ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

অনিশ্চয়তার অন্ধকারে সীতাকুন্ডের আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ৯শ’ মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 অনিশ্চয়তার অন্ধকারে সীতাকুন্ডের আশ্রয়ণ কেন্দ্রের ৯শ’ মানুষ

জাহেদুল আনোয়ার চৌধুরী,সীতাকুন্ড ॥ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে রাস্তা,স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রয়েছে বাড়বকুন্ড ও বারৈয়াঢালা আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১২০ছিন্নমূল পরিবারের নয় শ’ মানুষ। ফলে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে আছন্ন হয়ে পড়ছে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত আশ্রয়ণ এলাকার এসব শিশুর জীবন। একইভাবে এসব আশ্রয়ণ প্রকল্প পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় যাতায়াতে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। স্যানিটেশন ব্যবস্থাও করুণ। একইভাবে অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসের মতো আশঙ্কা দিন দিন যাপন করতে হয় এসব আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসরত মানুষকে। বিশেষ করে আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারী বয়স্ক পুরুষ/মহিলা সকালে অন্নের খোঁজে বের হয়ে সন্ধ্যায় যখন ঘরে ফেরে তখন খুব কষ্টকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভাঙ্গা সরু আঁকাবাঁকা, গর্ত রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন তারা অন্নের খোঁজে সকালে বের হয় সন্ধ্যায় ফিরে আসে। সম্প্রতি উপজেলার বাড়বকুন্ড শুকলালহাটের আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শন করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি মোঃ কামরুজ্জামান। পরিদর্শন পরবর্তী তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের লোকদের আশ্বস্ত করেন শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত ও স্যানিটেশনসহ বিভিন্ন বিষয়ে জেলা মিটিংয়ে উপস্থাপন করবেন এবং সরকার যদি কোন বরাদ্দ প্রদান করে আমরা ত্বরিত গতিতে তা বাস্তবায়ন করব বলে আশ্বস্ত করেন স্থানীয় ইউপি সদস্য নাছির উদ্দিন সেলিমকে। উপজেলা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে এই আশ্রয়ণ প্রকল্প শুরু পরিকল্পনা হাতে নিয়ে ২০০০সালের ১২ফেব্রুয়ারি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সীতাকুন্ড উপজেলার বাড়বকুন্ড শুকলালহাটস্থ ভায়েরখিল এলাকার পূর্বদিকে দুই কিলোমিটার এবং বারৈয়াঢালা ইউনিয়নের ছোট দারোগারহাট বাজারের পূর্বদিকে তিন কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ের ওপর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুটি আশ্রয়ণ প্রকল্প । এতে প্রতিটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৬০টি পরিবার করে উভয় আশ্রয়ণ প্রকল্পে ১২০টি পরিবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ছিন্নমূল ও ভাসমান পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে প্রতি পরিবারকে ১০ শতক জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়। এদের দেখার দায়িত্ব দেয়া হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও ওয়ার্ড সদস্যগণকে। সরেজমিনে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিবাসীরা কৃষি খামার, বাসাবাড়ির কাজ, দিনমজুর কিংবা ভ্যান বা রিক্সাচালক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ/মহিলা ভিক্ষা করে। তবে অধিকাংশই ভাসমান। এসব পেশার উর্পাজন ভাল না হওয়ায় অধিকাংশ পরিবারের মধ্যে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। মহিলারা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। দারিদ্র্য তাদের নিত্য সঙ্গী হওয়ায় অধিকাংশ পরিবারকে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয়। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ওই এলাকার অধিকাংশ কর্মজীবী মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়ে। এছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় শিক্ষার কোন ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার আলো বঞ্চিত হয়ে নিরক্ষর থাকছে ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা। আর কোন রকমে কষ্ট করে এসএসপি সমমান পাস করলেও অর্থের অভাব ও যাতায়াতের অসুবিধা থাকায় কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের শিশুরা স্কুলে পড়ালেখা সামান্য পরিমাণ করলেও বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় বিয়ের সময় হলেও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে উপযুক্ত মেয়েদের বিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। উপজেলার বারৈয়াঢালার ছোট দারোগারহাট আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা অজিউল্ল্যাহ (৪০) জানান,‘প্রকল্পের শুরুতেই প্রতিটি পরিবারকে অনুদান ও ঋণ সহায়তাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রকল্পের কার্যক্রমও স্তিমিত হয়ে পড়ে। তবে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকার বর্তমানে বার বার ক্ষমতায় থাকলেও আমাদের ভাগ্যের তেমন কোন উন্নতি হয়নি। একইভাবে উপজেলার বাড়বকুন্ড শুকলালহাটস্থ ভায়েরখিল আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আবদুল কাদের জানান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের আশপাশে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় নিরক্ষর হয়ে আছে পাঁচ থেকে বারো বছরের অধিকাংশ শিশু। কয়েক শিশু দুই কি.মি. পথ বেয়ে পড়ালেখা করলেও তা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অতিক্রম করে আর্থিক অনটনের কারণে আর বেশি পড়ালেখা করা সম্ভব হচ্ছে না। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কেউ কেউ আবার সন্তানকে লেখাপড়া করাতে উদ্যোগী হলেও তারা সন্তানকে দুই কিলোমিটার দূরের স্কুলে পাঠাতে রাজি নয়। আমি বয়স্ক লোক, আমার পক্ষে এই পাহাড়ি সরু,গর্ত,পিছলে রাস্তা বেয়ে সকালে একবার অন্নের খোঁজে বের হয়ে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা খুবই কষ্টকর। অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসের সম্ভাবনা নিয়ে আমরা দিন যাপন করি,স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রকল্প শুরুর সময়ে সেগুলো করেছে, এখনও সেগুলো রয়ে গেছে, এখন অনেকটাই বেহাল অবস্থা বিরাজমান। ছকিনা বেগম (৪৪) নামে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অপর এক মহিলা জানান, আমরা অভাবের কারণে ছোটবেলায় লেখাপড়া করিনি। এখন আমার মেয়েদের কিছু পড়ালেখা করালেও আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে উপযুক্ত বিয়ে দেয়া যাচ্ছে না। বিদ্যুত না থাকায় সন্ধ্যা হতে না হতে এখানে এক ভুতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। অনেকে মেয়েকে কোন রকম ভাল পাত্র দেখে বিয়ে দেয়ার জন্য এই আশ্রয়ণ প্রকল্প ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার আমাদের এই আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দিয়েছে,এখন যদি একটু মুখ ফিরে তাকায়,তাহলে আমরা কোনমতে ছেলেমেয়ে নিয়ে ভবিষ্যত জীবন করতে পারব। আশ্রয়ণ প্রকল্পে শিশু শিক্ষা নিশ্চিতের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নুরুচ্ছাফা বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক হলেও সরকারী নীতিমালা ছাড়া আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে,সরকার যদি কখনও এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয় তাহলে আমরা বাস্তবায়ন করব।
×