ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কোন নজরদারিই ছিল না পেট্রোবাংলার, এখন দায় এড়ানোর চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৮ জুলাই ২০১৮

  কোন নজরদারিই ছিল না পেট্রোবাংলার, এখন দায় এড়ানোর চেষ্টা

রশিদ মামুন ॥ বড়পুকুরিয়া কয়লা চুরির ঘটনায় দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটির নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করার কথা থাকলেও কোন দিনই তা করেনি। কয়লা গায়েবের ঘটনার পর এই ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে। উল্টো কয়লা দুর্নীতির তদন্ত এককভাবে নিজেদের লোক দিয়ে সেরে ফেলার চেষ্টাও করেছে সংস্থাটি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাই কী করে এককভাবে তদন্ত করেন এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা পেট্রোবাংলার নজরদারির গাফিলতির কথা বলেছেন। একই সঙ্গে তারা বলছেন বড়পুকুরিয়া খনি কোম্পানির বোর্ডের কথা। কোম্পানি যে বোর্ড পরিচালনা করে তারাই বা কি করেছিল এমন প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও বলেছেন, বড়পুকুরিয়ার ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার গাফিলতি ছিল। কর্পোরেশন হিসেবে পেট্রোবাংলা কয়লা বিক্রি থেকে একটি লভ্যাংশ পেয়ে থাকে। নিয়মিত লভ্যাংশ নেয়া হলেও কেন নজরদারি করেনি তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানই বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি কর্তৃপক্ষের বোর্ডেরও চেয়ারম্যান। দুটি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফায়জুল্লাহ এনডিসি-এর বড়পুকুরিয়া খনি বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকার কথা। কিন্তু এক লাখ ৪৪ হাজার টন কয়লা উধাও হয়ে যাওয়া সম্পর্কে তিনি আগেভাগে সরকারকে কিছুই জানাননি। বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড থেকে (পিডিবি) বিষয়টি সরকারের উর্ধতন মহলে জানানো হয়। সরকার পেট্রোবাংলার কাছে ব্যাখ্যা চাইলে পেট্রোবাংলা তৎপর হয়ে ওঠে। পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান ওই দিনই বড়পুকুরিয়া খনি বিষয়ে তদন্ত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব উদ্দিন আহমেদকে তার দফতরে সংযুক্ত করেন। পরে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু একই বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়ে কেন তিনি খবর রাখলেন না সেই প্রশ্নের উত্তর তার কাছ থেকে মেলেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন যেহেতু বোর্ড কোম্পানি পরিচালনা করে তাই বোর্ড মেম্বার এবং চেয়ারম্যানকেও এই দায় নিতে হবে। জানতে চাইলে বাপেক্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মর্তুজা ফারুক চিশতি বলেন, কোম্পানি তো একটি বোর্ড পরিচালনা করে। বোর্ডের অবশ্যই এখানে দায় আছে। তিনি একই সঙ্গে পেট্রোবাংলার কয়লাখনি পর্যবেক্ষণ নিয়ে দক্ষতার অভাবের কথা তুলে ধরেন। মর্তুজা বলেন, বোর্ডে তো মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিও থাকেন। তিনি তো তার দায়ও এড়াতে পারেন না। বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগের সকল কোম্পানির বোর্ডেই মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে কোম্পানিগুলোর কাজ গতিশীল করতে বোর্ডে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি রাখা হয়। কিন্তু আসল বাস্তবতা বড়পুকুরিয়ার কেলেঙ্কারির পর বেরিয়ে এসেছে। আদৌ বোর্ড মেম্বাররা কোম্পানির কোন খোঁজ রাখেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন দিনাজপুরের কোম্পানির বোর্ড মেম্বাররা থাকেন ঢাকায়। কোম্পানির বোর্ড সভাও হয় ঢাকায়। কোম্পানির বোর্ডে থাকার অর্থ হচ্ছে বোর্ড সভাতে সামান্য কিছু টাকা বাড়তি সম্মানী পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু বাড়তি সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোর্ড সদস্যদের কোম্পানি পরিচালনার চেয়ে তাদের নিজেদের সুবিধা আদায় মুখ্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম আমলাদের দিয়ে কোম্পানি পরিচালনা করার বিরোধিতা করেন। তিনি একাধিকবার বলে আসছেন আমলাদের দিয়ে কোম্পানি পরিচালনা করায় সঙ্কট সৃষ্টি হবে। যারা কোম্পানির নানা অনিয়ম