ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ

কোরবানি ঈদের খাবার ও সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৯ আগস্ট ২০১৮

কোরবানি ঈদের খাবার ও সচেতনতা

ঈদ-উল-আজহা দুদিন পর। যার অপর নাম কোরবানির ঈদ। ঈদ হলো আনন্দের দিন, যার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো খাবার। আর কোরবানির ঈদের অন্যান্য খাবারের সঙ্গে মূল আয়োজন হলো বিভিন্ন রকমের গোশত খাওয়া, যেমন গরু, খাসি, মহিষ, এমনকি উটের গোশত। ঈদ উৎসবে সবারই মনে প্রবল ইচ্ছা থাকে বেশি বেশি করে কোরবানির গোশত খাওয়া। গোশত অবশ্যই খাবেন, কিন্তু খাবারের বিষয়ে চাই পরিমিতি জ্ঞান ও সংযম পালন এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা। মনে রাখতে হবে, দুই একদিন বেশি গোশত খেতে যদিও খুব বাধা নেই, তবুও খাবেন রয়ে সয়ে। সমস্যা হলো যারা অনেকদিন যাবত বিভিন্ন রোগে ভোগেন যেমন যাদের পেটের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ, কিডনি বা লিভারের রোগ আছে কিংবা এসব রোগের প্রাথমিক লক্ষণ আছে। ঈদকে উপলক্ষ করে সবার বাসায় নানা ধরনের মুখরোচক খাবারের আয়োজন করা হয়। নিজের বাসায় তো বটেই, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের বাসায় ঘুরে ঘুরে প্রায় সারা দিনই টুকিটাকি এটা-সেটা ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় খাওয়া হয়েই থাকে। আমাদের একটু নজর দেয়া দরকার আমরা কী খাচ্ছি, কতটুকু খাচ্ছি, শরীরে বিভিন্ন খাবারের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার ওপর। . খাবারের পরিমাণ মূল সমস্যাটা নিঃসন্দেহে খাবারের পরিমাণে। অনেকেই একসঙ্গে প্রচুর পরিমাণ তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত খাবার খেয়ে হজম করতে পারেন না। এছাড়া কোরবানির গোশত পরিমাণে একটু বেশিই খাওয়া হয়। অধিক পরিমাণে গোসত খাওয়ার ফলে হজমে সমস্যা হয়, পেট ফাঁপে, জ্বালাপোড়া করে, ব্যথা করে, বার বার পায়খানা হয়। গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত রোগীদের সমস্যাটা আরও বেশি হয়। পর্যাপ্ত পানি বা তরল খাদ্য গ্রহণ না করার দরুন অনেকে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। যদিও সাধারণভাবে কোন নির্দিষ্ট খাবার খেতে মানা নেই, কিন্তু পরিমাণ বজায় রাখা খুবই জরুরী। এক্ষেত্রে শুরু থেকেই পরিকল্পনা থাকা দরকার। যেহেতু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই সবাই গোশত খাওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাই কিছুকিছু খাবার সকাল আর দুপুরে পরিহার করাই উত্তম। যেমন তৈলাক্ত খাবার, পোলাও, বিরিয়ানি, আমিষ জাতীয় খাবার, যেমন মুরগি, খাসি বা গরুর মাংস, কাবাব, রেজালা ইত্যাদি। অন্য খাবারও যথাসম্ভব কম খেয়ে পেটটা একটু খালি রাখুন। কারণ দিন গড়িয়ে গেলে কোরবানির গোশত প্রচুর পরিমাণে খাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। ঈদের দিনে অনেকেই সরবত, কোমল পানীয়, ড্রিংকস এবং ফ্রুট জুস খাওয়া পছন্দ করেন। তবে মনে রাখা উচিত, বাজারে দেশী-বিদেশী যেসব ফ্রুট জুস পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশির ভাগই আসল ফলের রস নয়। কৃত্রিম রং ও সুগন্ধি দিয়ে জুস নামের এসব পানীয় তৈরি করা হয়। চটকদার বিজ্ঞাপনের সুবাদে এগুলোই হয়ে যায় তাজা ফলের রস। আবার দীর্ঘদিন ধরে এসব জুস পান করলে শিশুদের তো বটেই, বড়দের পাকস্থলীরও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। সেইসঙ্গে লিভার ও কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বাজারের ফ্রুট জুস পান করলে কোন উপকার তো হবেই না, বরং স্বাস্থ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতএব এসব না খেয়ে সবসময় মৌসুমি ফল খাবেন তাতে মজা ও উপকার দুই-ই পাবেন। লেবুর শরবত, বাসায় বানানো ফলের রস, ডাবের পানি, বোরহানি ইত্যাদি খাওয়া