ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গড়ে তোলা হয়েছিল ঘুষের তহবিল

কয়লা চুরি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে ব্যয় ২৯ কোটি টাকা!

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ৬ আগস্ট ২০১৮

      কয়লা চুরি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখতে ব্যয় ২৯ কোটি টাকা!

রশিদ মামুন ॥ বছরের পর বছর ধরে কয়লা চুরির ঘটনা ধামাচাপা দিতে সরকারী কোম্পানি বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল) ঘুষের তহবিল গড়ে তুলেছিল। কর্মচারী কর্মকর্তাদের বার্ষিক লভ্যাংশের শেয়ারের (প্রফিট বোনাস) ১০ ভাগ কেটে রাখা হতো এই তহবিলে। তহবিলে এভাবে বার্ষিক জমা হতো দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা। পুরো ১৩ বছরের হিসাবে এর পরিমাণ ২৯ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এই অর্থ খরচের কোন হিসাব রাখা হতো না, কোন হিসাব কাউকে দিতেও হতো না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই অর্থের পুরোটাই পেট্রোবাংলা এবং জ¦ালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের তুষ্ট করতে ব্যয় করা হতো। যাতে বড়পুকুরিয়া থেকে তারা দৃষ্টি সরিয়ে রাখেন। অনুসন্ধান বলছে, ১৩ বছর ধরেই এই তহবিল নিয়ন্ত্রণ করত প্রতিষ্ঠানটির সাবেক জিএম আবুল কাশেম প্রধানিয়া। তিনি মূলত পেট্রোবাংলা এবং জ¦ালানি বিভাগ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করতে এই অর্থ ব্যয় করতেন। একই সরকারী কোম্পানি কিভাবে স্রেফ ঘুষ দিতেই অর্থ কেটে রাখে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বছরের পর বছর ধরে এই কোম্পানিকে যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারাই অর্থ এবং উপঢৌকন পেত এখান থেকে। সঙ্গত কারণে বড়পুকুরিয়া খনি নিয়ন্ত্রণের বদলে দৃষ্টি সরিয়ে রাখত। পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, এই তহবিল জেলা প্রশাসকদের লোকাল রিলিফ ফান্ড (এলআর তহবিল) এর মতোই। এখানে কেটে রাখা অর্থ কোম্পানি কি কাজে খরচ করত, তার কোন হিসাব রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল না। কোম্পানির বার্ষিক হিসাবে এই অর্থকে অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব থেকে সংশ্লিষ্ট উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং এর চেয়ে পদস্থ কর্মকর্তাদের কোম্পানির কার্যক্রম নিয়মিত পর্যালোচনা করার কথা। এছাড়া পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান থেকে নিচের দিকে পরিচালক অপারেশন এ্যান্ড মাইনসহ অন্য যাদেরই এই কোম্পানির কার্যক্রমে সংশ্লিষ্টতা থাকার কথা তাদেরই ম্যানেজ করা হত। কি উপায়ে ম্যানেজ করা হত জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, এরা এমন কাজ নেই করত না। কারও মেয়ের বিয়ের খরচ থকে শুরু করে কারও বাড়ি সাজিয়ে দেয়া, দামী উপহার সামগ্রী দেয়া হত। বিদেশ ভ্রমণের খরচ বিদেশে মার্কেটিং করার অর্থও দেয়া হত। কেউ চাইলেও পেত আবার কেউ না চাইলেও এরা যেচে দিয়ে যেত। যেহেতু চাইবার আগেই বড়পুকুরিয়ার পণ্য এসে হাজির হত তাই বড়পুকুরিয়া নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই তহবিল যে কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করতেন অর্থাৎ নিয়মিত উপঢৌকন দিয়ে মন্ত্রণালয়, পেট্রোবাংলা এবং বড়পুকুরিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন দৃঢ় করার কাজটি করেছেন তিনি আবুল কাশেম প্রধানিয়া। প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপক এই প্রধানিয়ার প্রতি সেই মায়াতে কঠোর হতে পারেনি কেউ। উপরের দিকের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হলেও কাশেম প্রধানিয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানিতে বদলি করে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোম্পানির পরিচালকরা অনৈতিকভাবে অর্থ খরচের বিষয়টি আদৌ দেখেন কি না জানতে চাইলে কোম্পানির পরিচালক নেহাল আহমেদ বলেন, আমরা বিষয়টি জানি না। যে মিটিংয়ে যে এজেন্ডা থাকে তখন সেই এজেন্ডাগুলো দেখা হয়। কোম্পানির বোর্ডের এ ধরনের বিষয় দেখা উচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অনেকটা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এসব কোম্পানির চেয়ারম্যানই দেখতেন। আবুল কাশেম প্রধানিয়ার সঙ্গে এ সব বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠিয়ে ফোনে কথা বলার আগ্রহ জানালে তিনি ফোনটি বন্ধ করে রাখেন। পরবর্তীতে তিনি ফোন আবার খোলার পরও কয়েক দফা চেষ্টা করলে তিনি সাড়া দেননি। বড়পুকুরিয়া খনির ২৩০ কোটি টাকার কয়লা চুরি হওয়ায় মামলা করেছে খনি কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই কয়লা চুরি অব্যাহত রাখতেই ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
×