ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

যাত্রীরা কি জিম্মিই থাকবে?

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১২ আগস্ট ২০১৮

যাত্রীরা কি জিম্মিই থাকবে?

পরিবহন ব্যবস্থায় যেসব ঘটে চলছে তা জাতিকে বার বার স্তম্ভিত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে। বাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান এই যানগুলো প্রকৃত অর্থেই আজ রাজপথে দানবে পরিণত হয়েছে। এক সময় হানিফ সংকেত তার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে দেখিয়েছিল বলে ট্রাক চালকেরা সে সময় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। এরপর দিনে দিনে রাজপথে বড়, ভারি এবং ছোট যানের সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে ঢাকার জনসংখ্যা, পথযাত্রী, বাস-টেম্পো, রিক্সা যাত্রীর সংখ্যাও। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্ঘটনা নামে নিরীহ মানুষের মৃত্যু। প্রশ্ন জাগে, প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনা বাস-ট্রাকের ধাক্কায় বা পিষ্ট হয়ে অথবা বাস-ট্রাক উল্টে নিরীহ যাত্রী, পথযাত্রী বা অন্য যানের যাত্রীর মৃত্যু হবে কেন? এর কোন সমাধান কি কোনদিন হবে না? গত দুবছর আগে রাজধানীর পরিবহন খাতের অরাজকতা দূর করতে প্রথম কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। তাঁর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর কারণে উদ্যোগটি অন্ধকারে নিমর্জিত হয়। এটা কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে? বরং আমরা অপেক্ষা করছিলাম, শীঘ্রই দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন পরিবহন খাতটির আধুনিকায়নের সেই পরিকল্পনাটি পুরো ঢাকার জন্য দ্রুত বাস্তবায়নের কাজটি শুরু করবেন। কিন্তু হতাশ হয়ে লক্ষ্য করলাম, আনিসুল হকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঐ পরিকল্পনাটিরও যেন মৃত্যু হয়েছে। কেন? পরিবহনমন্ত্রী, মেয়র মিলে ভাল একটি উদ্যোগকে লুফে নিয়ে অন্য দেশের মতো বাসগুলোকে কয়েকটি কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে রুট ও বাস নম্বর অনুযায়ী পরিচালনা করা শুরু করলেন না কেন? জাতি উন্নয়নশীল দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে কিভাবে গণ্য হবে কিভাবে যখন দেশে প্রতিদিন বাস-ট্রাক দ্বারা রাজপথের দুর্ঘটনা বা রাজীব, দিয়া, করিম, পায়েলের মতো শিক্ষার্থীরা হত্যাকা-ের শিকার হয়? প্রতিদিন কমপক্ষে দশজন নিরীহ নারী, পুরুষ এই বাস-ট্রাকের উন্মত্ততার এবং সীমাহীন লোভের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে যাদের প্রাণের মূল্য এসব অর্থলোভী বাস-ট্রাক-মালিক ও নিরক্ষর হৃদয়হীন অদক্ষ চালকদের কাছে বিন্দুমাত্র নেই। বাংলাদেশ বাস-ট্রাক-মালিক ও চালক শ্রমিকরা কেন তাদের অপরাধের জন্য বিচার ও দ-ভোগ করবে না, এই প্রশ্নটি জাতিকে দীর্ঘদিন যাবত বিব্রত করছে। এটা অদ্ভুত, তারা নিজেরা নিজেদের দায়মুক্তি দিচ্ছে এবং দ-িত হলেই পুরো জাতিকে তারা জিম্মি বানাবে- এটা তো পৃথিবীর কোন দেশে কেউ দেখিনি। বাস-ট্রাক-মালিক ও চালকরা কি আইনের উর্ধে যেÑ তারা সব বিচারের রাইরে থাকবে? তারা অপরাধ করবে, আহত যাত্রীকে ইট দিয়ে আধমরা করে নদীর পানিতে ফেলে দেবে, বাসের জন্য অপেক্ষারত ছাত্র-ছাত্রীর দলের ওপর বাস উঠিয়ে দিয়ে হত্যা ও আহত করবে, ধাক্কা দিয়ে পথচারীকে হত্যা করবে, হাত, পা বিচ্ছিন্ন করে দেবে, এত বড় বড় অপরাধ করেও তাদেরকে বিচার করে সর্বোচ্চ, উপযুক্ত শাস্তি দেয়া যাবে না কেন? রাষ্ট্রের সব নাগরিক আইন