ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থীদের হাতেই ছিল রাজধানীর যান চলাচলের নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ৩ আগস্ট ২০১৮

শিক্ষার্থীদের হাতেই ছিল রাজধানীর যান চলাচলের নিয়ন্ত্রণ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বৃহস্পতিবারও রাজধানীতে যানবাহন চলাচলের নিয়ন্ত্রণ ছিল বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের হাতে। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছে। শিক্ষার্থীরা চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে। যাদের লাইসেন্স নেই, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে সহায়তা করেছে। বিক্ষোভকারীরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ায় শিক্ষার্থীদের যার যার পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়েছে। যাতে অন্য কেউ ভেতরে প্রবেশ করে কোন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে, বিক্ষোভকারীদের ঘাড়ে দোষ চাপাতে না পারে। পরিচয়পত্র ব্যতীত কাউকে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করতে দেয়নি বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা। টানা পঞ্চম দিনের বিক্ষোভে অচল হয়ে পড়েছিল রাজধানী ঢাকা। রাজধানীতে গণপরিবহন ছিল না বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানির বাস, প্রাইভেটকার, লেগুনা, সিএনজি আর রিক্সা চলাচল করেছে। টানা বিক্ষোভের কারণে ঢাকার গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ থেকে দূরপাল্লার অধিকাংশ বাস ছেড়ে যেতে পারেনি। তবে বড় ধরনের কোন ভাংচুরের ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের সকল জায়গা থেকে। যেমন ছিল বৃহস্পতিবারের ঢাকা ॥ ঘটনার পর থেকেই শিক্ষার্থীরা ঘাতক বাসের চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছে। গত চার দিনের মতো বৃহস্পতিবারও শিক্ষার্থীরা ঢাকার প্রায় প্রধান সড়কে অবস্থান নিয়েছিল। তারা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে সহপাঠীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছিল। সকাল থেকে যে যে এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী তারা সেসব এলাকায় বিক্ষোভ দেখিয়েছে। বেলা তিনটার দিকে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর সরকারী কলেজের শত শত শিক্ষার্থী গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে মোহাম্মদপুর আসাদ গেট, সোনার বাংলা পেট্রোল পাম্প ও জাতীয় সংসদের সামনে অবস্থান নিয়েছে। তারা রাস্তার দুইটি লেন বন্ধ করে রেখেছে। শিক্ষার্থীরা নানা গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। এদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সেøাগান দিচ্ছে। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আরেক দল ছেলে শিক্ষার্থী রাস্তার মাঝপথে দাঁড়িয়ে যানবাহনগুলোতে রাস্তার বাম দিকে এক সারিতে যাওয়ার নির্দেশ করছে। এদের অধিকাংশই কলেজের শিক্ষার্থী। আরেক দল শিক্ষার্থী সোনার বাংলা পেট্রোল পাম্পের সামনে, আসাদ গেটে চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করছে। এরা অপেক্ষাকৃত সিনিয়র শিক্ষার্থী। অনেকেই বিভিন্ন প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, তারা সসম্মানে চলে যাচ্ছেন। যাদের নেই তাদের গাড়িসহ হস্তান্তর করা হচ্ছে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্টদের কাছে। এতে করে রাস্তায় যানবাহনের দীর্ঘ লাইন পড়ে গেছে। তবে কারও মুখে এর প্রতিবাদ করতে শোনা যায়নি। তাদের ভাষ্য অনেক দিন পরে হলেও ট্রাফিক পুলিশ যা পারেনি, শিক্ষার্থীরা তা করে দেখাল। তবে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে লাইসেন্স চেক করতে গিয়ে অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সার্জেন্টের গাড়ি পোড়ানোর ঘটনা ঘটেছে ॥ সায়েন্স ল্যাবরেটরি সিগন্যালে দুপুরে যথারীতি বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা বায়েজিদ নামের এক সার্জেন্টকে থামায়। তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে বলে। পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের এ নিয়ে বাগ্বিত-া হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সার্জেন্টের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে তার মোটরসাইকেলটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই সঙ্গে আরও দুইটি গাড়ি ভাংচুরের কবলে পড়ে। পরে বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন সার্জেন্টকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। বিক্ষোভকারীদের চেকিংয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়নি মন্ত্রী ও এমপিদের গাড়ি ॥ দেখা গেছে, গাড়ি দেখামাত্রই সেখানে ভিড় করছে শিক্ষার্থীরা। সমাজের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে শিক্ষার্থীরা। বাদ যায়নি সাংবাদিক, পুলিশ, বিচারক, আইনজীবী থেকে শুরু করে। তেজগাঁও এলাকার পুলিশের দুইটি গাড়ি আটক করে রাখে শিক্ষার্থীরা। মোটরসাইকেল আরোহীদের হেলমেট না থাকলে তাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। অনেককে প্রতীকী শাস্তি হিসেবে জরিমানার পাশাপাশি বেশ কিছু সময় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ধানম-িতে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পানিসম্পদ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর গাড়িও আটকে দিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। পরে মন্ত্রী নিজেই গাড়ি থেকে নেমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে অন্য গাড়িতে করে গন্তব্যে যান। এজন্য মন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের ড্রাইভারের কাগজপত্র না থাকায় মন্ত্রীকে গাড়ি রেখে হেঁটে সংসদে প্রবেশ করতে হয়েছে। খাবার নিয়ে অভিভাবকরাও রাজপথে ॥ সুষ্ঠু বিচার ও নিরাপদ সড়কের দাবিসহ ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে রাস্তায় নেমেছেন অভিভাবকরাও। বৃহস্পতিবার দুপুরে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার, পানি, স্যালাইন এবং বিস্কুট বিতরণ করতে দেখা গেছে অনেক অভিভাবককে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ কাজ করছে। লিখিত দেয়ার পরে রাজপথ ছাড়ার দাবি শিক্ষার্থীদের ॥ বিক্ষোভকারীরা নিরাপদ সড়ক দাবি করেছে। যেখানে সবাই আইন মেনে চলবে। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকার লিখিতভাবে পদক্ষেপ নিলে তারা রাজপথ ছেড়ে দেবে। তাদের দাবি, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া কোন চালক সড়কে গাড়ি বের করতে পারবে না। ফিটনেস না থাকলে সড়কে গাড়ি চলবে না। শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ ॥ বৃহস্পতিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শিক্ষার্থীদের কারও উস্কানিতে কান দেয়া উচিত হবে না। কোমলমতি শিশুরা যেন কোন অপপ্রচারে কান না দেয়, বিভ্রান্ত না হয়। শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ তৎপর রয়েছে। সড়কে যানবাহন কয়েকবার করে চেকিং করা হচ্ছে। সড়ক ব্যবস্থাপনায় আগে অনিয়ম ছিল। আমরা সেসব অনিয়ম অনেক দূর করেছি। উল্টোপথে চলা অনেক প্রভাবশালীর গাড়িও ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। ফুটপাথে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের আন্তরিকতা থাকা সত্ত্বেও নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা বিলম্বিত হচ্ছে। গাড়ি চেকিংয়ের কারণে দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে। দুর্ভোগ হচ্ছে হজযাত্রী ও রোগীদের। মামলাটি ডিবি তদন্ত করছে ॥ দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে হত্যার ঘটনায় নিহত দিয়ার পিতা জাহাঙ্গীর আলম ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর পরই সেই আলোচিত জাবালে নূর নামের ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৯২৯৭ নম্বরের বাসটি জব্দ করে পুলিশ। বুধবার জাবালে নূর নামের সেই ঘাতক বাসটির মালিক মোঃ শাহাদাৎ হোসেনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত ঘাতক বাসটির চালক মাসুম বিল্লাহকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ইতোমধ্যেই বাস দুইটির রুট পারমিট বাতিল করেছে বিআরটিএ। বৃহস্পতিবার মামলাটি ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে তদন্তের জন্য ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। মিরপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ॥ মিরপুর পুলিশ স্টাফ কলেজের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার বিকেল পৌনে ৫টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। একদল লোক শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে। তবে ওই লোকগুলো কারা তা জানার চেষ্টা করছে গোয়েন্দারা। আন্দোলনকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে হামলাটি চালিয়েছে কিনা তা জানার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গান গেয়ে মন জয় করলেন পুলিশ কর্মকর্তা ॥ ‘আসো, আমরা সবাই মিলে গানটা গাই।’ এ কথা বলেই দরাজ গলায়- ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান, মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, এ গান ধরলেন পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির শোক ॥ সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে।
×