ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার

প্রকাশিত: ০৭:৫৫, ১৪ আগস্ট ২০১৮

চলে গেলেন সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ খ্যাতিমান সাংবাদিক ও দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আর নেই। বাংলাদেশ সময় সোমবার রাত ৯টা ২৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। দেশবরেণ্য সাংবাদিক, সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক সফল সাংবাদিকের জীবনের সমাপ্তি ঘটল। নিভে গেল এদেশের সাংবাদিকতার উজ্জ্বল বাতিঘর। বিশিষ্ট এই সাংবাদিকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পৃথক শোকবার্তায় তারা মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রিয় সম্পাদকের মৃত্যুতে সমকালের প্রকাশক এ কে আজাদসহ সমকাল পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। সহকর্মীদের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন গোলাম সারওয়ার। তিনি হৃদরোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়া ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। সোমবার দুপুরের পর থেকে গোলাম সারওয়ারের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বিকেল পাঁচটায় লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয় তাকে। তখন চিকিৎসকরা তার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন বলে জানিয়েছিলেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে। সিঙ্গাপুরে গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে তার স্ত্রী সালেহা সারওয়ার, দুই ছেলে গোলাম শাহরিয়ার রঞ্জন ও গোলাম সাব্বির অঞ্জন ও জামাতা মিয়া নাইম হাবিব গিয়েছিলেন। এর আগে উন্নত চিকিৎসার জন্য ৩ আগস্ট মধ্যরাতে গোলাম সারওয়ারকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। পরদিন সকালে তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল। নিউমোনিয়া সংক্রমণ হ্রাসের পাশাপাশি ফুসফুসে জমে থাকা পানিও কমে গিয়েছিল। হার্টও স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল। কিন্তু গত রবিবার হঠাৎ করে তার রক্তচাপ কমে যায়। কিডনিও স্বাভাবিকভাবে কাজ করছিল না। সোমবার তিনি মারা যান। এরও আগে গত ২৯ জুলাই মধ্যরাতে গোলাম সারওয়ার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। এদিকে সমকাল সম্পাদককে দেখতে সোমবার দুপুরে হাসপাতালে যান সিঙ্গাপুরে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় দূতাবাসের উর্ধতন কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে ছিলেন। বিভিন্ন মহলের শোক ॥ গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ, পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী ও র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ। তারা মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং পরিবারের সদস্যসহ ঘনিষ্ঠজন যাতে এই কষ্ট সইতে পারেন মহান আল্লাহর কাছে তারা সে কামনা করেন। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন ॥ বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে গোলাম সারওয়ার উজ্জ্বল এক নাম। মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সোচ্চার এ মানুষটি সাংবাদিকতা জগতের প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতার শুরু থেকে একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এ পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নীরবচ্ছিন্ন চর্চায় নিজেকে এবং বাংলাদেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দৈনিক ইত্তেফাকে দীর্ঘ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি একাধারে সৃজনশীল ও পেশাদার সাংবাদিকতায় অতুলনীয় দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পূর্বাণীতে তারই সম্পাদনায় এদেশে প্রথম ম্যাগাজিন আকারে বৃহদায়তনের ঈদসংখ্যা প্রকাশের রীতি শুরু হয়। তার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক হিসেবে পূর্বাণী অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ সব কৃতিত্বের ধারাবাহিকতায় তিনি দেশের দুটি সেরা দৈনিক যুগান্তর ও সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক এবং এর ছয় বছর পর ২০০৫ সালে আরেকটি নতুন দৈনিক সমকালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে যান সে দায়িত্ব। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, ক্ষুরধার মেধা ও অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতা পত্রিকা দুটিকে দ্রুততম সময়ে পাঠকপ্রিয় করে তোলে। মেধা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার কারণে গোলাম সারওয়ারকে অনেকেই সাংবাদিকদের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করেন। তার হাতে গড়া অন্তত পাঁচ শতাধিক সাংবাদিক এখন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টেলিভিশন মাধ্যমে নিজ নিজ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিনিই প্রথম এদেশে প্রতিদিন রঙিন খেলার পাতা, বিনোদন পাতা, নানা স্বাদের গুচ্ছ গুচ্ছ ফিচার প্রকাশ করার রীতি প্রবর্তন করে দৈনিক পত্রিকার চেনা অবয়বকে পাল্টে দিয়ে একটি দৈনিককে পরিবারের সব সদস্যের উপযোগী করে তোলার পরিকল্পনাকে সফলভাবে বাস্তবায়িত করেন। গোলাম সারওয়ার এদেশের সংবাদপত্রের সাফল্য ও পেশাদারিত্বের প্রতীক। জন্ম ও শিক্ষা জীবন ॥ তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্যা ও মা মরহুম সিতারা বেগম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মানসহ এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে তার সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত সংবাদে চাকরিরত ছিলেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিজ এলাকা বানারীপাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার পরপরই ১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে সিনিয়র সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে প্রধান সহসম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সাংবাদিকতায় জীবনব্যাপী অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। সৃজনশীল সাহিত্যে গোলাম সারওয়ারের অকৃত্রিম আগ্রহ ও উদ্যোগ তার সৃষ্টিশীলতা ও প্রাণময়তার আরেক ক্ষেত্র। দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যকে তিনি মানে ও মর্যাদায় স্বতন্ত্র করেছেন। তিনি দক্ষ ছড়াকার, ষাটের দশকে অসংখ্য ছড়া লিখেছেন। সত্তরের দশকেও ছড়ায় সচল রেখেছিলেন নিজের কলম। রঙিন বেলুন নামে শিশু একাডেমি থেকে প্রকাশিত ছড়ার বইটি তার ছড়া সৃষ্টির উজ্জ্বল নিদর্শন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতে একসময় তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ। তার লেখা বেশ কয়েকটি গান আজও শ্রোতাহৃদয়ে শিহরণ জাগায়। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে সম্পাদকের জবানবন্দী, অমীয় গরল, আমার যত কথা ও স্বপ্ন বেঁচে থাক প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
×