ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের ডিজিটাল জয়যাত্রা

১২ ডিসেম্বর, ২০০৮ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে ঘোষণা করেছিল ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ পরিণত হবে। একটি উন্নত দেশ, সমৃদ্ধ ডিজিটাল সমাজ, একটি ডিজিটাল যুগের জনগোষ্ঠী, রূপান্তরিত উৎপাদন ব্যবস্থা, নতুন জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি সব মিলিয়ে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের স্বপ্নই দেখিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নপূরণ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের সারথী বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তিনি নিজেকে আধুনিক বিশ্বের এক তরুণ উদ্ভাবনী নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তার দুরদর্শিতা আর মেধার সমন্বয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। সাড়ে নয় বছরে বাংলাদেশে ডিজিটাল রূপান্তরের অভিযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক তথ্য ও সেবা পৌঁছে গেছে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। বিশেষজ্ঞরা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এই অবিস্মরণীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আখ্যায়িত করছেন ডিজিটাল রেনেসাঁ হিসেবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবক্তা সজীব ওয়াজেদ জয় স্বাধীনতার অভ্যূদয় বর্ষ ১৯৭১ সালে জন্ম নেয়ায় বঙ্গবন্ধু তার নাম রেখেছিলেন জয়। তার পিতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী। ৭৫ সালের বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ঘটনাপরবর্তী জয়ের স্কুল কলেজের পড়াশোনা ভারতে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জয় ভারতের ব্যাঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও গণিতে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন। পরবর্তীতে উচ্চতর গবেষণাও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে আরও একটি স্নাতক ডিগ্রী এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেডি স্কুল অব গভর্নমেন্ট থেকে জনপ্রশাসন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। ২০০৪ সালে দলের ক্রান্তিলগ্নে মা, মাটি ও মানুষের টানে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে মা শেখ হাসিনাকে তথ্যভিত্তিক পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমেই মূলত দেশের আর্থসামাজিক চিত্র বদলে দেয়ার লক্ষ্যে পথচলার শুরু। পরবর্তীতে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে যখন অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠানোর চূড়ান্ত প্রক্রিয়া শুরু করছিল, তখন তিনি গণতন্ত্রের অনিশ্চিত গন্তব্যের বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে এনেছিলেন। একইসঙ্গে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করে বিশ্বজনমত তৈরি করেছিলেন। ২০০৯ সালে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের পথে দেশের নতুন অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর থেকে তিনি দেশের ডিজিটাল রূপান্তরে ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিলেন। ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তাকে রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্যপদ প্রদান এবং প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবেও নিযুক্ত করা হয়। উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বর্তমান এবং ভবিষ্যত বিষয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগে তিনি অপার সম্ভাবনাময় উন্নত ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে নিজের সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। সরকারের সাড়ে নয় বছরে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নের বদৌলতে বদলে যায় দেশের আর্থ-সামাজিক চিত্র। ব্যাপক সাফল্যের মধ্য দিয়ে ২০১৫ সালের শেষ নাগাদ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন ও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। ২০১৫ সালের শুরু থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত তিন বছরের নিবিড় পর্যবেক্ষণে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাওয়ার তিনটি সূচকের মধ্যে সব কটিই পূরণ করায় জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র দিয়েছে গত ২৩ মার্চ। এর ফলে জাতিসংঘের বিবেচনায় উন্নয়নশীল দেশের পথে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু! সরকারের ডিজিটাল পরিক্রমায় বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে শামিল হতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আর এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে তথ্যপ্রযুক্তি। সরকারী সেবায় ডিজিটাল বিপ্লব স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবোটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো ডিজিটাল বিপ্লবের