ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

এসব হুমকি অশনিসঙ্কেত

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৫ আগস্ট ২০১৮

এসব হুমকি অশনিসঙ্কেত

এটি নির্বাচনের বছর। দেশবিরোধী শক্তি, ধর্ম ও হত্যার রাজনীতিতে দীক্ষিত দল জামায়াত-বিএনপি নেতানেত্রী ও তাদের সমর্থকরা নির্বাচনকে (যা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি) কেন্দ্র করে হত্যা, জঙ্গী উত্থান ও ধর্মের ভুল ব্যাখ্যাকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। বিগত সময়ে তারা মুক্তমনা বুদ্ধিজীবী, উদার বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের, এমনকি সড়কে চালক-যাত্রীদের নির্মম হত্যাকা- ঘটিয়েছেÑ যা অন্য কোন দেশে সংঘটিত হলে দল দুটি রাজনীতিতে নিষিদ্ধ হতো। অথচ বছরের পর বছর এ দল দুটি গণতন্ত্রকে বার বার ধ্বংস করেও গণতন্ত্র উদ্ধারের মিথ্যা বুলি, সংলাপের নামে বিশ্বে দুর্লভ এক আবদার করে চলেছে। দেশবিরোধী হয়ে যাদের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, তারা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবি করে জনমানুষকে বিভ্রান্ত করে চলেছে। এদের সাহস যোগাচ্ছে দুটি মিডিয়া ও একটি তথাকথিত সুশীল সমাজ- এ সবার জানা। এই দুটি মিডিয়াকে আমার প্রশ্ন-আপনারা জেনেশুনে বিষ পান করছেন কিসের স্বার্থে? খালেদা-তারেক রহমানকে তাদের সবরকম অন্যায়, হত্যা, জঙ্গীতোষণ, চরম দুর্নীতি, ধর্মকে ব্যবহার করে অপরাজনীতি, ধর্মীয় দলগুলোর দ্বারা জঙ্গী সৃষ্টি ও ব্যবহার খুব ভালভাবে জেনে, বুঝে দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শপন্থী দল, নেতা-নেত্রী-সমর্থকদের সমস্যায় ফেলতে চান কোন স্বার্থে? দেখতেই পাচ্ছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, মালয়েশিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির কারণে জেল-জরিমানায় দ-িত হয়েছে এবং হতে চলেছে। তবু এরা দু’জন আপনাদের কাছ থেকে এত প্রশ্রয়, সমর্থন পায় কেন? ওদের সীমাহীন দুর্নীতি সীমাহীন সম্পদের মালিক করেছে ওদের, কিন্তু পর্বত প্রমাণ লজ্জাও কি এ সঙ্গে তাদের পাওয়া হয়নি? এদের অন্যায়কে বানানো ‘ন্যায়’-এর ক্যামোফ্লেজ দিয়ে জনগণের কাছে উপস্থাপন করে আপনারাও কি ওদের সমান কিংবা ওদের চাইতে বেশি অন্যায়কারী প্রতিপন্ন হচ্ছেন না? সে জন্য আপনাদেরও বিচার হওয়া উচিত নয় কি? মিথ্যা অন্যায়কে সুসজ্জিত মোড়কে সাজিয়ে সত্য ও ন্যায় হিসেবে উপস্থাপন করা কি বিচার ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়? অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভিত্তিহীন সরকার বিরোধিতাকে বিচারের আওতায় আনা হলে বাকস্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা গেল গেল রব দেশে-বিদেশে ওঠানো হবে এবং পরিণামে সরকার বিপদে পড়বে ও ঐ মিডিয়া আরও জোরেসোরে সরকারবিরোধী মানহানিকর নানা সুসজ্জিত খবর প্রচারও প্রকাশ করতে থাকবে সে জন্য এ অপরাধমূলক সাহায্য। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সব সরকারী-বেসরকারী অফিসে-কর্মকেন্দ্রে খালেদা-তারেকপ্রেমী, জামায়াত-বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব সুযোগ ও ফাঁককে ব্যবহার করতে মিডিয়াকে সাহায্য করছে। মিডিয়ার এই কর্তা ব্যক্তিরা শোনা যায়, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। অবশ্য জিয়াউর রহমানও ছদ্মবেশী ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ছিল এবং তার সব পদক্ষেপই ছিল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী এবং বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের সহায়ক যেসব পদক্ষেপ তাদের ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রাণে, ধনে, মানে পুনর্বাসন করে গেছে জিয়াউর রহমান। তাহলে প্রমাণ হয়, এই মিডিয়াও অন্তরে দেশ ও জাতি, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধজাত বাঙালীর উন্নয়নবিরোধী! একটা কথা বুঝতে পারি না, জিয়া যেমন ’৭৬-এ বঙ্গবন্ধুর দ্বারা গ্রেফতারকৃত যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব দিয়ে, নাগরিকত্ব