ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনীর চারের অবস্থান অজানা

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ১৫ আগস্ট ২০১৮

 বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনীর চারের অবস্থান অজানা

শংকর কুমার দে ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডে মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক ৬ খুনীর মধ্যে ২ খুনীর অবস্থান জানা গেলেও অপর ৪ খুনীর অবস্থান কোন দেশে তা শনাক্ত হয়নি এখনও। যে ২ খুনীর অবস্থান জানা গেছে তার মধ্যে লে. কর্নেল (অব.) এমএইচবি নূর চৌধুরী কানাডায় ও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু কানাডায় অবস্থানরত নূর চৌধুরকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে আইনী জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছে হচ্ছে। পলাতক অপর ৪ খুনী কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ, মেজর (অব) শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন কোন দেশে অবস্থান করছেন তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তবে পলাতক ৬ খুনীর বিরুদ্ধেই ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা আছে। আইনী জটিলতার অবসান ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ও কানাডায় পলাতক দুই খুনী রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যায় মৃত্যদন্ড প্রাপ্ত পলাতক ছয় খুনীর মধ্যে যে ২ খুনী যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থান করছেন তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদ- কার্যকর করার বিষয়ে আলোচনা চালানো অব্যাহত আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এই দিনে সেনাবাহিনীর একদল কর্মকর্তা ও সৈনিকের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে। আবারও এই দিনটি ফিরে আসায় জাতি শ্রদ্ধাভরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুবার্ষিকীতে বুধবার জাতীয় শোক দিবস পালন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতির জনকের দুই কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ খুনীর মধ্যে ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০১০ সালে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক অবস্থায় এক খুনী মারা গেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মুহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। আজিজ পাশা ২০০১ সালের মাঝামাঝি জিম্বাবুয়েতে মারা যান বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এখনও পলাতক আছে ৬ খুনী। পলাতক ছয় খুনীর মধ্যে নূর চৌধুরী আছে কানাডায়। ১৯৭৬ সালে এই খুনীকে বেলজিয়ামে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিলে নূর চৌধুরী কানাডায় পালিয়ে যায়। একইভাবে ১৯৭৬ সালে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবের জেদ্দা বাংলাদেশ মিশনে চাকরি দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে তাকেও দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিলে এই খুনী পালিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭৬ সালে খুনী শরিফুল হক ডালিমকে চীনে কূটনৈতিক মিশনে পাঠানো হয়। পরে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকার তাকে কেনিয়ায় রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করে। এই খুনী বর্তমানে কোথায় আছে তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও বিভিন্ন সময়ে তার কেনিয়া, স্পেন ও পাকিস্তানে অবস্থানের তথ্য পাওয়া যায়। এই খুনী বার বার বিভিন্ন স্থান পরিবর্তন করছে। ২০১৪ সালে খুনী ডালিমের মৃত্যুর গুজবও ছড়ানো হয়। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, পলাতক খুনীদের মধ্যে কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম রাশেদ চৌধুরী, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আব্দুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেমউদ্দিন। এর মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় এবং এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে বলে নিশ্চিত রয়েছে ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। অপর ৪ খুনী কোথায় আছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন ধারণা না থাকলেও সম্ভাব্য যে সব দেশে তাদের অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে এনসিবি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পলাতক যে ৪ খুনীর অবস্থান সুস্পষ্ট নয় তার মধ্যে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন সম্ভবত ভারত কিংবা জার্মানীতে থাকতে পারে বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ ও শরিফুল হক ডালিম কখনও পাকিস্তান কখনও লিবিয়ায় অবস্থান করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। আব্দুল মাজেদ রয়েছে সেনেগালে। এই চারজনের সম্ভাব্য অবস্থানরত দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০০৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনী নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিস্কারের আদেশ দিয়েছিলেন কানাডার আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খুনী নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে কানাডার এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকায় নূর চৌধুরী কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে। কানাডা নীতিগতভাবে মৃত্যুদ-ের সাজা সমর্থন করে না। এই সুযোগ নিয়ে সহানুভূতি পাওয়ার কৌশল হিসেবেই কানাডার এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে নূর চৌধুরী আবেদন করে। ঝুলে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত এবং মৃত্যুদ-ে দ-িত নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে কানাডার ফেডারেল আদালতে মামলা করেছে বাংলাদেশ। এ আবেদনটি কানাডার এ্যাটর্নি কার্যালয় খারিজ করে দিলেই খুনী নূর চৌধুরীক দেশে ফিরিয়ে আনতে আর কোন বাধা থাকবে না বলে জানা গেছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত খুনী রাশেদ চৌধুরীকে এবং মোসলেহ উদ্দিনকে জার্মানী থেকে ফিরিয়ে আনতে দুই দেশের সঙ্গেই কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। খুনী আব্দুর রশীদকে পাকিস্তানে দেখা যাওয়ার তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটি নোট পাঠানো হয়। কিন্তু দেশটির সরকার তার কোন জবাব দেয়নি। এ ছাড়া কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ডালিম ও আবদুল মাজেদের সুনির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য পাওয়ার চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে একদল সেনা সদস্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর খুনীদের বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পাঠায় তখনকার অবৈধ দখলদার খন্দকার মোশতাক সরকারসহ পরবর্তী সামরিক সরকারগুলো। এমনকি খুনীদের বিচারের পথও রুদ্ধ করে রাখা হয় কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’ জারি করে। ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিচারের পথও রুদ্ধ করে দেয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বিচারের পথ খোলে; মামলার পর বিচার শুরু হলেও বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় যাওয়ার পর ফের শ্লথ হয়ে যায় মামলার গতি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি এ্যাক্ট বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে ২০০৯ সালের ১৯ নবেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত আদেশ দেন উচ্চ আদালত। পরে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ হলে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি কারাগারে থাকা পাঁচ খুনীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বিদেশে পালিয়ে থাকা একজন আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রগতি রয়েছে। আমরা দুজন আসামির সম্পর্কে তথ্য জেনেছি। তাদের ব্যাপারে আইনী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও আইনী প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
×