ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ

সুষ্ঠু নির্বাচনে গণমাধ্যম

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সুষ্ঠু নির্বাচনে গণমাধ্যম

একাদশ জাতীয় নির্বাচন আর মাত্র কয়েক মাস। ভোট নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। এ পরিবর্তন যেন দুর্নীতিকে এগিয়ে না আনতে পারে। অব্যাহত উন্নয়নের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে। উন্নয়নের অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে যাতে অন্যের পকেটে ঢুকতে না পারে সে দায়িত্ব কঠিনভাবে পালন করতে হবে জনগণকে। যুগ যুগ ধরে যারা দুর্নীতির মাধ্যমে পকেট ভর্তি করেছে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে এ জাতীয় প্রার্থীদের বয়কট করতে হবে। তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে রাজনৈতিক দল এবং জনগণকে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেসব দল অংশগ্রহণ করবে তারা যেন সৎ, যোগ্য, আদর্শবান, দেশপ্রেমিক লোককে মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনের সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক আর প্রার্থীর সঙ্গে দলের সম্পর্ক। উন্নয়নের সঙ্গে দেশ ও জনগণের সম্পর্ক জড়িত। নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া অন্য কেউ উন্নয়ন করতে পারে না। উন্নয়ন আর নির্বাচন দুর্নীতিমুক্ত না হলে সেখানে সঠিক উন্নয়ন জনগণ দেখতে পায় না। বিগত সাধারণ নির্বাচনকালীন সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে লক্ষ্য করা যায়, সংবাদপত্রসমূহ তখন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মূল দুটি দল তথা জোটের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে তারা সর্বদা সচেতনভাবে ভারসাম্য রক্ষা করেছে। প্রথম পৃষ্ঠায় শেখ হাসিনার বক্তব্য থাকলে অবশ্য খালেদা জিয়ার বক্তব্যও থেকেছে। খালেদা জিয়ার সংবাদ যেভাবে পরিবেশিত হয়েছে শেখ হাসিনার সংবাদও সেই একই আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে। ছবি প্রকাশের ক্ষেত্রে একই পদ্ধতি লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্য, নেতৃবৃন্দের নির্বাচনী সভা, বক্তৃতা ইত্যাদিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সংবাদপত্রের পাতায় পরিবেশিত হয়েছে। রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক কোন্টি ভাল, কোন্টি মন্দ এই আলোচনায় না গিয়ে নির্বাচনের প্রতি জনগণের মধ্যে যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা দূর করে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার প্রশ্নটিই ছিল সেই মুহূর্তে জরুরী। পত্রিকাসমূহ সেই দায়িত্ব খুব সফলতার সঙ্গে পালন করেছে বলা যায়। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় বিগত দিনগুলোতে গণমাধ্যম সংস্থাগুলো কেবল ভোটের দিন যেখানে সন্ত্রাস, ভোট কারচুপি ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে সে সব স্থান সম্পর্কে তথ্য প্রচার করে থাকে। কিন্তু নির্বাচনের আগে স্পর্শকাতর কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে অবহিত করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখেনি। পূর্ব থেকে এগুলো প্রচার না করার জন্য প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকেও তেমন সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের পূর্ব সতর্কীকরণের জন্য যে সব ভূমিকা রাখা দরকার তা বিবেচনায় আনা জরুরী বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। ভোটে কোন্ প্রার্থী জয়ী হবে এ ব্যাপারে আগে জনসাধারণের কৌতূহলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এসব প্রসঙ্গে জনমত জরিপের প্রবণতা মুদ্রণ মাধ্যমগুলোতে দেখা গেলেও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এ যাবত তার কোন চিহ্ন মেলেনি। ভোটারদের কৌতূহল নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে এ জাতীয় মতামত জরিপের কাজ প্রশংসনীয় হতে পারে। লক্ষ্য করা গেছে, ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোতে অনেক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু ভোট গণনা সঠিক হলো কি না তা যাচাই করে সঠিক তথ্য প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সীমাবদ্ধতা পূর্বেকার সব নির্বাচনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা গেছে। ফল প্রকাশের উৎসাহ-উদ্দীপনার তোড়ে গণনা সঠিকতা, বেঠিকতা এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিয়ষটি বারবার গৌণ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে। জাতীয় সংবাদপত্রগুলো সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকদের মতামত প্রকাশের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে যে ভূমিকা পালন করছে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। নির্বাচনের যদিও এখনও চার মাস বাকি তবুও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো ইতোমধ্যেই নির্বাচনের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণবিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন গণবিতর্ক আয়োজনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, কোন কোন চ্যানেল সারাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী রাজনৈতিক গণবিতর্কমূলক অনুষ্ঠান সরাসরি বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে সম্প্রচার করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ জাতীয় অনুষ্ঠান অবশ্যই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে ফেলতে সহায়তা করবে। এদিকে চ্যানেল আই ইতোমধ্যেই নির্বাচনী ভাবনা শিরোনামে সংশ্লিষ্ট সুশীল সমাজের নাগরিক ও সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ের বিশিষ্টজন এবং রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে শুরু করেছে বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচনকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মহল কী ধরনের দায়িত্ব পালন করতে পারে তা আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। ভোটারদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত পর্যবেক্ষণ নীতিমালা অনুসরণের ব্যাপারে সচেতন থাকলে পর্যবেক্ষক দলগুলো বিতর্কের উর্ধে থাকতে পারে। উত্তরদাতারা নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষের মধ্যকার সমন্বয় সম্পর্কে বলেন, নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের কর্মকা-ের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় একটি অপরিহার্য বিষয়। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকাল থেকে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত এ ৬টি শক্তির মধ্যে সমন্বয় করে একটি যৌথ কমিটি করা যেতে পারে। এ কমিটির কাজ হবে তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে যৌথ পরিকল্পনার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করা। এ কমিটির কাজ হবে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচন সংক্রান্ত সকল কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করা এবং সর্বসম্মতিক্রমে বস্তুনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নেয়া। এসব কর্মকা-ের সঙ্গে সুশীল সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকদের যুক্ত করা যেতে পারে। পেশাগত নীতিমালা সংরক্ষণ করে এ সার্বিক কর্মকা-ের সঙ্গে গণমাধ্যমের সংশ্লিষ্টতা থাকা অত্যন্ত জরুরী। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার সময় থেকে গণমাধ্যমকে নিয়মিতভাবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের কাজগুলোকে বিস্তৃতভাবে গণমাধ্যমে প্রচার করে জনসমক্ষে তুলে ধরা যেতে পারে। মিডিয়া সার্বিক অর্থে একটি মনিটরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করতে হবে। প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকেও সমানভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচনপূর্ব পরিস্থিতি, নির্বাচনের দিন এবং পরবর্তী সময়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করার গুরুদায়িত্ব অবশ্যই গণমাধ্যম পালন করতে পারে। তবে সবচেয়ে জরুরী হলো গণমাধ্যমগুলোর বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা। যা ঘটছে তা যদি স্বাধীনভাবে তুলে ধরতে তারা ব্যর্থ হয় তা হলে সঠিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুশীলন করা সম্ভব হবে না। আর যৌথ কার্যপদ্ধতি অনুশীলনের বিষয়টি তো আইন করে সম্ভব নয়, তবে নিজেরা বসে একটি দিকনির্দেশনা তৈরি করে এগুতে পারেন। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নেয়া যেতে পারে। এছাড়া নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলগুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমে পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়ার চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারে। প্রকৃতপক্ষে পর্যবেক্ষকরা তাদের কাজ করছেন কিনা সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণের দায়িত্বটিও পালন করতে পারে গণমাধ্যম। তাছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কোন পক্ষের একা কাজ করার সুযোগ নেই। নির্বাচনকালীন সরকার, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। একাদশ জাতীয় নির্বাচন দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জনগণের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অতীতের যে কোন নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচন অধিক গুরুত্ব বহন করে। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থেই দুর্নীতিবাজ কালো টাকার মালিক অসৎ শ্রেণীর লোক ও দলকে বয়কট করার শপথ এখন থেকেই গ্রহণ করতে হবে। তা হলেই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির শক্তি দুর্বল হবে এবং মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। এ দায়িত্ব সম্মিলিতভাবে দেশপ্রেমিক সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে পালন করতে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই নির্বাচন ও উন্নয়ন জাতির জন্য সফলতা বয়ে আনবে। লেখক : গবেষক [email protected]
×