ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন দেশ কেমন সমাজ চাই আমরা?

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১১ আগস্ট ২০১৮

 কেমন দেশ কেমন সমাজ চাই আমরা?

বাংলাদেশ কি আসলে বদলে যাচ্ছে? সত্যের মুখোমুখি হতে কি ভয় পাচ্ছি আমরা? গত কয়েকদিন বিশেষত সপ্তাহ ধরে যা ঘটেছে তাতে আমাদের বিবেকের দরজা একটু হলেও নড়ে ওঠার কথা। যখন এ দেশ স্বাধীন হয় তখন আমি কিশোর। যখন এদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতাকে হত্যা করা হয় তখন আমি যৌবনে পা রাখছি। যখন এদেশে জিয়াউর রহমান হ্যাঁ-না ভোট আর পাকি কায়দায় দেশ শাসনের শুরু করেন তখন আমি যৌবনে। আর আমাদের যৌবনের পুরোটাই কেড়ে নিয়েছিল এরশাদের একনায়কতন্ত্র। কত ঘটনা কত অঘটন। তবু কোনদিন আশা ছাড়িনি। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমাদের মা-বাবা ছিলেন সাধারণ মানুষ। মামার জোর, টাকার বড়াই বা আত্মীয়-স্বজনের কোন শক্তি ছিল না আমাদের। নিয়মিত যে জীবন তাতেই বড় হয়ে ওঠা। চারদিকে সাম্প্রদায়িকতা তখন সাপের মতো হিসহিস করছিল। যতবার কোন প্রতিযোগিতামূলক টেস্টে বসেছি লিখিত কোন কিছু হলেই সামনের সারিতে জায়গা পেয়েছি। কারণ তখনও আমি নাম্বার। যেই নাম বেরিয়ে আসত অমনি বিপদ। তারপর আর কৃতকার্য হতে দেয়া হতো না। ব্যাংকের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে মৌখিক টেস্টে শুনলাম, আমাকে চাকরি দিলে পাশের দেশে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারি। বিসিএস পাস করেও শিকে ছিঁড়তে গড়িমসি। ততদিনে আমি বিদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। তারপরও কোনদিন আশা হারাইনি। কারণ তখন মুষ্টিমেয় মানুষ এসব করতেন। আর বেশিরভাগ মানুষ চাইতেন দেশের ভাল হোক। সবাই মিলেমিশে শান্তিতে থাকুক। এখন দেশ আগের জায়গায় নেই। উন্নতি আর অগ্রগতি তার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। দেশে গেলে চোখে পড়ে মানুষের জীবনে কতটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা ভাগাভাগি করে জামাকাপড় পড়তাম। আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ায়। তারা প্রফেসরও হয়ে গেছে। তাদের কারও কারও সঙ্গে শার্ট-প্যান্ট শেয়ার করার স্মৃতি আছে আমার। তাদের কেউই জন্ম পরিচয়ে আমার ধর্মের না। কিন্তু সে পরিচয় কখনও বাধা হয়নি। বন্ধু বন্ধুই ছিল। আমরা ফ্যাশন অসচেতন ছিলাম না। দুনিয়াও আমাদের অজানা ছিল না। আজ যখন হাতে হাতে মিডিয়া ই-বুক ই-রিডার বা অনলাইন বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে তখন আমাদের প্রজন্ম বইপড়া প্রায় বাদ দিয়ে দিয়েছে। আর আমরা? একটা ভাল উপন্যাস কিংবা বই ফটোকপি করে বন্ধুদের মাঝে বিলিয়ে একসঙ্গে পাঠ করতাম। কোন নতুন কবিতা বা কোন ছবি কিংবা সিনেমা একা দেখতাম না, একা উপভোগ করতাম না। এভাবেই আমাদের জীবন যৌথ অথবা সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল। আমরা বনিএমের গান শুনতাম। এলভিস প্রিসলির নাচ নাচার চেষ্টা করতাম। আমাদের দেশের পপগুরু আজম খান আমাদের তারুণ্যকে মুখরিত করে রাখত। যিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশপ্রেমিকেরা তখন ভিন্নমত বা ভিন্ন চিন্তার মানুষ হলেও পথ হারাতেন না। আজকাল এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। বরং উল্টোটাই রীতি। উল্টো বলতে দেশের নাম দেশের মানুষের নামে টাকা কামিয়ে দেশের আগাপাশতলা ভোগ করে তথাকথিত শোবিজদের