ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুজবের কবলে পড়তে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচন

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  গুজবের কবলে পড়তে পারে আগামী জাতীয় নির্বাচন

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাইবার ক্রাইমের হাজার হাজার অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলনে সহিংসতা ছড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনার পর টনক নড়ে উঠেছে সরকারের। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হতে পারে এই ধরনের আশঙ্কা করছে গোয়েন্দা সংস্থা। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় নির্বাচনে গুজব ছড়ানো হয়েছে, নারীদের চরিত্র হনন, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করে অর্থ উত্তোলনসহ নানা ধরনের সাইবার ক্রাইম ক্রমবর্ধমান হওয়ায় আলাদা পুলিশের সাইবার সেন্টার বা ইউনিট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা গেছে, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক এ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, ওয়েবসাইট হ্যাকিং, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, মোবাইল ব্যাংকিং এ্যাকাউন্ট হ্যাকিং করে টাকা উত্তোলন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারসহ সাইবার অপরাধ আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের চরিত্র হনন করা হচ্ছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ও সাইবার সিকিউরিটি ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে যত অভিযোগ আসছে তার অধিকাংশই ফেসবুক নিয়ে। কিছু ই-মেইল সংক্রান্ত। আমরাও সবাইকে এটেন্ড করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এক একটি অভিযোগের নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় লাগে। তারপরও তিন মাসে আমরা ৬টি মামলার চার্জশীট দিয়েছি। গত বছর সরাসরি এসে অভিযোগ করেছিল ৫৬৬ জন। এর মধ্যে ২৩৩টি ঘটনার নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এছাড়া ‘হ্যালো সিটি’ এ্যাপসের মাধ্যমে অভিযোগ এসেছে ৫ হাজার ৮৪২টি। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে গড়ে প্রতিদিন ২টা থেকে ৩টা করে ফেসবুকে প্রতারণা ও হয়রানির অভিযোগ আসছে। সে হিসেবে শুধু রাজধানীর থানাগুলোতেও মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৪ হাজার অভিযোগ আসছে। বছরে যেটার পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৪০ হাজার অভিযোগ। এর বাইরে সারাদেশের থানা তো আছেই। এই ধরনের অভিযোগ শুধু পুলিশের কাছেই যাচ্ছে তা নয়, বিটিআরসি ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের হেল্প ডেস্কেও অভিযোগ হচ্ছে। সেগুলোর পরিমাণও নিতান্তই কম নয়। ফলে এই বিপুল সংখ্যক অভিযোগের সুরাহা কিভাবে হবে, এর কোন নির্দেশনা নেই। পুলিশ নিজেদের মতো করে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের প্রধান মাধ্যম হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, শতকরা ৭০ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে। সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে পুলিশের পাশাপাশি আইসিটি বিভাগে একটি সাইবার হেল্প ডেস্ক রয়েছে। এই ডেস্কে গত দু’বছরে ১৫ হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। কিছু অভিযোগ খুবই ভয়াবহ। অন্যের ছবিতে ছবি জুড়ে দেয়া (সুপার ইম্পোজ) এবং পর্নোগ্রাফি। তা ছাড়া ইউটিউব ও বিভিন্ন সাইটে এসব পর্নোগ্রাফি ও ছবি ‘আপ’ করার হারও বেড়েছে। দেশে উগ্রপন্থী এবং জঙ্গীরা ব্যাপকভাবে সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও, তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা বা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি নানা ধরনের প্রোপাগান্ডাও ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে। সর্বশেষ কোটা সংস্কার ও নিরাপাদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনেও ফেসবুকের ব্যবহার হয়েছে। একজন মারা গেছে বলেও খবর ছড়ানো হয়। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, সাইবার সেন্টার বা ইউনিটের জন্য পুলিশ প্রশাসনে ৩৬৯টি পদ সৃজনের অনুমোদন চেয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এর মধ্যে ডিআইজি ১টি, অতিরিক্ত ডিআইজি ২টি, পুলিশ সুপার ৩টি, এডিশনাল এসপি ৬টি, এএসপি ১৯টি, ইন্সপেক্টর ৬৫টি, এসআই (নিরস্ত্র) ১৩০টি, এএসআই ৩৯টি ও কনস্টেবলের ৭০টিসহ বিভিন্ন পদ রয়েছে। সারাদেশে ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধ দমনের পরিস্থিতি বিবেচনায় আলাদা সাইবার পুলিশ সেন্টার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ সেন্টারটি সাইবার ক্রাইম তদন্তে কাজ করবে। পুলিশ সদর দফতর থেকে ৫৮৫ পদ সৃষ্টির প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩৬৯টি পদ সৃজনের অনুমোদন দিয়েছে সম্প্রতি। সেটা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য অর্থমন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ব্যয় অনু শাখায় রয়েছে। আলাদা এ ইউনিটটি বাস্তবায়িত হলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলা, ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করে গুজব ছড়ানোসহ ইত্যকার সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। সাইবার ক্রাইম ইউনিট গঠন পরবর্তী বাস্তবায়ন শুরু হলে সাইবার অপরাধ হ্রাস পাবে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, বর্তমানে পুলিশের বিভিন্ন উইং সাইবার ক্রাইম ইউনিট থাকলেও দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কোন সাইবার ক্রাইম ইউনিট বা সাইবার সেন্টার নেই। প্রস্তাবিত সাইবার সেন্টার-এর কার্যক্রম সিআইডি’র অধীনে পরিচালিত হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে গত জুলাই মাসের প্রথম দিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৩৬৯টি পদের সম্মতি গত ১৬ জুলাই অর্থ বিভাগের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগ পাঠানো হয়। সাইবার ক্রাইম সেন্টারের উল্লেখযোগ্য পদগুলোর মধ্যে- ডিআইজি ১টি, অতিরিক্ত ডিআইজি ২টি, পুলিশ সুপার ৩টি, এডিশনাল এসপি ৬টি, এএসপি ১৯টি, ইন্সপেক্টর ৬৫টি, এসআই (নিরস্ত্র) ১৩০টি, এএসআই ৩৯টি ও কনস্টেবলের ৭০টিসহ বিভিন্ন পদ রয়েছে। এসব পদে এরই মধ্যে সম্মতি পাওয়া গেছে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও জঙ্গী দমনে নিয়োজিত পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করেন, জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম বন্ধে ফিজিক্যাল পেট্রোলিংয়ের চেয়ে সাইবার জগতে পেট্রোলিংয়ে জোর দিতে হবে। এর মাধ্যমে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। এজন্য সাইবার অপরাধ দমনে লোকবল বাড়ানোর পাশাপাশি টেকনিক্যাল সাপোর্ট বাড়ানো জরুরী বলেও মনে করা হচ্ছে। জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম দমন ছাড়াও অন্যান্য অপরাধ দমনে সাইবার জগতে নজরদারি বাড়ানো জরুরী। নতুবা রাজনৈতিক ও অ-রাজনৈতিক আন্দোলন, চরিত্র হনন, হ্যাকিং করে টাকা উত্তোলনসহ নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত করার জন্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই অপরাধীরা বেশি বেছে নিচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি।
×