দিয়ে, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার ফেরত দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ইসলামীকরণ করছিল, তখনও কেন বড় বড় মুক্তিযোদ্ধারা, রাজনৈতিক নেতারা জিয়াকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ গণ্য করে তার সঙ্গে যোগ দিচ্ছিল? এখনও এই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। মিডিয়া দুটি নানা কৌশলে খবরকে উপস্থাপনে জানান দিচ্ছে, ‘আমরা বিএনপি-জামায়াত পুনর্বাসনে কাজ করছি, খালেদা-তারেক-জামায়াত শিবিরকে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও দল হিসেবে গ্রহণ করতে কাজ করছি। বোকা মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা, বুঝতে পারেনি, চিনতেও পারেনি আমাদের, তা না হলে তোমরা সবাই আমাদের মিডিয়ার খবরই পড় কেন?’ সত্যিই, এরা এমনই ভাবছে বৈকি। এভাবে এ মিডিয়া দুটো দেশী-বিদেশীদের মগজ ধোলাইয়ের কাজটি করছে, সবাই বিভ্রান্ত হচ্ছে, আর ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে মিডিয়া দুটো। অন্য মিডিয়াগুলো সচেষ্ট আছে যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তবে সেগুলোর ছাপাও, কাগজের মান উন্নত করতে হবে, তাহলে পাঠকদের মধ্যে আরও জনপ্রিয় হবে যা এ মুহূর্তে খুব দরকার। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। দেখা যাচ্ছে, এদিকে আবারও মুক্তমনা, উদার, বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি, এলাকার জনপ্রিয় নেতা, মুক্তিযোদ্ধা সম্প্রতি নিহত হয়েছে যাদের মৃত্যুর সঙ্গে জঙ্গীদের হাতে ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে প্রগতিশীলদের খুন হবার পদ্ধতির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ’৭১-এ একমাত্র শহীদ মহিলা সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের একমাত্র পুত্র সুমন জাহিদের আগে থেকে হুমকি পাওয়া এবং নিহত হওয়া জঙ্গীদের টার্গেটে হত্যা বলে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে। এখনও এ হত্যার কারণ উদঘাটিত হয়নি। এদিকে মুন্সিগঞ্জে প্রকাশক নিহত হলেন, তিনিও উদার মুক্তচিন্তার ধারক ছিলেন এবং ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠীর কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকি পেয়েছিলেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন মাস্টারকে জবাই করে হত্যা করা হলো, যিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। এর মধ্যে মৃত্যু হুমকি পেয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক তপন চক্রবর্তীসহ ইউজিসি চেয়ারম্যানসহ আরও কয়েকজন। এদের সবার মধ্যে একটি সাদৃশ্য তো আছে- ওরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা চেতনা লালন করেন। এই হিসাবটি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় কারা এই ধরনের, বিশ্বাসের মানুষের, ব্যক্তির হত্যাকারী হতে পারে। এরা দেখা যাচ্ছে টার্গেট করেছে- ১. মুক্তিযোদ্ধা, যিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। ২. যেসব বিচারক, আইনজীবী ’৭১-এর’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং বিএনপি নেত্রী-নেতা খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের দুর্নীতি, হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে জোরালো দুর্নীতি বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। ৩. বৈজ্ঞানিক মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী ও এ ধারার লেখালেখিতে নিয়োজিত। অর্থাৎ এরাই তারা যারা মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী লেখক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে প্রথম তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেছিল। এরপর এই মৌলবাদী জঙ্গী গোষ্ঠীর টার্গেটেড কিলিং শুরু হয় এবং একে একে তাদের হত্যা শিকার হতে থাকে, ক. মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখক তরুণ খ. গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ দ-ের দাবিকারী তরুণ গ. হিন্দু ও বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পুরোহিত