ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২০ আগস্ট ২০১৮

 লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ মানুষ স্বভাব প্রেমিক। বরাবরই সে এমন একটা অবলম্বন ও আশ্রয় পেতে চায় যার সান্নিধ্যে এসে সে তার প্রেমিক হৃদয়ের আবেগ ও উচ্ছ্বাসকে শান্ত ও তৃপ্ত করতে পারে। যা মুছে দেবে তার জীবনের বড় বড় অপরাধ ও পদস্খলন। জন্মদিনের মতোই সে হয়ে উঠবে নিষ্পাপ ও পবিত্র। আবহমানকাল থেকে মানবমনের এ চাহিদা পূরণ করে আসছে ‘হজ’। আরবী ভাষায় ‘হজ’ শব্দের অর্থ- জিয়ারতের সংকল্প করা। যেহেতু খানায়ে-কাবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে তাবৎ প্রেমিক-ভক্তগণ পৃথিবীর চারদিক থেকে পঙ্গপালের মতো এসে পবিত্র মক্কা নগরীতে জমায়েত হয়, তাই এর নাম রাখা হয়েছে হজ। কখন কীভাবে হজ সূচনা হয়েছিল এবং যুগে যুগে এ হজব্রত পালনের প্রকৃতি কেমন ছিল সে ইতিহাস অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক এবং শিক্ষাপ্রদ। হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন। পবিত্র স্থানসমূহ দর্শন এবং সে স্থানগুলোতে বিশেষ রীতিনীতি শিষ্টাচারের সঙ্গে অনুষ্ঠান পালনের প্রথা প্রাচীনকাল থেকে চালু রয়েছে। সকল ধর্মের অনুসারীদের নিকট কোন না কোন স্থান রয়েছে যেগুলোকে তারা পবিত্র বলে মনে করে থাকেন। সে সকল স্থানে গিয়ে তারা নিজ নিজ আকিকা ও বিশ্বাস অনুসারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসমূহ পালন করে থাকেন। আহলে কিতাবের মাঝে ইহুদীদের মধ্যে পবিত্র স্থানসমূহের জিয়ারতের প্রথা পূর্বেও চালু ছিল। তারা বায়তুল মুকাদ্দাস কেন্দ্রিক বছরে তিন বার হাজির হয়ে এ অনুষ্ঠান পালন করত। নবী আদমকে (আঃ)-কে যখন ধরাধমে প্রেরণ করা হয় এবং যখন তিনি মহান আল্লাহর দরবারে ফেরেস্তাদের প্রার্থনার শব্দ শুনতে না পাওয়ার অভিযোগ আনেন। এরপর আল্লাহ তাকে ‘বায়তুল্লাহ’ নির্মাণ করত এর তাওয়াফ করার হুকুম দেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা বর্ণনা করেন যে, ‘হযরত আদম হজ করেছেন এবং হজের সব অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন। তারপর আরজ করলেন- হে আল্লাহ প্রত্যেক সৎকর্মশীল ব্যক্তি প্রতিদান পায়; আমার প্রতিদান কি? আল্লাহ বললেন, হে আদম আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমার বংশধরদের মধ্যে যে এ ঘরে এসে গুনাহের জন্য তওবা করবে, আমি তাকে ও ক্ষমা করে দেব।’-(বাইহাকী)। এরপর থেকে হযরত নূহ (আঃ)-এর জামানার মহাপ্লাবনের সময় পর্যন্ত আদম সন্তানরা পবিত্র কাবায় হজব্রত পালন করে। মহাপ্লাবনের সময় খানায়ে কাবাকে তুলে নেয়া হলে মতান্তরে বিধ্বস্ত হলে এর পুনর্নির্মাণ ও পুনঃসংস্কারের উদ্দেশ্যে মনোনিবেশ করেন সাইয়্যিদেনা ইব্রাহীম (আঃ) ও তদীয় পুত্র ইসমাঈল (আঃ)। আল্লাহর নির্দেশে জিব্রাঈল (আঃ) কর্তৃক প্রদর্শিত পন্থায় দুই সম্মানিত নবী সেদিন হজ পালন করেন। তারপর থেকে মুসলিম