ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যাবাসিত না হওয়া পর্যন্ত ‘রোহিঙ্গা জোন’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৬:২০, ৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

প্রত্যাবাসিত না হওয়া পর্যন্ত ‘রোহিঙ্গা জোন’ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ মানবিক কারণে যখন আশ্রয় দেয়া হয়েছে, তখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত আলাদা ‘রোহিঙ্গা জোন’ প্রতিষ্ঠা করা যায় কিনাÑ তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে সুপারিশ উঠতে শুরু করেছে। নির্দিষ্ট জোনের আওতায় এ রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা না গেলে আইন-শৃঙ্খলাসহ সামাজিক যাবতীয় পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে বড় ধরনের আঘাত আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা যাতে সংশ্লিষ্ট জোনের বাইরে যেতে না পারে এবং ওই জোনে অনাহূত বহিরাগতদের যেন প্রবেশাধিকার না থাকে তা নিয়ে কঠোর কার্যকর ব্যবস্থা বহাল থাকতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ের বিভিন্ন বিদ্রোহী সংগঠন জন্ম নিয়ে আছে। এসব বিদ্রোহী সংগঠনের অনেকে আশ্রিতদের সঙ্গে ঘাপটি মেরে আছে। বিভিন্ন সময়ে এরা সাধারণ রোহিঙ্গাদের নানাভাবে উসকে দিয়ে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালায়। ফলে আশ্রিত হয়ে থাকার পরিবেশেই তাদেরকে রাখা অপরিহার্য। নচেত এসব ভিনদেশী নাগরিকরা আগামীতে দেশের জন্য বড় ধরনের ঝামেলার কারণ হয়ে যে দাঁড়াবে তা নিয়েও নানা সন্দেহের ডালপালা বিস্তৃতি লাভ করছে। রোহিঙ্গা ইস্যুর পরিস্থিতি নিয়ে সামগ্রিক পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন সূত্রমতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের নাগরিক লাখ লাখ রোহিঙ্গা সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণের আওতায় রাখতে এখনই প্রয়োজন কার্যকরী পদক্ষেপ। মিয়ানমার সরকারের একতরফা নীতি অর্থাৎ গোয়ার্তুমির মনোভাবের কারণে এদের প্রত্যাবাসন সমস্যা যে দীর্ঘায়িত হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও এরা সেদেশের স্থায়ী অন্য নাগরিকদের ন্যায় সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ফলে পরিণত হয়েছে অনগ্রসর শ্রেণীতে। মিয়ানমার সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাখাইন রাজ্যের যথাযথ উন্নয়ন যেমন ঘটায়নি, তেমনি এদের শিক্ষা-দীক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেই চলেছে। ফলে এই জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা একদিকে যেমন প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তেমনি কুসংস্কার ও উগ্রবাদ এদেরকে গ্রাস করেছে। এদেরই বড় একটি অংশ এখন বাংলাদেশে আশ্রিত। মানবিক কারণে সরকার আশ্রয় দিলেও এদের জীবন যাপন ও চলাফেরায় পরিবর্তন আনা দুঃসাধ্য। ফলে ইতোমধ্যেই আশ্রিত শিবিরগুলোতে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে শুরু করেছে। খুন, খারাবি, ডাকাতি, অপহরণ, চোরাচালানসহ এহেন কোন অপকর্ম নেই যার সঙ্গে এরা জড়াচ্ছে না। ফলে বিষয়টি দেশের জন্য ভিন্ন আঙ্গিকে বড় ধরনের দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবে বিস্তৃতি লাভ করছে। এই অবস্থায় শুধু আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে অস্থায়ী ভিত্তিতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সকল সংস্থার সদস্যের সংখ্যা প্রয়োজনীয়ভাবে আরও বৃদ্ধি করে অন্যান্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে দাবি উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করছেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যে দীর্ঘায়িত হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এর নেপথ্যে উভয় পক্ষ অর্থাৎ একদিকে মিয়ানমার এবং অপরদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সকলের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে যে দাবি উঠেছে তার সমাধান কখন হবে বা আদৌ হবে কিনা তাও সন্দেহের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল এখন কক্সবাজার জেলার উখিয়া ও টেকনাফ। ২ হাজার একর জমি বরাদ্দ দিয়ে এদের জন্য ৩০টি শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে আরও বহু। নিবন্ধিত হয়েছে প্রায় ১২ লাখ। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে সরকারী হিসেবে টেকনাফ থানার আওতায় বর্তমান জনসংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার আর উখিয়া থানার আওতায় জনসংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার। এই দুই উপজেলার জন্য রয়েছে দুটি থানা। আর সীমান্ত এলাকা সংলগ্ন হওয়ায় রয়েছে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)। এই দুই উপজেলা ও থানা এলাকায় যেহেতু এখন বাড়তি প্রায় ১২ লাখ ভিনদেশী নাগরিকদের অবস্থান হয়েছে তাদেরকে শৃঙ্খলার আওতায় আনতে অস্থায়ী ভিত্তিতে হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংস্থার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং যাবতীয় অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থায়ী বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশের জন্য বাড়তি ঝামেলা ও রীতিমতো বোঝায় যে পরিণত হয়েছে তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। ১৯৭৮ সাল থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে এসেছে। মধ্যে কয়েক দফায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসিত হয়েছিল। অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়ায় গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতের পর সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসা যে ঢল নামে তা নজিরবিহীন। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা সাড়ে ৭ লাখ। এর আগে যারা এসেছে, আশ্রিত হয়েছে এবং যারা শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভিন্ন দেশী এই নাগরিকদের সংখ্যা এখন ১২ লক্ষাধিক। ইতোমধ্যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও শক্তিধর রাষ্ট্রসমূহের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে তাদের দেশ থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নাগরিকদের ফিরিয়ে নেয়ার দফায় দফায় আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু সবই এখনও বিফলে রয়েছে। উল্টো মিয়ানমার পক্ষ যে শর্ত দিয়ে রেখেছে তাতে ক’জন রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর ভয়ভীতির কারণে রোহিঙ্গারা আদৌ যাবে কিনা তাও বড় ধরনের প্রশ্নবোধক। দেশী বিদেশী ত্রাণ সহায়তায় রোহিঙ্গারা এখন তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আশ্রিত হয়ে থাকার বিষয়টি দীর্ঘায়িত হলে এদের নিয়ে কী হবে। এছাড়া এখনও আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।
×