ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফাঁকা ঢাকায় অন্যরকম আক্ষেপ

এমন খোলা হাওয়া প্রশস্ত সড়ক কেন প্রতিদিনের হয় না?

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৬ আগস্ট ২০১৮

এমন খোলা হাওয়া প্রশস্ত সড়ক কেন প্রতিদিনের হয় না?

মোরসালিন মিজান ॥ তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে...। পালে হাওয়া লেগেছে। সত্যি। এখন ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা।’ শহর ঢাকার যেখানে খুশি যাওয়া যাচ্ছে। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে কোনকিছু নিয়ে দুবার ভাবতে হচ্ছে না। মুহূর্তেই পৌঁছা যাচ্ছে গন্তব্যে। কারণ আর কিছু নয়, ফাঁকা ঢাকা। ঈদের ছুটিতে বহু মানুষ শহর ছেড়ে গেছেন। গ্রামের বাড়িতে আত্মীয় পরিজনের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন তারা। এ কারণেই আমূল বদলে যাওয়া ঢাকা। গত ২২ আগস্ট সারাদেশে একযোগে উদ্যাপিত হয় ঈদ-উল আজহা। আনন্দের খুব বড় উপলক্ষ যেহেতু, প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেভাগেই। জীবিকার প্রয়োজনে যারা ঢাকায় থাকেন তারা ঈদে আর স্থির থাকতে পারেন না। এবারও সেই দূর গ্রামে, মফস্বল শহরে ছুটে গেছেন। গত কয়েকদিন বাস ট্রেন লঞ্চ সবখানেই ছিল উপচে পড়া ভিড়। আকাশ পথেও ব্যতিক্রম ছিল না। এভাবে অসংখ্য মানুষ ঢাকা ছেড়ে গেছেন। ধারণা করা হয়, রাজধানী শহরের জনসংখ্যা এখন প্রায় পৌনে ২ কোটি। আর ঈদে ঢাকা ছেড়ে গেছে ১ কোটির বেশি মানুষ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। তারা বলছেন, এখন যারা ঢাকায় আছেন তারা শহরের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও কম। অবশ্য এত হিসাব-নিকাশ না করলেও চলে। আশপাশে তাকালেই চোখে পড়ে পরিবর্তনগুলো। এখন ঢাকা দারুণ ফুরফুরে। মেদহীন। ওজন কমেছে। বড় করে নিশ্বাস নেয়ার সুযোগ পেয়েছে অসংখ্য মানুষের পদভারে দেবে যাওয়া মেগাসিটি। অধিকাংশ বাড়ির দরজায় তালা। খুব কম বাড়িতে আলো জ্বলছে। সেই কোলাহল নেই। সিঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ নেই। উপভোগ করার মতো নির্জনতা। শূন্য ঢাকার সবচেয়ে পরিষ্কার ছবিটি দেখা যায় রাস্তায় নামলে। প্রধান প্রধান সড়কগুলো আসলে কত প্রশস্ত, তা অনুমান করা যায়। মানিক মিয়া এভিনিউ যেন খোলা মাঠ, বিমান বন্দর সড়ক রানওয়ে। যে যানজটের কারণে রাজধানীকে পরিত্যক্ত অচল মনে হয়, সেটি আর নেই। গতি পেয়েছে শহর। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে গতির বিষয়টি সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে। এখন যেখানে খুশি যাওয়া যায়। গন্তব্যে পৌঁছা যায় যথাসময়ে। নির্বিঘেœ ফেরা যায়। গত বৃহস্পতিবার প্রাইভেটকারে বিজয় সরণি থেকে যমুনা ফিউচার পার্কে যেতে কোথাও দুই মিনিট থামতে হলো না। হাত ঘড়ি বলছিল ২১ মিনিটের মতো খরচ হয়েছে। শুক্রবার রাতে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজার থেকে ফার্মগেটে মোটরবাইকে আসতে সময় লাগে মাত্র ১২ মিনিট। রিকশা ধীরে চলে। তাতে কী? গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সময় নেয় সামান্যই। এভাবে গত কয়েকদিন রাস্তা ব্যবহারের অভিজ্ঞতা বলে, গোটা শহর ঘুরতে ৪০ মিনিটের বেশি সময় প্রয়োজন হবে না। শনিবার টিএসসি এলাকায় কথা হয় জুয়েল তামিম ও হাবিবের সঙ্গে। তিন বন্ধু চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তামিম এসেছিলেন বংশাল থেকে। বললেন, ঈদের আগে ‘এই আসছি’ বলে বন্ধুদের দাঁড় করিয়ে রাখতাম। সময় মতো আসতে পারতাম না। মিথ্যা বলতে হতো অনেক। আর আজ দেখুন, ফোনে ‘আসছি’ বলার কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে এসেছি। এর চেয়ে স্বস্তির, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? রাস্তা ফাঁকা হওয়ায় ব্যাপক হারে চলছে ঘুরে বেড়ানো। যে যার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আনন্দ করছেন। চিড়িয়াখানা, শিশুপার্ক, হাতিরঝিল, চন্দ্রিমা উদ্যান সর্বত্রই প্রাণচাঞ্চল্য। উৎসবের আমেজ। হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা আশিষ কর্মকার বলছিলেন, যানজটের কারণে ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোথাও বের হতে ইচ্ছে করে না। এখন যেহেতু রাস্তা ঘাট ফাঁকা তাই বের হয়েছি। ঢাকাটাকে নতুন লাগছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। নতুন লাগার ব্যাখ্যাও আছে। এই যেমন মতিঝিল শাপলা চত্বরে বিশালাকার শাপলা ফুটে আছে। কিন্তু মানুষের মাথা আর যানজটের কারণে সেটি দেখা যেত না। এখন তাকিয়ে অভিভূত হতে হচ্ছে। যেন নতুন করে গড়া হয়েছে কংক্রিটের এই ভাস্কর্য। কাওরান বাজারে আশ্চর্য সুন্দর সার্ক ফোয়ারা। নিতুন কু-ুর মতো খ্যাতিমান শিল্পীর গড়া ভাস্কর্য পরিপূর্ণ অবয়ব নিয়ে সামনে এসেছে। এও ঈদের ছুটির কারণেই। ঢাকার ফুটপাথগুলোও বেশ দৃশ্যমান হচ্ছে এখন। ফুটপাথ যে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। দখলদাররা নেই। স্বাধীনভাবে হাত দুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ। গায়ে গা লাগছে না। বারবার ‘সরি’ বলতে হচ্ছে না কাউকে। ঢাকার বাতাসটুকুও বিশুদ্ধ। সতেজ। গায়ে যে লাগছে, টের পাওয়া যায় এখন। নিশ্বাস নেয়া যায় বুক ভরে। বৃষ্টিও হচ্ছে অল্পস্বল্প। বাড়ান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেই অদ্ভুত শিহরণ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মন ভিজে যায়। সামান্য যা বৃক্ষ, সেই বৃক্ষের সবুজ, পাতার নাচন কোন কিছুই দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। ঢাকার কোন কিছুই আর ঢাকা নেই। সবই মনে হচ্ছে খোলা। সবই উপভোগ্য! এই শহর যাদুর শহর/প্রাণের শহর ঢাকারে...। যেন প্রাণ ফিরেছে ঢাকার। কিন্তু কতদিন? কতদিন এমন উপভোগ্য থাকবে শহর? হ্যাঁ, এমন প্রশ্নে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে সবার। ফাঁকা ঢাকায় অন্যরকম আক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে। আজ রবিবার থেকে সকল সরকারী-বেসরকারী অফিস খোলা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দোকান পাট চালু হয়ে যাবে পুরোদমে। ঈদ করতে বাইরে যাওয়া মানুষজন ফিরবে তার আগেই। দেখতে দেখতে পুরনো চেহারায় ফিরবে প্রিয় শহর। এ কথা ভেবেই বিষন্ন মন। আশা দেয়ার কেউ নেই। ঢাকাকে আগলে রাখার নেই কোন কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘ উড়াল সেতু হচ্ছে। কাজ চলছে মেট্রো রেলের। কিন্তু সমন্বিত উদ্যোগ চাই। ঢাকাকে বসবাসযোগ্য করতে আরও অনেক বিষয় নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে ভাবতে হবে। কেউ কি আছে ভাবার? মন তাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার বলি রেখা দেখা দিচ্ছে কপালে।
×