ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

তৎপর একটি কোম্পানি যার চেয়ারম্যান সুচি নিজে

রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:১২, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ গণহত্যা ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া চালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার জীবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পর এখন রাখাইন ইস্যুর সমস্যার সমাধানের কথা বলে মিয়ানমারের পক্ষে বিদেশ থেকে চাঁদার অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চাঁদার অর্থ প্রদানের জন্য মিয়ানামারের দুটি ব্যাংকে ৫টি এ্যাকাউন্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এসব এ্যাকাউন্টে মার্কিন ডলার, মিয়ানমারের মুদ্রা কিয়াত ছাড়াও বিদেশী অন্য মুদ্রা জমা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারতের দিল্লীতে মিয়ানমারের দূতাবাসের ওয়েবসাইটে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে লাল রঙের হরফে ‘অনুদান বা চাঁদা সংগ্রহ’ নামে একটি বিভাগ খোলা হয়েছে বলে উল্লেখিত আছে। সেখানে লেখা আছে ‘রাখাইন রাজ্য ইস্যুর সমস্যা সমাধানে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ সাহায্যও উল্লেখিত যে কোন এ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার অনুরোধ করা হল।’ সীমান্তের ওপারের সূত্র থেকে জানা গেছে, মিয়ানমার সরকারের আওতায় একটি প্রাইভেট কোম্পানি অর্থ সংগ্রহের এ কাজে নেমেছে। এ চাঁদা সংগৃহীত হচ্ছে দেশটির বিভিন্ন বিদেশী দূতাবাসের মাধ্যমে। যে ব্যাংক দুটির তিনটি এ্যাকাউন্ট এতে উল্লেখ করা হয়েছে সে ব্যাংকগুলো হচ্ছে মিয়ানমার ইকোনমিক ব্যাংক ও কেবিজেড ব্যাংক। সংগৃহীত অর্থ মিয়ানমারের ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন কর্মকা-ে ব্যয় করা হবে বলে উল্লেখ আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ নামের সংস্থাটি মিয়ানমারের একটি পাবলিক-প্রাইভেট কোম্পানি। এ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হলেন স্টেট কাউন্সিলর আউং সান সুচি ও ভাইস চেয়ারমান হলেন সে দেশের সমাজকল্যাণ ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আই। ওই ওয়েবসাইটে ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজের প্রধান তিনটি লক্ষ্য রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে রাখাইন রাজ্যের মানবিক সহায়তা, পুনর্বাসন ও উন্নয়ন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে মিয়ানমার সরকারে মুখপাত্র জো হোতাই ইতোপূর্বে অভিযোগ করেছিলেন ত্রাণ সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত দিতে আগ্রহী নয়। তার ওই বক্তব্যের পর বিশ্বের বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অথচ, প্রকারান্তরে দৃশ্যমান হল ওদেশের পক্ষেই রোহিঙ্গাদের নামে চাঁদা সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার আর্থিক সহায়তার জন্য বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। গেল মার্চ মাসে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল শুধু দশ মাসের জন্য রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৯৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন। সে অনুযায়ী বিদেশী আর্থিক সহায়তা যে পরিমাণে আসার কথা তাতে আশানুরূপ ফলাফল এখনও আসেনি। ফেসবুকের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ॥ রোহিঙ্গাবিরোধী উস্কানি ও বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অংহ্লাইংসহ বেশ কিছু পেজ বন্ধ করে দেয়ার কারণে ফেসবুকের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটেছে মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারের পার্লামেন্টেও প্রস্তাব দিয়েছে। ইউনিয়ন সলিডারিটি এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) বেশ ক’জন সংসদ সদস্যের এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে পার্লামেন্টের স্পীকার টি কোন মিয়ান্ট। ইউএসডিপি’র সংসদ সদস্য উ থাং আয়ে সে দেশের গণমাধ্যম কর্মীদের জানিয়েছেন, ফেসবুক একটি প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে। তিনি আরও বলেন, যারা দেশ রক্ষা করছে, তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া মানে দেশ ও দেশের মানুষের সম্মান নষ্ট হওয়া। প্রসঙ্গত মিয়ানমারের মুসলিম, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিষয়ে ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে ১৮টি এ্যাকাউন্ট ও ৫২টি পেজ বন্ধ করে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। বন্ধ হওয়া পেজের মধ্যে সেনাপ্রধান মিন অংহ্লাইংয়ের পেজও রয়েছে। সংসদ সদস্য উ থাং আয়ে বলেন, আমরা সংসদে প্রস্তাব দিয়েছি। সরকার এ বিষয়ে কথা বলেছে, তবে এটি যথেষ্ট নয়। প্রয়োজনে ফেসবুক ব্লক করে দিতে হবে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাবি বাড়ছে ॥ উখিয়া-টেকনাফে ৩০টি ক্যাম্পে অবস্থান করা রোহিঙ্গারা একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত পাল্টাচ্ছে। একেক দিন একেক রকমের দাবি দাওয়া তুলে ধরছে। তারা সহসা প্রত্যাবাসন না হওয়ার জন্য এসব কল্প কাহিনী সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে । লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে যেখানে ১ লাখকে স্থানান্তরিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার তখন তার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ তৎপরতা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি ক্যাম্পে আওয়াজ উঠেছে, আশ্রিত ক্যাম্প ছাড়া কোথাও এককদম নড়বে না। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে এ দেশে আশ্রয় দিয়েছে। স্থানীয় জনগণও তাদের শুরু থেকে সহযোগিতা দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের জায়গা করে দিতে নিজেদের ভিটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে স্থানীয়রা। কিন্তু কিছু অকৃতজ্ঞ রোহিঙ্গার নানা অত্যাচারে স্থানীয়রা বর্তমানে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। উখিয়া- টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশাপাশি ভাসানচরে তাদের জন্য অস্থায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এ কথা রোহিঙ্গারাও আগে থেকে জানে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মগজ ধোলাই করে পুরনো রোহিঙ্গা নেতারা বলে বেড়াচ্ছে, জনমানবহীন ভাসানচরের দ্বীপটি রোহিঙ্গাদের বর্তমান আশ্রয় শিবির থেকে অনেক দূরে। বন্যায় তা ডুবে যায়। বিপজ্জনক এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে। এমন জনমানবহীন একটি দ্বীপে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনজিও কর্মী বলেন, ঠেঙ্গারচর স্থানীয়ভাবে ভাসানচর নামেও পরিচিত। এ চরটি দৃশ্যমান হয় ১১ বছর আগে। বর্ষার মওসুমে তা মারাত্মকভাবে বন্যাকবলিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। তাছাড়া নিকটবর্তী বসতি থেকে এই দ্বীপে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। তাই রোহিঙ্গাদের কাছে মানবিক ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেয়া খুব কঠিন হয়ে পড়বে। ২০১৬ সালে অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, ধর্ষণ অগ্নিসংযোগের কারণে তারা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। উখিয়া- টেকনাফের অধিকাংশ রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী নয়। রোহিঙ্গারা এই দূরবর্তী দ্বীপে ভবিষ্যতে ত্রাণ এবং ওষুধ পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। এছাড়াও ক্যাম্পে তাদের আত্মীয়স্বজন থেকে আলাদা হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তারা সেখানে যেতে অনাগ্রহী বলে জানিয়েছেন এনজিও কর্মীরা। রোহিঙ্গা মাঝি আলী আকবর জানান, তার মতো লাখ লাখ রোহিঙ্গা নির্যাতনের ক্ষত শরীর নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। আমরা আশ্রয় পেয়েছি। উখিয়ার কুতুপালং এখন বিশ্বের সব চেয়ে বড় আশ্রয় শিবির।
×