সূচনা করেছিল। ডিজিটাল বিপ্লবের এই শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন একদিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়। ডিজিটাল বিপ্লব বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ বাস্তবায়নে সহায়তা করছে। সরকারের বিভিন্ন সেবা ডিজিটাল প্রযুক্তির সাহায্যে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে বহুল আলোচিত বিশ্বের বৃহত্তম ওয়েব পোর্টাল ‘জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে বাংলাদেশে। সরকারের ৫৮টি মন্ত্রণালয়, ৩৫৩টি অধিদফতর ও সংস্থা দেশের ৮টি বিভাগ ৬৪টি জেলা ৪৯১টি উপজেলা ৪৫৫৪টি ইউনিয়নকে সংযুক্ত করে ২৫ হাজার ওয়েবসাইট নিয়ে তৈরি করা হয়েছে পোর্টালটি। এই পোর্টালে রয়েছে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাসহ ২০ লাখেরও বেশি কনটেন্ট, বিভিন্ন ধরনের ৪০ হাজার ছবি, সাত লাখের বেশি ই-ডিরেক্টরি, সরকারী সকল ধরনের জেলাভিত্তিক ই-সেবা এবং ই-গবর্নেন্সের তথ্য পাওয়া যাবে। এই ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে যে কেউ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিটি সেবা সম্পর্কে জানতে পারবে এবং প্রতিটি জেলার নিজ নিজ ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে সরকারী সেবা জনগণের কাছে খুব সহজে পৌঁছাতে পারছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপের সুফলগুলো মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় হয়ে উঠেছে সরকারের অন্যতম সক্রিয় মন্ত্রণালয়। জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে নাগরিকরা বিভিন্ন ই-সেবা পেতে পারেন। ই-সেবার মধ্যে ভর্তির আবেদন, ট্রেজারি চালান, জমির পরচা, জন্মনিবন্ধন পাসপোর্ট, ভিসা ও ইমিগ্রেশন, অনলাইন আবেদন, অনলাইন নিবন্ধন, বিদেশে চাকরির নিবন্ধন, হজযাত্রার নিবন্ধন, বিভিন্ন ধরনের অফিশিয়াল বা সরকারী ফরম সংগ্রহ, ট্যাক্স বা আয়কর রিটার্ন দাখিল, দ্য ন্যাশনাল ডাটা, ভূমি রেকর্ড ডিজিটালকরণ, ই-গবর্ন্যান্স ও ই- সেবা, টেন্ডার বা দরপত্রে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কাজকর্ম অনলাইনেই সম্পন্ন করা যায়। সর্বোপরি প্রধান সেবাগুলোর মধ্যে ২২০টিরও বেশি সরকারী সেবা এখন মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। ডিজিটাল সেবা জনগণের হাতের এনে দিয়েছে কলসেন্টার ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি কল সার্ভিস ৯৯৯ নম্বরে ডায়াল করলেই মিলছে জরুরী এ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশী সেবা। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে চালু হয়েছে জরুরী সেবা ‘৯৯৯’। যেকোন জরুরী যোগাযোগ যেমন ফায়ার সার্ভিস, অভিযোগ কেন্দ্র, পুলিশ ও হাসপাতালের তথ্য এখন খুঁজে পাবেন সহজেই। এ ছাড়া ও দুর্নীতি দমন কমিশন ১০৬, চাইল্ড হেল্প লাইন ১০৯৮, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল ১০৯ (সকল অপারেটর থেকে) ১০৯২১ (জিপি ও বাংলালিংক বাদে), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের অভিযোগ ব্যবস্থা কেন্দ্র ১০০, সরকারী আইন সেবার জন্য ১৬৪৩০ নম্বরে ডায়াল করলেই কল সেন্টারসমূহ থেকে বিনামাশুলে মিলছে প্রয়োজনীয় তথ্য সেবা। কৃষি কল সেন্টার ১৬১২৩, বিটিসিএল ১৬৪০২ বাতায়ন ১৬২৬৩ মহিলা সংস্থা ১০৯২২, দুর্যোগের আগামবার্তা ১০৯৪১, বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬২৩৬ প্রবাসবন্ধু কল সেন্টার ০৯৬৫৪৩৩৩৩৩৩, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান ০১৭৯৯০৯০০১১ জাতীয় পরিচয়পত্র ১০৫ ঢাকা ওয়াসা ১৬১৬২, ইউনিয়ন পরিষদ হেল্পলাইনের সেবার জন্য ১৬২৫৬ নম্বরে ডায়াল করলেই কল সেন্টারসমূহ থেকে নির্ধারিত মাশুলে মিলছে প্রয়োজনীয় তথ্য সেবা। সরকার দেশব্যাপী ৯ হাজার গ্রামীণ ডাকঘর ও প্রায় ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ সারাদেশের উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কানেক্টিভিটি স্থাপনের জন্য বাংলাগবর্নেট ও ইনফো সরকার-২,৩ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা ও উপজেলার সরকারি অফিস, ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রসমূহকে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। সরকারী অফিস, ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রসমূহে ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশকে ডিজিটাল রূপান্তরের অভিযাত্রায় সারাদেশে ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র, জেলা তথ্য সেল ও জাতীয় তথ্য সেল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ই-সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সরকার নানা ধরনের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর পরিষেবা চালু করার ফলে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমেছে। বদৌলতে মানুষের সময়, অর্থ দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে। এসব পরিষেবার মতো আগামী দিনগুলোতে আরও অনেক সেবা চালু হবে বলে আমরা আশা করি। ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আগামী ১০ বছরে এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে হবে, যাতে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। এ পরিবর্তন নিঃসন্দেহে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লবের হাতছানি দিচ্ছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে একটি মডেল হিসেবে তৈরি করেছে। শিক্ষায় ডিজিটাল বিপ্লব ‘তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা নয়, শিক্ষায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার’-এই স্লোগানকে সামনে রেখে বিশ্বায়নের যুগে উন্নত দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ও শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়েছে। শিক্ষায় প্রচলিত ধারার শিখন-শেখানো পদ্ধতির পরিবর্তে তথ্যপ্রযুক্তির সংযোগ ঘটানো হয়েছে। সারাদেশে প্রায় ৩৫০০০ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট মডেম ও স্পীকারের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। এ শ্রেণীকক্ষকেই বলা হচ্ছে ‘মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম’। কঠিন, দুর্বোধ্য ও বিমূর্ত বিষয়সমূহকে ছবি, এ্যানিমেশন ও ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সামনে সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করার জন্য দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করা হয়েছে। দেশের সকল শিক্ষকদের একটি কমন প্লাটফরমে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ কাউন্সিলের সহযোগিতায় এটুআই প্রোগ্রাম শিক্ষক বাতায়ন, শিক্ষার্থীদের জন্য কিশোর বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষকগণ তাদের তৈরিকৃত ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, এনিমেশন বাতায়নে শেয়ার করেন এবং অন্য শিক্ষকগণ তা প্রয়োজনে ডাউনলোড করে নেন। গ্রাম-শহরের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্য দূর করছে শিক্ষক বাতায়ন ও কিশোর বাতায়ন। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ই-লার্নিং প্লাটফরমে ‘শিখুন...যখন যেখানে ইচ্ছে’ স্লোগানকে ধারণ করে ‘মুক্তপাঠ’ নামে বাংলা ভাষায় নির্মিত একটি উন্মুক্ত ই-লার্নিং প্লাটফর্ম চালু করা হয়েছে। এ প্লাটফর্ম থেকে আগ্রহী যে কেউ যে কোন সময়ে যে কোন স্থান থেকে অনলাইন কোর্সে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারছেন। এই প্লাটফর্মে সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এমনকি দেশের সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও ‘মুক্তপাঠ’ থেকে বৃত্তিমূলক শিক্ষা গ্রহণ করে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারেন। মুক্তপাঠে অনলাইন কোর্সের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন কুইজ, এসাইনমেন্ট, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং সফলভাবে কোর্সটি সমাপ্ত করে সার্টিফিকেট লাভ করতে পারছেন। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং ও মেইনটেনিং এর জন্য তৈরি করা হয়েছে এম এমসি এ্যাপ। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে শ্রেণী কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষকদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শেখার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে এবং ক্লাসে তাদের একঘেয়েমি ভাবও দূর হয়েছে। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাত্রা বেড়েছে এবং শিক্ষার গুণগতমানেও পরিবর্তন ঘটছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় আনয়ন, ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা বোর্ডগুলোর আওতায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওয়েবসাইট তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষক নিয়োগ ও নিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, পরীক্ষার ফলাফল, হাজিরা ব্যবস্থাপনা, ছুটি ব্যবস্থাপনা, হিসাব ব্যবস্থাপনাসহ সকল কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষা ব্যবস্থা আমূল পাল্টে দিয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলা ও ইংরেজী ভার্সনের সকল পাঠ্যপুস্তক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে ওয়েবসাইটে ই-বুক আকারে পাওয়া যাচ্ছে। ই-বুকসমূহ কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন সেটের মাধ্যমে সহজেই পড়া যাচ্ছে। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বয়ংক্রিয় নজরদারির আওতায় আনয়নের লক্ষ্যে চালু করা হচ্ছে পিয়ার ইন্সপেকশন পদ্ধতি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ক্রমান্বয়ে রোবটিকস, বিগ ডাটা এ্যানালিটিকস কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে জন্য সারাদেশে স্থাপন করা হয়েছে ১২৯টি বিশেষায়িত ল্যাব। সরকারের আইসিটি ইন এডুকেশন মাস্টার প্ল্যান (২০১২-২০২১) ও ই-লার্নিং কার্যক্রমের আওতায় ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী একুশ শতকের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে উঠছে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×