উম্মাহ সে নিয়ম-রীতির অনুকরণে হজ পালন করে আসছে। জাতির পিতা ইব্রাহীম (আঃ) এর বিশেষ দাওয়াতের পর থেকে মানবকুলের এক বিরাট অংশ তৌহিদের নির্মল আলোয় উদ্ভাসিত হলো। তার পরবর্তী সকল নবীও স্ব স্ব উম্মৎরা হযরত ইব্রাহীমের (আঃ) প্রদর্শিত দ্বীনে হানিফকে আকড়ে ধরে ছিলেন, ইসলামী ভাবগম্ভীর পরিবেশে আদায় করতেন পবিত্র হজ। কিন্তু পরবর্তী কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তারা সে পূর্ববর্তী মহাপুরুষদের শিক্ষা ও প্রদর্শিত পথ ভুলে গিয়েছিল এবং অন্যান্য জাহেল জাতির ন্যায় সর্বপ্রকার গুমরাহী ও পাপ প্রথার প্রচলন করে ছিল। যে কাবাঘরকে কেন্দ্র করে এককালে এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত ও প্রচার শুরু হয়েছিল সে কাবা ঘরে জাহেলরা অবতারণা করল নানা আজব ও বিকৃত কর্মকা-ের। নৈতিকতা ও প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ নির্বাসিত হলো কাবার দখলদারদের থেকে। তাই তারা সেখানে অহরহ খোদার নাফরমানিতে মত্ত থাকত। এক শ্রেণীয় পুরোহিত, পাদ্রি সর্বপ্রকার কলাকুশল অবলম্বন করে আরবের বিভিন্ন স্থান হতে আসা লোকজন হতে নজর নিয়ায ও ভেট-বেগাড় আদায় করত। সেখানে বসত বার্ষিক মেলা। আরবের বড় বড় বংশ ও গোত্রের লোকেরা তথায় দল বেঁধে আস্তানা তৈরি করত। প্রত্যেক গোত্র-প্রধান নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য ডেগ চড়াত এবং অন্যকে হেয় করার উদ্দেশ্যে উটের পর উট জবেহ করতো। এসব সম্মেলনে নাচ-গান, মদ্যপান, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার নির্লজ্জ কাজ কর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে সম্পন্ন হতো। তারা হজের সফরে প্রয়োজনীয় পাথেয় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী মনে করত। তাদের যুক্তি ছিল এই যে, আমরা আল্লাহর মেহমান। সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যাওয়াটা মেজবানের অপমানেরই নামান্তর। তবে মজার ব্যাপার হলো, অন্যের কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করতে তাদের বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ ছিল না। বরং এটাকে তার নিজেদের অহংবোধ দমনের মুজাহিদা বলেই চালিয়ে দিতো। কিন্তু আল-কুরআন তাদের এ ফন্দিবাজির প্রতিবাদ করেছে। এরশাদ হলোঃ ‘পাথেয় সংগ্রহ করে নাও, তবে মনে রেখো যে, ‘তাকওয়া’ই হলো উত্তমপাথেয়।’ জাহেলিয়াতের সমস্ত জুলমাত ও বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে ইবরাহিমী সুন্নাহ ও আদর্শের ওপর পবিত্র হজের অনুষ্ঠানমালা দাঁড় করালেন আখেরি নবী হযরত মুহাম্মদ (স.)। এ সঙ্গে ইসলামী শাসনের যুগে যুগে হয়েছে নানা আরামদায়ক সৌন্দর্য বর্ধিতকরণ ব্যবস্থাপনা। আজ টেলিভিশনের বদৌলতে সেসব নিষ্কলুষ পূতঃপবিত্র হজের দৃশ্য ও লাখো কণ্ঠের লাব্বায়েক ধ্বনি শুনে আমরা প্রতিনিয়ত উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বাসিত হই।
×