ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরবঙ্গের খাসজমির অর্ধেক প্রভাবশালীদের দখলে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৮ আগস্ট ২০১৮

উত্তরবঙ্গের খাসজমির অর্ধেক প্রভাবশালীদের দখলে

সমুদ্র হক ॥ উত্তরবঙ্গে যে সরকারী খাসজমি আছে তা উদ্ধার করে ১০ লাখ ভূমিহীনকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা ৬০ লাখ। যাদের বড় একটি অংশ নদী ভাঙ্গনের থাবায় পড়ে ভাসমান। বাকিরা বসতভিটা জমি জিরাত থেকে বঞ্চিত। সরকারী হিসাবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় সরকারী খাসজমির পরিমাণ ৩ দশমিক ২০ লাখ একর। যার অর্ধেকেরও বেশি প্রভাবশালীরা বহু বছর ধরে অবৈধ দখলে রেখেছে। রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার নূর উর রহমান জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে ভূমিহীন ও বাসস্থানবিহীনসহ চার ক্যাটাগরির সকল মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়া হবে। এ জন্য ডাটাবেজ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে দুই ক্যাটাগরির ভূমিহীনদের বাসস্থানের ব্যবস্থা হবে। ইতোমধ্যে উপজেলাগুলোতে এই কাজ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে খাসজমিতে আশ্রয়ণ বা আবাসন গড়ে তোলা হবে। খাসজমির অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদও শুরু হয়েছে। এদিকে এরই মধ্যে বগুড়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী গত এক বছরে অবৈধ দখলদারের কয়েকজনকে উচ্ছেদ করে সারিয়াকান্দি, ধুনট ও দুপচাঁচিয়ায় খাসজমিতে গুচ্ছগ্রাম বানিয়ে ১ হাজার ৫শ’ ভূমিহীনের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্দে উচ্ছেদের নোটিস যাওয়া শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, চলমান প্রক্রিয়ায় নদী ভূমি উদ্ধার করা হবে। বিভিন্ন স্থানের স্থানীয় প্রশাসন জানায়, অবৈধ দখলে থাকা খাসজমি উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। কখনও মামলার কারণে উদ্ধার প্রক্রিয়া থমকে যায়। ফলে দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভূমি ও জরিপ রেকর্ড অধিদফতরের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে প্রভাবশালীদের ‘গভীর সম্পর্ক’ আছে। তাদের বিরুদ্ধে ‘গোপনে নয়ছয়’ করার অভিযোগও পাওয়া যায়। খাসজমির অবৈধ দখলদারদের মধ্যে আছে, বড় ব্যবসায়ী, মহাজন, জোতদার, হাউসিং ব্যবসায়ী, দাদন ব্যবসায়ী, এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, বড় ঠিকাদার ও অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উঠতি ধনী। এই প্রভাবশালীরা জাল দলিল করে, ভুয়া রেকর্ডের মাধ্যমে খাসজমি নিজেদের নামে নামজারি করে ভোগ দখল করছেন। অনেক ক্ষেত্রে সরকারীভাবে বরাদ্দ দেয়া খাসজমি থেকে ভূমিহীনদের বিতারিত করে দখল নেয়া হয়েছে। ভূমি ও জরিপ রেকর্ড অধিদফতরের এক সূত্র জানায়, রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলায় খাসজমির পরিমাণ ২ লাখ ৯২ হাজার ৯শ’ ৮২ একর। এর মধ্যে অকৃষি ভূমি ১ লাখ ৮ হাজার ৯শ’ ৮৩ একর। রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় খাসজমির পরিমাণ ১ লাখ ৭ হাজার ২শ’ ৭৩ একর। এর মধ্যে ৬০ হাজার ৮শ’ ১৫ একর অকৃষি। দুই বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খাসজমি রাজশাহী বিভাগে। রাজশাহী ভূমি জরিপ ও রেকর্ড অফিসের সাবেক কর্মকর্তা (দেড় মাস আগে ঢাকায় স্থানীয় সরকার বিভাগে যোগদান) মোঃ রফিক জানান, জেলা প্রশাসকরা উদ্যোগ নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারী অনেক খাসজমি উদ্ধার করে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় এ ধরনের আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। বগুড়া সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ধুনট দুপচাঁচিয়া এলাকায় এমন আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আশ্রয়ণের মধ্যে পুকুর ও চাষাবাদের ভূমি দেয়া হয়। সেখানে ভূমিহীনদের কর্মজীবী করে তোলার ব্যবস্থা থাকে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার নির্বাহী অফিসার সাবিহা সুলতানা জানান, বোহাইল ইউনিয়নের শংকরপুরে খাসজমি উদ্ধারে ভূমিহীনদের বাসগৃহ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ধারাবর্ষা চরের খাসজমিতে পরিবেশ রক্ষায় অনেক আগেই সামাজিক বনায়নে শালবন তৈরি হয়েছে। জরিপ বিভাগের আরেক কর্মকর্তা মোঃ নাইমুল ইসলাম জানান, তারা কোথায় কি পরিমাণ ভূমি আছে তা জরিপ করেন। এর মধ্যে খাসজমিরও হিসাব থাকে। খাসজমিতে ভূমিহীনদের ঘর বাড়ি করে দেয়ার কার্যক্রম চলমান প্রক্রিয়ায় আছে। জেলা প্রশাসকরা এগুলো বাস্তবায়ন করেন। বগুড়া অঞ্চলে খাসজমির পাশাপাশি নদী ভূমিও দখল করা হচ্ছে। বগুড়া নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া এখন শুকনো প্রায়। প্রভাবশালীরা নদী ভূমির ভিতরে বালি ফেলে দখল করে অবকাঠামো স্থাপনা গড়ে তুলছে। খাসজমি দখলদাররা দখলের পরই ভূমির আকৃতি পাল্টে ফেলে। কেউ আবাদি জমিতে গড়ে তোলে অবকাঠামো স্থাপনা। কেউ স্থাপন করে শিল্প কারখানা। বগুড়া জেলা প্রশাসন গেল প্রায় দশ বছরে কয়েক দফা নদী ভূমি দখলকারীদের উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি। ভূমিহীনদের এক নেতা মোশাররফ হোসেন বলেন, উত্তরাঞ্চলে ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ ভূমিহীন হয়ে ভাসমান। খাসজমির অর্ধেক উদ্ধার করে পরিকল্পিতভাবে বরাদ্দ দিলে অন্তত দশ লাখ পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা হবে।
×