চিহ্নিত করবে তারাই যদি পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন সেক্ষেত্রে অনিয়ম দূর হয়ে স্বচ্ছতা কিভাবে নিশ্চিত হবে এমন প্রশ্নও তিনি বারবার করেছেন। বিদ্যুত এবং জ্বালানি বিভাগ কখনও এসব বিষয়ে কর্ণপাত করে না। পেট্রোবাংলার পরিচালনার ধরন অনুযায়ী সংস্থার পরিচালক (অপারেশন এ্যান্ড মাইন) কামরুজ্জামানের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দেখভাল করার কথা। কয়লার অভাবে বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ হওয়ার দায় এবং এই চুরির বিষয়ে কেন তিনি কেন আগেভাগে পদক্ষেপ নিলেন না বা জানলেন না এমন প্রশ্ন তুলেছে সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে এই দায় পরিচালক (অপারেশন এ্যান্ড মাইন) যেখানে এড়াতে পারেন না। সেখানে তিনিই কি করে তদন্ত কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পান? এমন প্রশ্নও করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কামরুজ্জামান বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল) এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। এর আগে সেখানেরই মহাব্যবস্থাপক (জিএম)-এর দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন। তিনি সারা জীবন গ্যাস উৎপাদন কোম্পানিতে কাজ করেছেন। কয়লাখনিতে কাজ করার কোন অভিজ্ঞতা তার নেই। কয়লা একটি বিশাল ক্ষেত্র এখানে জানবোঝা লোকের হাতেই তা সামলানোর দায়িত্ব দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করা হয়। অভিযোগ রয়েছে শুরুতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয় কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে। সেখানে মন্ত্রণালয় বা বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কোন কর্মকর্তাকেই রাখেনি পেট্রোবাংলা। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সংযুক্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমলাদের দিয়ে পেট্রোবাংলা চালানো তো প্রতিষ্ঠানটির দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সাধারণত এ ধরনের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে এই খাতে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন এমন গবেষক বা বিশেষজ্ঞদের হাতেই পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একজন সাবেক সদস্য মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস এবং ভারতের ওএনজিসি-এর উদাহরণ টেনে বলেন, সেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সব সময় একজন বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যাতে তিনি জেনে বুঝে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু ব্যতিক্রম এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা। তিনি বলেন, এখানে পেট্রেবাংলা না এগোতে পারলে দেশের জ্বালানি খাতে স্থবিরতা ছড়িয়ে পড়বে তা ভাবা হয়নি। তিনি মনে করেন পেট্রোনাস এবং ওএনজিসিকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে পেট্রোবাংলা পরিচালনা করা উচিত। পেট্রোবাংলার বর্তমান চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মোঃ ফায়জুল্লাহকে প্রশাসন ক্যাডার থেকে এনে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এর আগে ইশতিয়াক আহমদকে প্রশাসন ক্যাডার থেকে এনে দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে তিনি পরিবেশ সচিব হিসেবে অবসরে যান। অধ্যাপক হোসেন মনসুরের দায়িত্ব পালনের পর থেকে আমলারা এই পদটি দখল করেছে। এক শ্রেণীর আমলাদের একগুয়েমিতে এখানে বিশেষজ্ঞ কাউকে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগও রয়েছে। জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, এই দায়ের পুরোটা পেট্রোবাংলা এবং বড়পুকুরিয়া খনির কর্মকর্তাদের। দিনের পর দিন কয়লা চুরি হয়ে গেল আর তারা এখন এসে কিছু বলতে পারবেন না তা তো হয় না। তিনি বলেন, দেড় লাখ টন কয়লা নিতে অন্তত ৩০ হাজার ট্রাকের দরকার। ৩০ হাজার ট্রাক তো এর একদিনে দুদিনে ঢুকানো সম্ভব নয়। চুরি হচ্ছে বিষয়টি দীর্ঘ সময়ে কেউ না কেউ জেনেছে। কিন্তু জেনেও ব্যবস্থা নেয়নি। এসব বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেও পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে পাওয়া যায়নি।
×