ও ধর্মযাজক ঘ. শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী ও শিয়া ধর্মীয় উৎসব ঙ. বাঙালী সংস্কৃতির প্রধান উৎসব-ছায়ানটের পহেলা বৈশাখে-এর উৎসব অনুষ্ঠান, গ্রামীণ যাত্রা-পালা, মেলা, উদীচীর অনুষ্ঠান। চ. সিনেমা হল, লোকসঙ্গীত শিল্পী, যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী ছ. বিদেশী উন্নয়ন সহযোগী-প্রধানত বাংলাদেশের যোগাযোগ, কৃষি ও গার্মেন্টস খাতে কর্মরত জাপানি ও ইতালীয় বিদেশী বিশেষজ্ঞগণ জ. মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সমর্থক ঝ. আওয়ামী লীগের সমর্থক গণ্য করা সংখ্যালঘু হিন্দু নারী, পুরুষ, শিশু, যুবক ঞ. পার্বত্য শান্তি চুক্তির সমর্থক ট. বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা, কর্মী সমর্থক তাহলে দেখা দরকার এ ঘটনাগুলো সংঘটিত করা কুশীলব জঙ্গীদের ব্যবহারকারী পরিকল্পনাকারী, এদের অর্থ, অস্ত্র, প্রশিক্ষণে সাহায্য সহযোগিতা করেছে কারা? অবশ্যই তারা যারা, ১. যুদ্ধাপরাধী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ২. যুদ্ধাপরাধীদের মিত্র, যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়নি ৩. যারা জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও জঙ্গী তালেবান-আল-কায়েদার ধর্মের নামে হত্যার অপরাজনীতিতে বিশ্বাসী ৪. যারা বাঙালী সংস্কৃতির বিরোধী ৫. যারা বাংলাদেশের উন্নয়নের বিরোধী ৬. যারা ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান ও রাষ্ট্রনীতির চরম বিরোধী ৭. যারা হিন্দু বিরোধী ৮. যারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ৯. যারা বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিচালক স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার, নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগের বিরোধী ১০. যারা ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে বিশ্বাসী এবং হত্যার দ্বারা দমন পীড়নে বিশ্বাসী ১১. যারা গণতন্ত্র, নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, বরং ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসীদের থাকতে হবে ঐক্যবদ্ধ ও খুব সতর্ক। নিজের নিরাপত্তা ও সংখ্যালঘু, দুর্বল সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্যও তাদের সক্রিয় থাকতে হবে। দলগতভাবে দেখতে হবে অনুপ্রবেশ করা বিরোধী পক্ষের সমর্থকরা যেন দলীয় নেতৃত্ব নিতে না পারে এবং মারামারি, অযথা গ-গোল বাধিয়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে না পারে। বর্তমানে ছাত্রলীগ নামধারী গ-গোল করতে থাকা যুবকদের সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে দেখে মনে হয় এরা সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার লক্ষ্যেই কাজ করছে যাদের বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কোটা সংস্কার নিয়ে এখন যখন ছাত্র-ছাত্রীদের আর কিছু করার নেই, কমিটি কাজ করছে, তখনও তারা পড়াশোনায় ফিরে না যাবার কারণটাও তারেকের নির্দেশে আন্দোলন না থামানোর পক্ষে কাজ করাকে ইঙ্গিত করে। তারা তাদের পক্ষ থেকে একটি কোটা তালিকার প্রস্তাব বড়জোর সরকারকে দিতে পারত এবং এখনও পারে। এর জন্য ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ করে নিজেদের ক্ষতি করার দরকার ছিল না। তারেক তো চায় না যে বাঙালী ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেদের ও স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন ঘটাক এটা বুঝতে হবে। তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের বলব, ভুল অপরাজনীতিকারী, দুর্নীতিবাজ, খুনের পরিকল্পনাকারী, জঙ্গী জন্মদানকারী, ধর্মের ভ্রান্ত ব্যবহারকারীদের নেতা, নেত্রী মানার ফলে এরা নিজেরা সমাজে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক পৃথিবীতে পিছিয়ে পড়ে। একদিন নৈতিকভাবেও মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার ফলে এদের পরাজয় মেনে নিতে হবে। সুতরাং, তাদের অনুসরণকারীদের মনে রাখতে হবে ক্ষতি নিজেদেরই হবে, অনুসরণকারীদের হবে না। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×