যায়। . সকালের খাবার হতে হবে হালকা ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েশ খেতে পারেন। সঙ্গে কিসমিস, বাদাম এমনকি খেজুর বা খুরমা, ফলের জুস, ডাবের পানি ইত্যাদি খেতে পারেন। খাবার আধঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নামাজ পড়তে যান। . খাবার খেতে হবে বুঝে-শুনে যাদের বয়স কম এবং শারীরিক কোন সমস্যা নেই, তারা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন এবং তাদের হজমেরও কোন সমস্যা হয় না, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো, বিশেষ করে চর্বি জাতীয় খাদ্য। বেশি গোশত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়। যাদের এনাল ফিশার ও পাইলস জাতীয় রোগ আছে, তাদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি বাড়তে পারে, এমনকি পায়ুপথে রক্তক্ষরণ পর্যন্ত হতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, সরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুষি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি করে খাবেন। পেটে গ্যাস হলে ডমপেরিডন, এন্টাসিড, রেনিটিডিন, ওমিপ্রাজল, প্যান্টোপ্রাজল জাতীয় ওষুধ খেতে পারেন। যাদের আইবিএস আছে, তারা দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করুন। দাওয়াতে গেলে পরিমিত খাবেন, অতিভোজন পরিহার করার চেষ্টা করবেন। হয়ত টেবিলে হরেক রকমের খাওয়া-দাওয়ার পসরা সাজানোই থাকবে, কিন্তু খেতে বসলেই যে সব খেতে হবে তা নয়। নিজের জিহ্বাটাকে সংযত রাখুন। কোরবানির গোশত খাওয়ার সময় চর্বিগুলো পরিহার করলেই ভাল। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি খাবেন না, এতে হজম রসগুলো পাতলা হয়ে যায়। ফলে হজমে অসুবিধা হয়। তাই খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর পানি পান করুন। খাবারের মাঝে বোরহানি খেতে পারেন। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করুন। রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন না। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন। . চর্বি এড়িয়ে চলুন যে কোন পশুর চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কোরবানির সময় এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। গরু বা ছাগলের মাংসকে এক কথায় বলা হয় লাল মাংস বা রেডমিট। লাল মাংস প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস, শরীরের বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ ও শরীর গঠনে যার ভূমিকা অপরিসীম। তবে লাল মাংসের যেমন উপকার রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক ঝুঁকিও। এতে আছে প্রচুর স্যাচুরেটেড ফ্যাট যেমন ট্রাইগি সারাইড ও এলডিএল, যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসাবে পরিচিত। এগুলো শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে, রক্তচাপ বাড়ায়, রক্তনালীতে চর্বি জমিয়ে রক্তপ্রবাহকে ব্যাহত করে স্ট্রোক ও হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়, ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার যেমন কোলন ও স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়ার সম্ভাবনা থাকে লাল মাংসে। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রান্না সুস্বাদু হবে এমন ভুল ধারণা পোষণ করে মাংসে বেশ কিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করে থাকি। এটা ঠিক নয়। যতটুকু সম্ভব মাংসের চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়া ভাল। মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে। টাটকা সবজি পাকস্থলীকে সাবলীল রাখে। পরিমিতিবোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে ভয়ের কিছুই নেই। মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা গোশতের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমল পানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে কোরবানির ঈদের সময়ও ভাল থাকা যায়। সেই সঙ্গে হালকা ব্যায়াম বা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে নিতে পারলে আরও ভাল। . বয়স্কদের সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবয়সী এবং বয়স্কদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা আরও জরুরী। