ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপির তৃণমূল নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৪ আগস্ট ২০১৮

 বিএনপির তৃণমূল নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে

শরীফুল ইসলাম ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা একেক সময় একেক রকম কথা বললেও তৃণমূল নেতারা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তাদের দাবিÑযে কোন পরিস্থিতিতে বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হবে; তা না হলে দলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তৃণমূল নেতারা আগে থেকেই নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। সর্বশেষ বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময়কালে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেন। সূত্র মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে ছিলেন। এ জন্য তারা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকেও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তৃণমূল নেতাকর্মীদের হতাশার মুখে ঠেলে দিয়ে এ নির্বাচন বর্জন করেন। এ কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীরা কিছুদিন দলীয় কর্মকা- থেকে দূরে ছিলেন। অনেকে দলও ত্যাগ করেন। আবার কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে দেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পরও কেন্দ্র থেকে কোন দিক নির্দেশনা না পেয়ে বিএনপির র্তণমূল নেতাকর্মীরা যখন বিভিন্নভাবে হতাশা ব্যক্ত করতে থাকেন তখন শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের টনক নড়ে। তাই বিএনপি চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে তার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রতি জেলা থেকে ৫ জন করে নেতাকে ডেকে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা। এ সময় তৃণমূল নেতারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে মত দেন। তবে নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য জোরালো আন্দোলনের পক্ষেও মত দেন তারা। এ আন্দোলনে ২০১৩ সালের আন্দোলনের মতো রাজধানীতে অবস্থান নেয়া নেতারা যেন ঘরে বসে না থাকেন সে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন তারা। শুক্রবার রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির নেতারা। আজ শনিবার সিলেট প্রস্তাবিত কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর বিভাগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা হচ্ছে। শুক্রবারের মতবিনিময়কালে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা তৃণমূল নেতাদের একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দলীয় কর্মকৌশল, খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন ও দলের সাংগঠনিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। এ সময় তৃণমূল নেতাদের কাছ থেকে দলের মধ্যে কোন্দল আছে কিনা এবং আগামীতে কি ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচী চায় এসব বিষয়ে মতামত নেয়া হয়। তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. মইন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময়কালে বিএনপি মহাসচিব তৃণমূল নেতাদের জানান, এখন থেকে তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের নিয়মিত যোগাযোগ হবে। তবে কেন্দ্র থেকে যে নির্দেশনা দেয়া হয় তা সফল করতে সবাইকে সক্রিয় হতে হবে। জেলা-উপজেলার নেতারা সমন্বয় করে দলের প্রতিটি ইউনিটকে আরও সক্রিয় করবে। দলের দুর্দিনে যারা সক্রিয় থাকবে সুদিনে তাদের মূল্যায়ন করা হবে। সিলেট কৌশল অবলম্বনের দাবি ॥ জানা যায়, স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিএনপির কোন কোন তৃণমূল নেতা বলেছেন: যত কঠিন পরিস্থিতিই মোকাবেলা করতে হোক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতেই হবে। তবে নির্বাচনে সিলেট কৌশল অবলম্বন করলে ভাল ফল পাওয়া যাবে। বিএনপির সিলেট কৌশলটা কি জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যে কৌশলে বিএনপি মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছে সেটাই সিলেট কৌশল। এ নির্বাচনে জামায়াত প্রার্থী দেয়ায় সরকারী দল মনে করেছিল সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির প্রার্থী পরাজিত হবে; তাই তারা অন্যান্য সিটির মতো সিলেটে বিএনপি নেতাকর্মীদের তেমন পাত্তা দেয়নি। আর এ ফাঁকে বিএনপি নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রকাশ্য প্রচারের চেয়ে গোপন প্রচারের প্রতি বেশি জোর দেয়। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে ভোটের দিন কেন্দ্র ও আশপাশে সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ যাতে বিএনপির ভোটারদের বিনা বাধায় ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেয় তেমন সুযোগ সৃষ্টি করে নেয়। আর এ ধরনের কৌশল নিয়ে ভোটের ফলে সুবিধা আদায় করে নেয় বিএনপি। তাই তৃণমূল নেতারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সিলেট কৌশল নেয়ার কথা বলেছেন। উল্লেখ্য, এক সময় বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলতেন নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি আদায় হলে তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবেন। আবার কখনও বলেন, খালেদা নির্বাচন করতে না পারলে তারা নির্বাচনে যাবেন না। ইদানীং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে দলের পক্ষ থেকে যে চারটি শর্ত দিয়ে বলা হয়েছে তা না হলে তারা নির্বাচনে যাবেন না। এ ৪টি শর্তের মধ্যে এক নম্বর শর্ত হচ্ছে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়া। দুই নম্বর শর্ত হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ করা। তিন নম্বর শর্ত নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা এবং চতুর্থ শর্ত হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির দেয়া শর্ত আমলে না নিয়ে বলা হচ্ছে সংবিধানে উল্লেখিত সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। সূত্র মতে, বিএনপিও জানে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে চরম বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই তাদের নির্বাচন করতে হবে। তাই তৃণমূল নেতাকর্মীকে সক্রিয় করে কি কৌশল নেয়া যায় তা নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা চলছে। এ কারণেই কৌশল চূড়ান্ত করার আগে তৃণমূল নেতাকর্মীর মতামত নেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ওয়ান-ইলেভেনের আগে বিএনপি হাইকমান্ড নিয়মিত তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। এ কর্মসূচী সমন্বয় করতেন তারেক রহমান। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর তারেক রহমান গ্রেফতার হয়ে বছরখানেক কারাগারে থেকে পরে লন্ডন চলে যান। এর পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজয় ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর এলোমেলো হয়ে যায় বিএনপির রাজনীতি। ইতোমধ্যেই দলের সিনিয়র কয়েক নেতা মারা গেছেন এবং অনেক অভিজ্ঞ নেতা রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। কেউ কেউ দল ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৫ বছরের সাজা মাথায় নিয়ে ৬ মাস ধরে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। এ অবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বহুদিন পর হলেও বিএনপি সারাদেশের তৃণমূল নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে মতবিনিময় করে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর মতামত উপেক্ষা করে বিএনপির সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা তৃণমূল নেতাদের মতামত নেয়। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এতদিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও এখন হয়ত নির্বাচনে অংশ নেয়ার দিকেই এগিয়ে যাবে বিএনপি। সে ক্ষেত্রে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সক্রিয় করে নির্বাচনমুখী হলে দল ক্ষমতায় না গেলেও এখনকার চেয়ে শক্ত অবস্থানে যাওয়া সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে আবারও ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ হবে। তাই বিএনপি হাইকমান্ডের উচিত হবে তৃণমূল নেতাদের দাবি মেনে নিয়ে যে সরকারের অধীনেই হোক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই দলের স্থায়ী কমিটির নেতারা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে। তাই তৃণমূল নেতারা নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা মূল্যায়ন করা হবে। সেই সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের রাজনীতিতে আরও সক্রিয় করে দলকে কিভাবে এগিয়ে নেয়া যায় সে চেষ্টা করা হবে। এ ছাড়া তৃণমূল নেতাদের নিয়ে আরও মতবিনিময় সভা হবে।
×