ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ সমাবেশ

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 উখিয়ার কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভ সমাবেশ

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রিত হাজার হাজার রোহিঙ্গা শনিবার সকালে উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। সমাবেশে এদের প্রধান স্লোগান ছিল, ‘আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই-কিন্তু নাগরিকত্বের অধিকার না পেলে যাব না।’ সমাবেশে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে তাদের ওপর বর্বর নির্যাতনের ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবি জানায়। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কুতুপালং বাজারের সামনে প্রধান সড়কে মাথায় ফিতা বেঁধে এরা প্রথমে বিক্ষোভ মিছিল ও পরে সমাবেশ করেছে। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রোহিঙ্গা নেতা নুরুল হাকিম, আবু হানিফা, রশিদ উল্লাহ, মোঃ আইয়ুবসহ কয়েকজন। রোহিঙ্গারা প্রথমে বিক্ষোভ মিছিল করে। পরে উখিয়ার প্রধান সড়কের পার্শ¦বর্তী খোলা স্থানে সমাবেশে অংশ নেয়। রোহিঙ্গা নেতারা তাদের বক্তব্যে দাবি করেন, তাদের সম্মানের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। রাখাইনে তাদের ফেলে আসা সহায় সম্বল ফেরত দিতে হবে। সমাবেশে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবনে কালোদিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ্য, শনিবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার এক বছর পূর্ণ হয়েছে। বছরপূর্তির এই দিনে এরা সংগঠিত হয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। তবে এর নেপথ্যে কিছু এনজিও’র ইন্ধন ও সাহায্য সহযোগিতা রয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত পুরনো কিছু রোহিঙ্গা নেতা নতুনভাবে আসা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে না যাওয়ার বিষয়ে প্রতিনিয়ত ইন্ধন যোগানোর কাজে লিপ্ত রয়েছে। কিছু এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে সলাপরামর্শ করে রোহিঙ্গা নেতারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের শনিবার বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলের জন্য যাবতীয় তৎপরতা চালিয়েছে। শনিবার রোহিঙ্গাদের এ ধরনের বিশাল বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ এই প্রথমবারের মতো ঘটেছে। সমাবেশে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়ার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানায় রোহিঙ্গা নেতারা। তারা বলেন, মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করতে হবে, যাতে দেশটির সরকার দ্রুত নিরাপত্তা দিয়ে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, আমরা কি চাই তা জানান দেয়ার জন্যই আমাদের এই প্রয়াস। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। এদিকে পুলিশের পক্ষে জানানো হয়েছে, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের এ ধরনের সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের কোন অনুমতি ছিল না। ক্যাম্প ইনচার্জের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন ধরনের মিছিল মিটিং ও সমাবেশ নিষিদ্ধ রয়েছে। এর পরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে মাথায় কাপড় বেঁধে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করার নেপথ্যে কোন না কোন মহলের গোপন ইন্ধন রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন হওয়ার কথা বললেও এর পাশাপাশি নাগরিকত্বের দাবিটিও তুলে ধরছে। মোদ্দা কথায়, মিয়ানমার আগেই বলেছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ ছাড়া তারা কাউকে নেবে না। এদিকে রোহিঙ্গারা বলছে, নাগরিকত্বের অধিকার পাওয়া ছাড়া তারা যাবে না। শনিবার সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা আরও বলেন, নাগরিকত্বসহ সব অধিকার না পেলে আমরা এখানে প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করব। ওদিকে, নিরাপদ প্রত্যাবাসন বিলম্বিত করতে মিয়ানমার পক্ষ নানা টালবাহানা অব্যাহত রেখেছে। এই অবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যুর সফল সমাধান প্রশ্নে নানা জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করেছে। উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী পুরুষ প্রাণ হারায়। তাদের বাড়িঘর একের পর এক জ্বালিয়ে দেয়া হয়। ধর্ষিত হয় রোহিঙ্গা নারী ও যুবতীদের বড় একটি অংশ। সেনা বর্বরতায় টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার ঢল নামে রোহিঙ্গা নর-নারী ও শিশুদের। