ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশায় আশরাফুল...

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১৫ আগস্ট ২০১৮

 আশায় আশরাফুল...

বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম গ্লোবাল স্টার, তুখোড় মেধাবী ক্রিকেটার হিসেবে তার নাম হয়েছিল ‘আশার ফুল’। কারণ, তিনি যখন ব্যাট হাতে জ্বলে উঠতেন তখনই বড় কোন সাফল্য ধরা দিতো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে সেঞ্চুরির বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন, একদিনের জন্য টেস্ট ক্রিকেটে দেশের পক্ষে সর্বাধিক ব্যক্তিগত ইনিংস খেলেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রতিরোধ্য প্রবল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম বিজয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন, ওয়ানডে বিশ্বকাপ ও বিশ্ব টি২০ চ্যাম্পিয়নশিপে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং-এমন অনেক কীর্তিতে নাম আছে তার। সেই আশরাফুল ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি২০ ক্রিকেট আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২০ আসরে বাজিকরদের চক্রান্তের চক্রে নিজেকে জড়িয়ে হয়েছিলেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ৫ বছর নির্বাসিত। অবশেষে ১৩ আগস্টে সেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। এখন তিনি যেকোন পর্যায়ে যেকোন ফরমেটের ক্রিকেট খেলতে পারবেন। ৩৪ বছর বয়সেই মানসিকভাবে দৃঢ় আশরাফুল দৃপ্ত প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন আবার জাতীয় দলে ফেরার। কিন্তু সেই পথটা বড়ই কঠিন, দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পেরোতে হবে বন্ধুর-দুর্গম পথ। স্বপ্ন সত্যি করার জন্য সে ফেরার লড়াই তাই শুরু হয়ে গেছে আশরাফুলের। একটা অদৃশ্য দেয়াল চারপাশে, অদৃশ্য এক শেকলে বাঁধা পা- হাসফাঁস পরিস্থিতির মধ্যে চরম এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ছিলেন আশরাফুল গত ৫টি বছর। সবধরনের ক্রিকেট থেকে ৫ বছর নিষিদ্ধ ছিলেন। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট যদিও ঘরোয়া কিছু আসরে খেলার অনুমতি পেয়ে খেলেছেন গত দুই মৌসুম। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এবং ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক আসরে খেলার জন্য তারপরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে কারণে কারাভোগের মতো অস্বস্তিটা ঠিকই ছিল। অবশেষে ১৩ আগস্ট, ২০১৮ এর পর থেকে মুক্ত বিহঙ্গ হয়েছেন আশরাফুল। কি ঘটেছিল এ তুখোড় মেধাবী ক্রিকেটারের ভাগ্যে? একটি ফ্ল্যাশব্যাক করে সেটি জানা যাক। ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) টি২২০ আসর অনুষ্ঠিত হয়। আর এমন টুর্নামেন্টে থাকে টাকার ছড়াছড়ি এবং সে কারণেই জুয়াড়ি, ম্যাচ ফিক্সার আর দুর্নীতিবাজদেরও সমাগম ঘটে। তেমনই একটি সংঘবদ্ধ চক্রের চক্রান্তে ফেঁসে ম্যাচ গড়াপেটায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন আশরাফুল। বিপিএলে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠার পর ২০১৩ সালের ৩১ মে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তদন্ত শুরু করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুল দোষ স্বীকার করে নেন এবং বিস্তারিত জানান। ৪ জুন বিসিবি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ করে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে। ২০১৪ সালের ১৮ জানুয়ারি বিপিএল শুরু করে এন্টি করাপশন ট্রাইব্যুনালের শুনানি। এর মাঝেই (২ জুন, ২০১৪) আশরাফুল নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি আনঅফিসিয়াল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে আরেকবার বিতর্কের জন্ম দেন। সে বছর ১৮ জুন বিসিবি আশরাফুলকে ৮ বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করলে এর বিপক্ষে আপীল করেন ২২ জুলাই। ২৯ সেপ্টেম্বর বিসিবির শৃঙ্খলা কমিটি সার্বিক দিক বিবেচনা করে আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ৫ বছর করে। তবে এর বিপক্ষে আপীল করে বিসিবি ও আইসিসি ২১ অক্টোবর। তবে সেই আপীল আর আমলে আনা হয়নি। ৩ বছর কমে যায় শাস্তি। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট থেকে আশরাফুলের ৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়ে যায়। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়ে যায়। এরপর তিনি বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট লীগের (এনসিএল) চারদিনের কয়েকটি ম্যাচ খেলেন। তবে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি। নিষেধাজ্ঞা ছিল ৫ বছরের জন্য। সবধরনের ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে টানা তিন বছর। ২০১৬ সালে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গিয়েছিল। কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেট আসর এবং সবধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠেনি। সেখান থেকেও দীর্ঘ ৫ বছর অপেক্ষার পর ছাড় পেয়েছেন আশরাফুল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র, সাবেক অধিনায়ক ও ওপেনারের সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যেই ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে নিজেকে অনেকখানিই