি খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। বুধবার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর আজকের কার্যক্রম শেষে কারাগারের সামনে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। কাজল বলেন, আমরা মঙ্গলবার খালেদা জিয়া ও তার আইনজীবী যারা আছেন, তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি এবং তাদের গেজেট পাঠিয়ে দিয়েছি। এছাড়া দুপুরে আমরা সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমেও বিষয়টি সবাইকে জানিয়েছি। বুধবার আমরা সকাল থেকেই অপেক্ষায় ছিলাম। আদালতসহ আমরা উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু খালেদা জিয়ার পক্ষের যারা আইনজীবীার এই আদালতে বুধবার আসেননি।
×