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার অবস্থান রয়েছে উখিয়া-টেকনাফের ৩০ শিবিরে। বেসরকারী পরিসংখ্যানে এ সংখ্যা আরও বেশি। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপের মুখে গত বছরের ২৩ নবেম্বর মিয়ানমার পক্ষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। সমঝোতা অনুযায়ী এর দুমাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা থাকলেও অদ্যাবধি মিয়ানমার পক্ষ তা কার্যকর করেনি। মিয়ানমার পক্ষ বাংলাদেশ সরকারের কাছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের তালিকা চাওয়া হলে দু’দফায় এদের একটি তালিকা প্রেরণ করা হয়। প্রথম তালিকায় ছিল ৮ হাজার ৩২ রোহিঙ্গা নর-নারীর নাম। যা গত এগারো মাসেও কোন কার্যকারিতা পায়নি। এদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি, তমব্রু, কোণাপাড়া মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানকারী প্রায় ৬ হাজার রোহিঙ্গাকে কৌশলে এপারে নিয়ে আসার তৎপরতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সীমান্তের জিরো লাইনে থাকা রোহিঙ্গারা রয়েছে মিয়ানমার অভ্যন্তরে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার দু’দেশের ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরাও গত ২০ ফেব্রুয়ারি সরজমিনে এদের অবস্থান পরিদর্শন করে গেছেন। এদিকে, রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান পালন বাহানায় রোহিঙ্গারা সমবেত হয়ে যে শোডাউন করেছে এর ভবিষ্যত নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। কেননা, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এরা সভা সমাবেশ করা তো দূরের কথা, একসঙ্গে জড়ো হয়ে আলাপ আলোচনাও ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু মানবিকতার প্রশ্নে বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে অবস্থান দিয়েছে। সরকার পক্ষে এবং বেসরকারী পর্যায়ে এদের জন্য সরবরাহ হয়েছে জীবন বাঁচানোর পণ্যসামগ্রী ও বসবাসের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী। আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও এসেছে বিভিন্ন সাহায্য সামগ্রী। এরা প্রতিনিয়ত সরকারী-বেসরকারী পর্যায় থেকে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে নিরাপদেই রয়েছে। সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারের ওপর যেমন চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে তেমনি আন্তর্জাতিক সমর্থনও আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠেছে, মিয়ানমার পক্ষ ও পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে পৃথক পৃথকভাবে যেসব শর্ত আরোপ করেছে তাতে এটা পরিষ্কার যে, মিয়ানমার এদের ফিরিয়ে নিতে চায় না। আর রোহিঙ্গারাও ফিরে যেতে চায় না। কেননা, মিয়ানমার পরিষ্কারভাবে আগেই জানিয়ে দিয়েছে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া। তারা সে দেশের জন্য বহিরাগত। তাই তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। অপরদিকে, রোহিঙ্গারা বলছে, তারা বংশ পরম্পরায় সে দেশে বসবাস করে আসছে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার ১৯৯২ সালে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছে। এরপরও তাদের বড় একটি অংশ এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রমাণ সমন্বয়ে সেখানে বসবাস করছে। তাদের সহায় সম্বল বাড়িঘর, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই সেখানে প্রতিষ্ঠিত। সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ সন্ত্রাসীদের অত্যাচার নিপীড়নে টিকতে না পেরে এরা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় লাভের পর এরা যে সুযোগ সুবিধা ও সরকারের মানবিক ব্যবহার পাচ্ছে তা থেকে বাদ যেতেও বহু রোহিঙ্গার অনীহা রয়েছে। এছাড়া কিছু এনজিও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীর ইন্ধনতো রয়েছেই। বিভিন্ন সূত্রে আরও বলা হচ্ছে, যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে এবং যে হারে এদের পরিবারে নতুন নতুন আদম সন্তান জন্ম নিচ্ছে ভবিষ্যতে এদের তাদের দেশে ফিরে যেতে সফলতা আসবে কিনা তা একটি বড় ধরনের প্রশ্নবোধক হয়ে আছে।
×