আসল চেহারা এখন ভয়ঙ্কর। আপনি কখনও শুনেননি এদেশের কোন চাষা কিংবা কোন ভিখারী দেশবিরোধী কিছু করেছেন বা বলেছেন। তারা প্রণম্য। তাদের শ্রমে মেধায় পরিপুষ্ট সমাজের আগাছারাই আপদ। এরা যে যেখানে যেভাবেই থাকুক তাদের কাজ সরকার কিংবা দেশের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু করা। আজকাল এত সেলিব্রেটি আর এত নামজাদা মানুষ কে যে কে সেটা বোঝাও দায়। এবারের গ-গোলে নওশাবা নামের একটি মেয়ে তারকার ছবি দেখে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না এমন মেয়ে কি করে তারকা হতে পারে। সে হয়েছিল তাতে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম বাচ্চাদের আন্দোলন অথবা মনোজাগতিক অশান্তিকে পুঁজি করে তার উৎকট আগ্রহের করুণ পরিণতি। কিন্তু কেন? যারা বলছে টাকার জন্য করেছিল তা আংশিক সত্য হলেও মানা কঠিন। এর পেছনে আরও বড় কোন ঘটনা আছে। যা হয়ত আমরা কোনদিনও জানতে পারব না। ঐ যে বলছিলাম, সেলিব্রেটি তার সংজ্ঞা বোঝা দায়। সুশাসনের জন্য গড়ে ওঠা একটি সামান্য সংগঠন যার ঢাল তলোয়ারহীন সর্দার বদিউল আলম মজুমদার। আপনি গ্রামগঞ্জের কথা বাদ দিন খোদ ঢাকায় একলাখ মানুষকে প্রশ্ন করে দেখুন কে এই বদিউল আলম মজুমদার? তাদের একজনও বলতে পারবে না। অথচ ঘটনার সময় তিনি ও তার পেয়ারের দোস্ত মার্কিন মুল্লুকের রাজদূত এক বাসায় আড্ডা দিচ্ছিলেন। আড্ডা দেয়ার আর টাইম পেলেন না তারা? এই বদি ভাইয়ের সঙ্গে নাকি ড. কামাল হোসেনেরও বড় খাতির। সে রাতে তিনিও ছিলেন সেখানে। কে না বুঝবে এর পেছনে আসলে কি উদ্দেশ্য ছিল। দেশের দুটি সংবাদপত্র এদের শরীরের চেয়ে মাথা বড় করে ফেলায় এরা আসলে এখন আর নিজেদের ভার বহন করতে পারছেন না। মুশকিল এই যত রাগ আর ক্রোধ সব আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। আপনি অনায়াসে ষড়যন্ত্রকে ষড়যন্ত্র বলতে পারবেন না। তখন মানবাধিকার কথা বলবে। আর যদি আপনি ন্যায় বা সত্যের হয়ে কথা বলেন তাহলেও আপনাকে ভুগতে হবে। ফলে আজকের বাংলাদেশ পোশাক খাদ্য উপার্জনসহ নানা বিষয়ে মাইলফলকে পৌঁছালেও মনে রাখবেন বেশ বড় সংখ্যার মানুষ সন্তুষ্ট নন। শেখ হাসিনা যদি তাদের বাড়িতে বাড়িতে চাঁদ এনেও দেন এরা সুখী হবে না। কারণ এদের পাকপ্রীতি। ভারত বিরোধিতা। এরা নিজেরা ভারতের সেবাদাস হলেও মানুষকে তার বিরুদ্ধে রাগিয়ে রাজনীতি করতে অভ্যস্ত। কারণ এতে খুব বেশি মেধা বা শ্রমের দরকার পড়ে না। এবারের আন্দোলন নামের যে ঘটনা তার যতটুকু প্রাপ্য ছিল সেটাও এরা নষ্ট করতে কসুর করেননি। কে না চায় সড়ক নিরাপদ থাকুক। কে না চায় এদেশের মানুষ শান্তিতে ঘুমাক। কিন্তু সবাই আবার এও চায় গাছের খাব তলার কুড়াব তবে সরকার আর উন্নয়ন মানব না। এমন বাংলাদেশে কিভাবে শেখ হাসিনা টিকে আছেন সেটাই আশ্চর্যের। আরও আশ্চর্যের সরকারের কিছু মন্ত্রীর ব্যবহার। যারা দুনিয়ার বাইরের মানুষের মতো আচরণ করে প্রায়ই বিপদ টেনে আনে। আমরা এমন আওয়ামী লীগ এমন বাংলাদেশ বা এমন বিরোধিতার কিছুই চাইনি। যৌবনে শত কষ্ট আর বেদনার পরও আমাদের আশা ছিল মুক্তিযুদ্ধের দেশে প্রগতি আর শান্তি হাত ধরাধরি করে চলবে। এখন মনে হয় সে আশায় কোথাও গলদ ছিল হয়ত বা। শেখ হাসিনা যতটুকু পেরেছেন বাকিটা কারা টেনে নিয়ে যাবেন বা আদৌ পারবেন কি-না সে প্রশ্ন এখন বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ। তবু আশাই জীবন। মূলত আমাদেরকেই ঠিক করতে হবে কেমন দেশ কেমন সমাজ আর কিভাবে বাঁচতে চাই আমরা। এর কোন বিকল্প দেখি না।
×