মানতে বাধ্য অথচ তারা আইনের উর্ধে থাকার এক রীতি তৈরি করেছে যা দেশের আইনের শাসনকে প্রতিষ্ঠিত হতে প্রতিনিয়ত বাধা দিচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে- ওরা কি সরকারের চাইতেও ক্ষমতাবান? ওরা যদি দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়, তাহলে তাদের দেশের নাগরিকত্ব থাকবে কেন? দেখা যাচ্ছে, এরা অপরাধ করতে করতে, বিচারের উর্ধে থাকতে থাকতে এখন বাস যাত্রীকে ফেলে রওনা হওয়া, বাসে উঠতে যাওয়া যাত্রী পড়ে গিয়ে আহত হলে তাকে হত্যা করে খালে ফেলে দিতে পারে! মুখোমুখি সংঘর্ষ করে যাত্রী হত্যা, রিক্সা- মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দিয়ে যাত্রী হত্যা করা, সিএনজির ওপর বাস-ট্রাক তুলে দিয়ে যাত্রী হত্যা করা, প্রতিদিন ওদের হাতে অসংখ্য হত্যার মতো অপরাধ সংঘটনের পরও তারা কিভাবে থাকছে বিচারের বাইরে! এই ‘ইনডেমনিটি’ তাদেরকে দিয়েছে? এবং দ-িত হলেই বাস-ট্রাক না চালিয়ে জাতিকে জিম্মি করে নিজেদের বিচারের বাইরে রাখার ঘৃণ্য কৌশল আর কতদিন চলবে। এসব দূর করবার প্রথম পদক্ষেপ হবে মালিক-চালক উভয়ের বিচার দ- প্রদান করা। তাহলে সম্ভবত এদের স্বেচ্ছাচারিতা হ্রাস পেতে পারে। দ্বিতীয়ত. চালকদের মাসিক বেতন দিয়ে দুই ধরনের প্রশিক্ষণ দিতে হবে গাড়ি চালনার জন্য প্রয়োজনীয় যান্ত্রিক প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স ইত্যাদি পরীক্ষা গ্রহণ করে প্রদান এবং গাড়ির যাত্রী, পথযাত্রী ও অন্য যানকে রক্ষা করার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি, নাগরিক, মানবিক দায়িত্বজ্ঞান সৃষ্টি করা চালক প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে। তৃতীয়ত. শুধু বাস চালকদের নয়, বাস মালিক-হেলপার, শ্রমিকদেরকেও রাজপথের পথযাত্রী, অন্য গাড়ির যাত্রী, নিজ গাড়ির যাত্রীদের প্রাণ রক্ষা করার সব রকম নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সম্বন্ধে সচেতন ও সতর্ক করা দরকার। চতুর্থত. পরিবহন আইন সম্পর্কে কি কি অপরাধ করলে কি শাস্তি নির্ধারিত আছে-তা চালক-মালিক সবাইকে জানতে হবে। পঞ্চমত. রাজপথে গাড়ির নানা রকম নিয়ম-কানুন, রোড-চিহ্ন, জেব্রা ক্রসিং, স্কুল কলেজ-হাসপাতালের সামনের নিয়ম সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, বিশেষত ওভারটেক করার সাধারণ নিয়ম, সামনের গাড়ির নির্দেশ অনুসরণ করা হলে অনেক বড় বড় মুখোমুখি সংঘর্ষের আশঙ্কা হ্রাস করতে পারে- এ বিষয়ে চালকদের সচেতন করতে হবে। অকাল প্রয়াত আনিসুল হকের পরিকল্পনা- সব বাসকে চারটি কোম্পানিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজটি মেয়র সাঈদ খোকনের উদ্যোগে সড়ক পরিবহনসহ অন্যান্য সংস্থা, মালিকপক্ষ যৌথভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করলে তাঁর নিজের এবং সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়- এটি তাঁরা উপলব্ধি করেন না। তাঁরা এ কাজকে পরাজয় মেনে নেয়া মনে করছেন, যা সঠিক নয়। বাস্তব জীবনে এমন অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়, যাতে আমাদেরকে দুই পা পিছিয়ে আসলে দেখা যায় এতে মঙ্গলই হয়েছে। এ সঙ্গে বলি, শুধু করিম ও দিয়া নয় নর্থ সাউথের ছাত্র পায়েলকে হত্যা করা হয়েছে, তার এবং গত দুদিনে হাসপাতালের নার্স, টাঙ্গাইল, গাজীপুরে ছাত্র-ছাত্রী কার্ভাডভ্যানের ও বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছে-এদের সবার হত্যার বিচার করে ও দোষী চালকের হত্যাকারী হিসেবে দন্ড দিতে হবে। সড়ক পরিবহন তৈরিতে মুক্ত সংস্থার কর্মকর্তারা ভারতের রাজ্যগুলোর প্রশস্ত, সুন্দর পিচঢালা রাজপথ আমাদের জন্য তৈরি করতে পারে না কেন? কেন?