ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে এক রাতে শতাধিক বাড়ি যমুনায় বিলীন

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১ আগস্ট ২০১৮

টাঙ্গাইলে এক রাতে শতাধিক বাড়ি যমুনায় বিলীন

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ৩১ জুলাই ॥ সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী গ্রামের শতাধিক বাড়ি এক রাতে যমুনার পেটে চলে গেছে। স্থানীয়রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাক্ষুসী যমুনার ভাঙ্গন তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। ভাঙ্গনের ফলে ওই এলাকার শতাধিক তাঁত ফ্যাক্টরি হুমকিতে রয়েছে। এলাকাবাসী স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে। সরেজমিনে স্থানীয়রা জানায়, প্রতিবছর বর্ষায় যমুনার ভাঙ্গন তাদের সবকিছু কেড়ে নেয়। প্রতি বর্ষার দেড়-দুই মাস তারা ভাঙ্গনের আতঙ্কে দিন কাটান। পানি বাড়তে থাকার চেয়ে কমার সময় ভাঙ্গনের তীব্রতা বেশি থাকে। এ বছর প্রথম দফায় পানি বাড়লেও গত এক সপ্তাহে প্রায় আড়াই ফুট কমেছে। একই সঙ্গে যমুনার ভাঙ্গনও বেড়েছে। এ কারণে অনেকেই আগে থেকে যমুনা পাড়ের বাড়িঘর- তাঁত ফ্যাক্টরি অন্যত্র সরিয়ে রাখেন। এবারও অনেকেই সরিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু যাদের অন্যত্র জায়গা-জমি নেই তারা সরাতে পারেননি। ফলে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নিম্নবিত্তরা ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছেন। চরপৌলী গ্রামে বসবাসকারীদের ৭০ শতাংশ ব্যক্তি ২-৫ বার পর্যন্ত যমুনার ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বাড়িঘর-ফ্যাক্টরি সরিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করছেন-ব্যবসা চালাচ্ছেন। ভাঙ্গন কবলিত এলাকাবাসী জানায়, রাতে হঠাৎ করে যমুনা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রমত্ত্বা যমুনার শো শো শব্দের তীব্র স্রোত মাত্র ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে নদীপাড়ের ঘরবাড়ি ও তাঁত ফ্যাক্টরি ভেঙ্গে যমুনার পেটে চলে যায়। অনেকে আগেই ঘর-তাঁত ফ্যাক্টরি সরিয়ে রেখেছিলেন, তাদের বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি এবং ঐতিহ্যবাহী চরপৌলী হাটের শেষাংশ যমুনা নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজারটির চিহ্ন পাওয়া দুষ্কর। বাজারের রাস্তায় ৩-৪টি দোকান হাটের অতীত ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। কাকুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খাদেমুল ইসলাম চুন্নুর বাড়ি এবারও ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে। চরপৌলী গ্রামের আলহাজ, শেফালী বেগম, লালচাঁন মিয়া, জামাল মিয়া, আব্দুল আজিজ, সাত্তার ফকির, জড়িনা বেগম, সুফিয়া বেওয়া, শান্ত মিয়া, হালিম আকন্দ, জুলহাস উদ্দিন, জবেদা বেওয়া, শহিদুল ইসলাম, ইউসুব আলী, লুৎফর রহমান, শাহাদত হোসেন, ইশারত আলী, আব্দুল খালেক, তাঁরা বানু, শরিফুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যক্তির বসতভিটা, তাঁত ফ্যাক্টরির জায়গা ও ফসলি জমি রাক্ষুসী যমুনা গিলে খেয়েছে। স্থানীয় ষাটোর্ধ বয়সী হাসেম আলী জানান, রাক্ষুসী যমুনা তিন দফায় তার বাড়ি গিলেছে, প্রতিবারই তিনি পূর্ব দিকে সরে এসে বাড়ি করেছেন। এবারও ভাঙ্গনের আশঙ্কায় রয়েছেন। এবার বাড়িটি ভাঙ্গলে আর কোথাও বাড়ি করার সামর্থ্য কারও নেই। গত তিন বছরে যমুনার ভাঙ্গনে চরপৌলী গ্রামের শাহজামালের ২৬ তাঁতের ফ্যাক্টরি, রওশন আলীর ৩৬, শামছুল আলমের ২০, আব্দুস সবুরের ১৬, নুরুল ইসলামের ১০, আব্দুর রশিদের ১২, আইয়ুব আলীর ১৬, শাহালমের ২০, সামছুলের ১০, মোকাদ্দেসের ৮, নুরুল আলমের ১৫, কদম আলীর ১০, আব্দুল কাদেরের ১২ ও সোনা মিয়ার ১৮ তাঁতের ফ্যাক্টরিসহ স্থানীয় প্রায় ৩শ’ ছোট-বড় তাঁত ফ্যাক্টরি যমুনা গর্ভে বিলীন হয়েছে। তাদের কেউ কেউ যমুনার পূর্বদিকে সরে বাড়িঘর ও তাঁত ফ্যাক্টরি নির্মাণ করেছেন। যাদের সামর্থ্য নেই তারা ছিন্নমূল হিসেবে শহরে গিয়ে যে কাজ পাচ্ছে তাই করে জীবিকা নির্বাহ করছে। কেউ কেউ ভিক্ষাবৃত্তিকে বেঁচে থাকার সম্বল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এছাড়া অর্ধশতাধিক দোকানপাটসহ চরপৌলীর ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজার, একটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুইটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬টি মসজিদসহ বহু স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে। এর মধ্যে দুই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মসজিদ পূর্ব দিকে সরিয়ে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। স্থানীয় সমাজসেবক শাখাওয়াত ম-ল জানান, রাতে হঠাৎ করে যমুনা ফুঁসে ওঠে শতাধিক ঘরবাড়ি গ্রাস করেছে। চরাঞ্চলের মানুষ বাড়ি ভাঙ্গা মানুষ। তাদের ভাল-মন্দ দেখার কেউ নেই। যাদের বাড়িঘর যমুনা গিলে খেয়েছে তাদের কারও ঘরে খাবার নেই, কারও পরনে কাপড় নেই। কাকুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানান, যমুনার ভাঙ্গন তাদের নিত্য সঙ্গী। প্রতি বছরই যমুনার ভাঙ্গনে সাধারণ মানুষ মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। তার বাড়িও গত বছরের বর্ষায় নদীগর্ভে বিলীন হওয়ায় তিনি পূর্ব দিকে সরে এসে নতুন করে বাড়ি নির্মাণ করেছেন। প্রতি বছর প্রচুর আবাদি জমি, বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়। এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে দক্ষিণ দিকে আট কিলোমিটার এলাকা জুড়ে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হোক। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে যমুনার করাল গ্রাস থেকে কোনভাবেই পরিত্রাণের উপায় নেই বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাজাহান সিরাজ জানান, যমুনা নদীর ভাঙ্গন ঠেকাতে টাঙ্গাইলের পশ্চিমাঞ্চলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণের প্রকল্প মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলেই কাজ শুরু করা হবে।
×