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের সবাইকেই ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। অতিভোজনে তাদের পেট ভরা ভাব বা অস্বস্তিকর অনুভূতি হতে পারে। বেশি গোশত খেলে তা পরিপূর্ণভাবে হজম করতে অনেক সময় লাগতে পারে। এতে পেটে অস্বস্তিকর অনুভূতি, ভরা ভরা ভাব, বার বার ঢেকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীকে অবশ্যই মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। নেহায়েত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও, বিরিয়ানি কম খাবেন। গরু বা খাসির গোসত খাওয়া যাবে, পরিমাণটা অতিরিক্ত যাতে না হয় এবং তেল বা চর্বি যেন কম থাকে সে ব্যাপারে অবশ্যই সচেষ্ট হতে হবে। . স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য স্ট্রোক এবং হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা অবশ্যই তৈলাক্ত মাংস কমিয়ে খাবেন। সারা বছর তারা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করেন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও সেইভাবে চলা উচিত। কোরবানির মাংস একটু আধটু খেলে শরীরের যে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাদের ওজন বেশি তাদের অবশ্যই ঈদের সময় অতিরিক্ত খাওয়া পরিহার করতে হবে। . গেঁটে বাত, কিডনি ও লিভারের সমস্যা আছে যাদের গেঁটে বাত বা ইউরিক এসিড বেশি যাদের এবং যারা কিডনির সমস্যায় ভোগেন, তাদের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য কম খেতে বলা হয়। তাই গোশত খাবার ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনক্রমেই অতিরিক্ত গোশত খাওয়া ঠিক হবে না। ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী সারা বছরের মতো ঈদের সময়ও একই খাবার খাওয়াই ভাল। ক্রনিক লিভার রোগে আক্রান্ত রোগীরাও ডাক্তারদের পরামর্শের বাইরে খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। . মাংস সংরক্ষণ কোরবানির পরে গোসত বিলিয়ে দেয়ার পরেও দেখা যায় যে ঘরে অনেক গোশত জমা থাকে। এই গোশতগুলো ভালভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরী। ফ্রিজে সংরক্ষণ সম্ভব হলে ভাল। তবে গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহরে অনেকের বাসায় ফ্রিজ না থাকলে সঠিকভাবে মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। এমনকি মাংস সিদ্ধ করে শুকিয়ে শুঁটকির মতো করে অনেকদিন খাওয়া যেতে পারে। খাবার আগে খেয়াল রাখতে হবে যেন গোশতের গুণগত মান ঠিক থাকে। ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। কিন্তু তা হতে হবে পরিমিত। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল, চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে। খাওয়া-দাওয়ারও উৎসব আনন্দ অতিভোজন একইভাবে চলবে। অন্তত একটা দিন হলেও সবার এমন ইচ্ছা থাকে। না খেলেও অনেক সময় আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব জোর করেই খাওয়াবে। তারপরও সবাইকে রয়েসয়ে খেতে হবে, একটু সচেতন ও সাবধানী হতে হবে, ঈদ আনন্দের এই সময়ে যেন কোন শারীরিক সমস্যায় পড়তে না হয়। ঈদ এবং ঈদ পরবর্তী সময়ে ভাল থাকতে হবে। এভাবেই উৎসবও চলতেই থাকবে, স্বাস্থ্যটাও যেন ভাল থাকে। লেখক : অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, ডিন মেডিসিন অনুষদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×