-এর জন্য ভারতে রাজপথ, হাইওয়ে তৈরিতে কি উপকরণ ব্যবহার করে তৈরি হয়, সেটি জেনে অনুসরণ করা প্রয়োজন। এটি লজ্জার বিষয় যে আমাদের দেশের রাস্তা তৈরির ব্যয় ভারত এবং অন্য যে কোন দেশের চাইতে অনেক বেশি অথচ রাস্তার মান এতই নিম্নমানের যে এগুলো রাজধানী বা বড় শহরের রাজপথ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ সভায় সব মহলের চাওয়া ‘সড়ক পরিবহন আইন’ অনুমোদিত হয়েছে যাতে বলা হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে চালকের হাতে হত্যা হিসেবে গণ্য করা হবে কি-না, এ বিষয়টি তদন্তের ওপর নির্ভর করবে এবং তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে দুর্ঘটনার ফলে মৃত্যুকে হত্যা গণ্য করা হবে এবং তখনই হত্যার জন্য ফাঁসি হবে। এই শর্তে যাত্রী, ভুক্তভোগী ছাত্র-ছাত্রী, যানবাহন দুর্ঘটনায় স্বজন হারানো মা, বাবা, ভাই, বোন, কেউই সন্তুষ্ট হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই ছাত্র-ছাত্রীকে পিষে যাওয়া বাসের চালককে হত্যাকারী গণ্য করার কথা, একই সঙ্গে অতি বর্বর অমানুষিক কায়দায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পিয়ালকে ঠা-া মাথায় চালক ও হেলপাররা হত্যা করেছে বলে গণ্য করতে হবে। এ দুটো ঘটনা এবং এর আগে, দু’বাসের চাপায় রাজীবের হাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনা, অনেক বাস-ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-এর ধাক্কায় ছাত্র-ছাত্রী, নারী, শিশু, পুরুষ নিহত হয়েছে যেগুলো চালকদের অমানবিক বেপরোয়া চালনার পরিণতি। এগুলো হত্যা হিসেবে গণ্য হবার উপযুক্ত কেননা সতর্ক, সচেতন হলে বর্বর দুর্ঘটনা মালিককে যা এড়ানো যেত, এড়ানো সম্ভব ছিল, কিন্তু মানুষের প্রাণের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়িত্বশীল আচরণ ও মমতা থাকলে এর একটি দুর্ঘটনাও মৃত্যু ঘটাত না। বড়জোর পথযাত্রীরা আহত হতো, মৃত্যুবরণ করত না। চালকের বেপরোয়া মনোভাবের ফলে সংঘটিত এসব মৃত্যুকে হত্যাকা- গণ্য না করার কোন সুযোগ নেই। তাছাড়া, বাসে ধর্ষণের জন্যও ফাঁসির দন্ড প্রদান জরুরী। এছাড়া আহতদের চিকিৎসা ব্যয়, নিহতদের ক্ষতিপূরণ বাস মালিককে প্রদানে বাধ্য করার ব্যবস্থাও থাকা দরকার। নতুবা মালিকপক্ষ চিরকাল দায় এড়িয়ে বিচার ও দন্ড, ক্ষতি-পূরণের বাইরে থেকে যাবে। এ সবের বাইরে, রাজপথে যান চলাচলের নিয়ম সম্পর্কে সিএনজি, রিক্সা, সাইকেল, মোটরসাইকেল চালকদের সচেতন করতে মাইকিং, লিফলেট বিতরণ করা দরকার। যাতে এদের ভুলের কারণে যাত্রীকে দুর্ঘটনায় পড়তে না হয়। এর বাইরে আছে-পথযাত্রী। এরা প্রায়ই চলন্ত যানবাহনের সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপার করে যাতে প্রায়ই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এদেরকে ওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে হবে। সোনারগাঁও মোড়ে এ সমস্যা প্রকট, এখানে আরও কয়েকটি আন্ডারপাস তৈরি করা প্রয়োজন যেগুলোতে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে যাতে নারী-শিশু নিরাপদে এগুলো ব্যবহার করতে পারে। জাতি বাস-ট্রাক মালিক ও চালকদের হাতে জিম্মি, এদের বড় বড় দুর্ঘটনায় শাস্তি দেয়া যায় না- এই প্রচলিত কথাগুলো যেগুলো আইনের শাসনের প্রতি হুমকিস্বরূপ, এগুলোকে মিথ্যা, ভিত্তিহীন প্রমাণ করতে হবে মালিক-চালক-পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবাইকেই এবং সেই সঙ্গে সরকারকেও। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×