ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না’

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৭ আগস্ট ২০১৮

 ‘কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না’

মোরসালিন মিজান ॥ তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,/কোলাহল করি সারা দিনমান কারও ধ্যান ভাঙিব না...। পুরনো চিন্তা সেকেলে ধ্যান ভাঙার অহর্নিশ লড়াই। চির বিদ্রোহ। সাম্যের সমাজ আর মানবিক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন। এভাবে একটা জীবন। তবু হায়, কবির চাওয়া পূরণ হয়নি! হয়নি যে, জীবদ্দশায় বারবার তিনি তা উপলব্ধি করেছেন। ক্লান্ত অভিমানী কবি তাই লিখেছেন, ‘আমাদের এই যে দেশ আর সমাজ, এ একদম মরুভূমি হয়ে পড়েছে। ঘড়ায় ঘড়ায় পানি এনে অনেক সেঁচে দেখলাম, তাতে এ-মরুর কিছুই করা গেল না। তাই এবার সাগরের পানে চলেছি। দেখি, মেঘ হয়ে ফিরে এসে জল হয়ে ঝরে পড়ে এ-কে সুজলা-সুফলা করতে পারি কি না।’ সাগরের পানে সেই যে যাওয়া, আর ফিরে আসেননি তিনি। একরকম বলে কয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ ১২ ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ সোমবার বিদ্রোহী কবির ৪২তম প্রয়াণ দিবস। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের এই দিনে মহাপ্রস্থান গ্রহণ করেন তিনি। নিশ্চল নিশ্চুপ/ আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ...। গন্ধবিধুর ধূপ হয়ে জ্বলা দুখুমিয়াকে আজ পরম শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করবে বাঙালী। কবির অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মানবতাবাদের জয়গান হবে সর্বত্র। কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নতুন যুগের স্রষ্টা। নিজের লেখায় সাম্প্রদায়িকতার তীব্র নিন্দা করেছেন। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অবস্থান। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কলম হাতে লড়েছেন। নিজের জাত চেনাতে কবির উচ্চারণ- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর-/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!’ কাজী নজরুল ইসলাম অমর অক্ষয়। মৃত্যুর দীর্ঘকাল পরও এতটুকু ম্লান হননি। বিস্ময়কর আলো হয়ে জ্বলছেন। পথ দেখিয়ে চলেছেন পথহারাদের। তাঁর কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বৈচিত্র্যয় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভা-ারটির স্রষ্টা তিনি। অসাম্প্রদায়িক এই কবি বাঙালীর চিন্তা-মনন ও অনুভূতির জগতে নানাভাবে নাড়া দিয়েছেন। অন্যান্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে ভিন্ন উচ্চতায় আসীন করে। এ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে সকল নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন কবি। মানবতার বাণী প্রচার করেন। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা’। এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এই কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আরও কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোাহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থেও ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো দারুণ হৈচৈ ফেলে দেয় সে সময়। গদ্য রচনার সময়ও স্বতন্ত্র চিন্তাকে প্রাধান্য দিয়েছেন নজরুল। তাঁর প্রথম গদ্য রচনা ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকেই তার সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। এখানে বসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ গল্পগুলো। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সংকলন ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সংকলন ‘যুগবাণী’। তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে সঙ্গীত। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তাঁর সৃষ্ট রাগ বিস্মিত করে বড় বড় পন্ডিদের। কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের শুরুটা ছিল ভীষণ অনিশ্চয়তার। ক্ষণজন্মা কবি ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান নজরুলের পড়ালেখার শুরু মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। রুটির দোকানে কাজ শুরু করেন কবি। বালক বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যোগ দেন লেটো দলে। এই লেটো দলেই তার সাহিত্যচর্চার শুরু হয়। পরে মসজিদের মুয়াজ্জিন, মাজারের খাদেম হিসেবেও কাজ করেছেন। যৌবনে সেনা সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতি। এভাবে অত্যন্ত বর্ণাঢ্য আর বিচিত্র জীবনযাপন করেন নজরুল। তবে ১৯৪২ সালে অগ্রজ রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন তিনি। এ বছর চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত নজরুল বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন তিনি। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগ ভোগের পর এখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। আজ জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে বিশেষ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করবে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত নজরুল ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন পরিবেশনা ছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্মাননা জানানো হবে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলকে। শিল্পকলা একাডেমি আজ জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এ আয়োজন থেকে কবিকে শ্রদ্ধা জানাবেন শিল্পীরা। বাংলা একাডেমি আগামী বৃহস্পতিবার বিকেলে কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। ‘নজরুলকাব্যে মিথিক-ঐতিহ্যিক প্রতিমা : ফিরে দেখা’ শীর্ষক একক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী। সভাপতিত্ব করবেন জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
×