ফিরে পেয়েছেন এবং আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে। এবার সব ধরণের ক্রিকেট খেলা উন্মুক্ত হওয়ার আগে ৩৪ বছর বয়সী আশরাফুল প্রত্যয় জানালেন জাতীয় দলে ফেরার। বয়স ৩৪ পেরিয়ে গেছে, তবু স্বপ্ন দেখা শেষ হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরে চলে যান অনেকে এবং কিছু খেলোয়াড় অবসর নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেন। কিন্তু মোহাম্মদ আশরাফুল এই বয়সেই নতুন করে আশা করছেন পারফর্মেন্স দেখিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলে ফিরতে। কিন্তু সেই পথটা একেবারেই বন্ধুর, দুর্গম ও কঠিন! প্রথমত, যে পজিশনে তিনি খেলবেন সেখানে ফাঁকাও নেই, সুযোগও কম, দ্বিতীয়ত দীর্ঘ ৫ বছর নিষেধাজ্ঞা শেষে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ক্রিকেটার হিসেবে প্রমাণের বিষয় আছে, তৃতীয়ত দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়ে তাকে ভুলে যাওয়া নির্বাচকদের ভাবতে বাধ্য করতে হবে, চতুর্থত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মতো আদর্শ শারীরিক সক্ষমতা ও যথাযথ ফিটনেস থাকা এবং পঞ্চমত ঘরোয়া আসরগুলোয় ভাল করে ‘এ’ দল কিংবা এইচপির হয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা। আর প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু রবিবার যা বলেছেন তার মোদ্দা কথাগুলো এমনই। তার আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়া নিয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু সোজা বলে দিয়েছেন, ‘আশরাফুলকে নিয়ে এখন আমাদের চিন্তা ভাবনা নেই।’ আর বিসিবি থেকেও জানানো হয়েছে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য আরও অন্তত একটি বছর নিজেকে উজ্জ্বল পারফর্মেন্স দেখাতে হবে আশরাফুলকে। বরাবরই আশরাফুল মেধাবী ক্রিকেটার। সেই মেধাটা মাঠে না থাকলেও ফুরিয়ে যায়নি। দীর্ঘ সময় ব্যাট-বল হাতে না নিলেও তিনি নিজেকে ফিরে পান গত বছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লীগে (ডিপিএল)। সবাইকে বিস্মিত করে হাঁকান ৫টি সেঞ্চুরি। একটি লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট মৌসুমে বিশ্বের ক্রিকেট ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে এই কৃতিত্ব দেখান তিনি। ২০১৫-১৬ মৌসুমে মোমেন্টাম ওয়ানডে কাপে দক্ষিণ আফ্রিকার আলভিরো পিটারসন ৫ সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে রেকর্ড গড়েছিলেন। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর আশরাফুল ২৩টি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে ৪৭.৬৩ গড়ে রান করেছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে নিজেকে নিয়ে বেশ সংগ্রাম করেছেন আশরাফুল। ১৩ ম্যাচে মাত্র একটি সেঞ্চুরিসহ রান করেছেন মাত্র ২১.৮৫ গড়ে। এ বিষয়ে আশরাফুল বলেন, ‘ফেরার পর আমার প্রথম মৌসুমটা তেমন ভাল হয়নি। কিন্তু ২০১৭-১৮ মৌসুমে আমি বেশ ভাল করেছিলাম। আমি আসন্ন মৌসুমে আরও ভাল করার আশা করছি। আমার পারফর্মেন্স দিয়ে এখন আমি দলে ঢোকার যোগ্য। আমি এরই মধ্যে মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে ছিলাম এবং পরের মৌসুমের জাতীয় ক্রিকেট লীগের জন্য ১৫ আগস্টের পর আমি প্রাক-মৌসুম অনুশীলনে যোগ দেব।’ সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে বিশ্বরেকর্ডধারী এ মেধাবী তারকা স্বপ্ন দেখছেন জাতীয় দলে আবার ফেরার। নির্বাচকদের নজরে আসার জন্যই কঠোর পরিশ্রম এবং দারুণ পারফর্মেন্স করতে চান তিনি। ‘কলঙ্কমুক্ত’ হয়ে মাঠে ফিরতে তর সইছে না তার। তিনি বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্টের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করার পর থেকে পাঁচটি বছর কেটে গেছে। যদিও আমি গত দুই মৌসুম ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছি, এখন জাতীয় দলে নির্বাচিত হওয়ার জন্য আমাকে কোন কিছু আটকাতে পারবে না। আবারও বাংলাদেশের হয়ে খেলতে পারা হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন।’ প্রধান নির্বাচকের কথায় হতোদ্যম হননি আশরাফুল, বরং সেটাকে মেনে নিয়ে বলেছেন, ‘নান্নু ভাই প্রধান নির্বাচক, তার অবস্থান থেকে অমন কথা শতভাগ সত্য এবং বাস্তব। আমি এখন টিম ম্যানেজমেন্ট, নির্বাচক ও বোর্ডের পরিকল্পনায় নেই। থাকার কথাও নয় সেটাই সব থেকে বড় সত্য। পাঁচ বছর জাতীয় দলের বাইরে আমি। খুব স্বাভাবিকভাবে সময়ের প্রবাহে একটা জাতীয় দলের সেট আপ গড়ে উঠেছে। একেক ফরমেটে একেক রকম লাইন আপ হয়েছে। কোন দলে কারা থাকবে, কারা খেলবে, টিম কম্বিনেশন কেমন হবে? এগুলো মোটামুটি ঠিক করাই হয়ে গেছে। সেখানে নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হয়েছি বলেই যে আমি হুট করে ঢুকে যাব, এমন নয়। আমি জানি আমাকে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়েই দলে ঢুকতে হবে। সেই কৈশোর পার করেই জাতীয় দলে ঢুকেছি একটানা ১২ বছর তিন ফরমেটে খেলেছি। এ দীর্ঘ সময় জাতীয় দলে খেলার কারণে শুধু আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাই হয়নি। অনেক কিছু দেখেছি, জেনেছি ও শিখেছি। অভিজ্ঞতাও হয়েছে প্রচুর। সেই থেকেই বলছি আমি খুব ভাল করেই জানি, আমার জাতীয় দলে ঢোকা সহজ হবে না।’ লড়াইটা তাহলে শুরু হলো আশরাফুলের, এই বয়সে সেই কঠিন সংগ্রামে টিকতে পারবেন দেশের ক্রিকেটের প্রথম উজ্জ্বলতম নক্ষত্র?
×