ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৈতালী হালদার চৈতী

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২৮ জুলাই ২০১৮

  কোটা সংস্কার আন্দোলন ও উদ্দেশ্যমূলক তৎপরতা

(গতকালের পর) ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঢাল করে, শিবির-জামায়াতের চেষ্টা সরকার পতনের’ সম্প্রতি জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে এ আন্দোলনের নেতা রাশেদ খানের আসল চেহারা। তার নারী বিদ্বেষী চেহারাও প্রমাণসহ প্রকাশ হয়েছে এখানে। যেখানে বলা হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের পুঁজি করে অস্থিরতা সৃষ্টি চেষ্টার মধ্য দিয়ে সরকার পতনের রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ দেয়ার চক্রান্ত করছে কোটা সংস্কার দাবির আন্দোলন। কথিত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের শীর্ষ কয়েক নেতার হাত ধরে আন্দোলনের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে জামায়াত-শিবির ও তাদের মদদপুষ্টদের হাতে। শিবিরের বাঁশের কেল্লাসহ প্রতিটি উগ্রবাদী ফেসবুক পেজ থেকে দেয়া হচ্ছে উস্কানি। তথ্য মিলছে আন্দোলনে বিশেষ গোষ্ঠীর ফন্ডিংয়েরও।’ ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাশেদের আদর্শ সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া যায় তার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাসের মাধ্যমে। প্রমাণ মিলেছে রাশেদ খানের এ্যাকাউন্ট থেকে শিবিরের বিভিন্ন পেজে লাইক-কমেন্ট শেয়ার থেকেও। তার নিজের ফেসবুক এ্যাকাউন্টের একটি স্ট্যাটাস উল্লেখ করলে বোঝা যায় শিবিরের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা। তিনি লিখেছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখপাত্রের নামের তালিকা- কেন্দ্রীয় ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসাইন, ছাত্র শিবিরের সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক সালাউদ্দিন আইয়ুবী, স্কুল কার্যক্রমবিষয়ক সম্পাদক মাশরুর হোসাইন, প্রকাশনা সম্পাদক সালাউদ্দিন মাহমুদ, বিতর্ক বিভাগের সভাপতি আল মামুন রাসেল। ফেসবুকের আরেক পাতায় রাশেদ খান একটি বক্তব্য লিখেছেন। শিরোনামের নিচে রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের বিকৃত করা পাঁচটি ছবি। রাশেদ তার ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রীদের নিয়েও অশ্লীল কথা লিখেছেন বিভিন্ন সময়। রমজান মাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। (২ জুলাই ২০১৮, দৈনিক জনকণ্ঠ)। এখানেই শেষ নয়। ২০১৩ সালের দিকে ফেসবুকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রী সংস্থার একটি পোস্ট শেয়ার করেছেন রাশেদ। ২০১৫ সালে মেয়েদের পোশাক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পোস্ট শেয়ার করেছেন। এছাড়া, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির আন্দোলন, নারী দিবস নিয়ে বিভিন্ন সময় পোস্ট দিয়েছেন। একটি পোস্টে রাশেদ লিখেছে, ‘মেয়েরা মধ্যরাতে বাইরে এসে অধিকার আদায়ের চেষ্টা করছে এবং এতে ঠিক কিভাবে অধিকার আদায় সম্ভব? এই পোস্টে নারী বিদ্বেষী চেহারা প্রকাশ করেছে রাশেদ। এই রাশেদ তার সরকারবিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রমাণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। আন্তর্র্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার জঙ্গীদের মতো উগ্রবাদী ও নাশকতায় উস্কানি দিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন। এরই মধ্যে রাশেদের চেহারা নিয়ে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে নিজেদের শতভাগ চেহারাই প্রকাশ করে দিয়েছেন আরেক নেতা নূর ইসলাম। যার ভিডিও বার্তায় সে আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে অন্য কোটা নয় তাদের আসল টার্গেট হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এই নূরের ওপর হামলার দায় আমাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র লীগের ওপর চাপাতে বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে কম চেষ্টা হয়নি। সরকারকে বিব্রত করতে এমনও বলা হয়েছিল, তার ওপর এতটাই নির্যাতন চালানো হয়েছে সে বাঁচবে না, তাকে চিকিৎসা নিতে দেয়া হচ্ছে না, তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, তার অবস্থা উদ্বেগজনক ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এখন ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তিনি জানান দিয়েছেন অন্য কোটা নয় তাদের চাই মুক্তিযোদ্ধা কোটার পরিবর্তন। এই মুহূর্তে নূরের ভিডিও বার্তা মিলছে সরকারবিরোধী ফেসবুক পেজগুলোতে। মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি সম্মান রেখেও কোটা সংস্কারে সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে নূর বলছে, ‘কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানো যাবে না? আদালতের দোহাই নিয়ে আমাদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চলছে। আদালত তো কেয়ারটেকার সরকারের ক্ষেত্রেও আরও কয়েক টার্ম রাখার কথা বলেছিল। সরকার তো তা করেনি। তাহলে এখন কেন আদালতের রায়ের দোহাই দেয়া হচ্ছে? আল কায়েদার নেতাদের মতো দেয়া তার ভিডিও বার্তাতেই সে পরিষ্কার করে দিয়েছে তাদের আসল লক্ষ্য কোটা সংস্কার নয়, অন্য কোটা কমালেও হবে না। আসল লক্ষ্য কেবল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। আরেকটা বিষয়, যারা আন্দোলন করছেন কিংবা তাদের যারা বাতাস দিচ্ছেন সেই কথিত সুশীলরাও বলে যাচ্ছেন, ‘কোটায় যারা চাকরি পান তারা মেধাবী না, কোটার কারণে মেধাবীদের চাকরি হচ্ছে না।’ আমি তো জানি এদের মূল নেতা-নেত্রীদের অনেকেই আছেন যারা বিসিএসের প্রিলিমিনারি এমনকি নন-ক্যাডারের বিভিন্ন চাকরির জন্য তিন, চারবার পরীক্ষা দিয়ে প্রিলিমিনারিও পাস করতে পারেননি। কোটা প্রয়োগ পর্যন্ত যাওয়া তো পরের কথা। এদের অনেকেই আবার ভাবে কোটার কারণে নাকি তাদের মতো শত শত মেধারী প্রিলিমিনারিতেই টিকে না। বোঝেন অবস্থা! কোটা কখনও প্রিলিমিনারিতে কার্যকর হয় না। সকল পরীক্ষা পাস করে আগে উত্তীর্ণ হতে হবে তারপরে কোটা প্রয়োগ এই কথা হয়ত আন্দোলনের নেতা ও তাদের পরার্শকরা জানেন না এ কথা কিন্তু ঠিক না। তারা জানেন কিন্তু তারা আসলে সাধারণ ছেলেমেয়েদের বোকা বানিয়ে শিক্ষাঙ্গনকে অশান্ত করতে চায়। এবার আসি বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিয়ে একটি বিশেষ মহলের তোলা উদ্দেশ্যমূলক ও উদ্বেগজনক অপপ্রচারের বিষয়ে। কয়েকদিন ধরে একটি শ্রেণী বলা শুরু করেছেন, এবার ছাত্রলীগ যেভাবে নির্যাতন করেছে তা নাকি ’৭১ সালেও হয়নি। আইয়ুব খানের আমলে ছাত্রদের ওপর নিযার্তন করা হতো। সে সময় আইয়ুব খানের ছাত্রসংগঠন এনএসএফ ছাত্রদের নিযার্তন করত, কিন্তু বতর্মান ছাত্রলীগের মতো পেটাত না। সেই এনএসএফ যুগের চেয়ে বতর্মান যুগ ভয়াবহ। এভাবে একাত্তরের বর্বরতা ও আইয়ুব খানের অপরাধকে যারা কৌশলে অনুমোদন দেয়ার চেষ্টা করেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে কারো আরা সন্দেহ থাকার কথা না। কথাগুলো কি কি সরকার, কিংবা ছাত্রলীগকে বলা? নিশ্চয়ই না। কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন দু’ভাবে বিভক্ত। সরকারের পদক্ষেপ নেয়া ছাড়াও নেতাদের অসৎ উদ্দেশ্য পরিষ্কার হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেই। নেতারাও নিজেদের মধ্যে রিরোধে লিপ্ত। অথচ কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়া কিছু হলেই বলে দেয়া হচ্ছে ছাত্রলীগ দায়ী। আসলে একটি শ্রেণী সব সময় একাত্তরের গণহত্যা, আইয়ুব খানের শাসনকে হালকাভাবে প্রতিষ্ঠান করতে চায়। কোটা সংস্কারের নামে নাশকতায় জড়িতদের গ্রেফতারের পর তাদের মুক্তির দাবি, নির্যাতনসহ বিভিন্ন দাবি তুলে আয়োজিত এক কর্মসূচীতে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য এসেছে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনাকে নিয়েও। এর প্রতিবাদে ইতোমধ্যেই আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তবে যারা ২০০৪ সাল থেকে শুরু করা শিবিরের আন্দোলন সফল করার জন্য নানাভাবে বাতাস দিচ্ছেন। সরাসরি না বলে কৌশলে ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রশ্ন তোলের কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তার পরিবারের জন্য রাখা কোটা নিয়ে। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ‘মাত্র আড়াই লাখ পরিবারের সদস্যদের জন্য কেন ৩০ শতাংশ কোটা? ইনিয়ে-বিনিয়ে এসব বলছেন তো? একবার ভাবুন তো সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-সন্তানসহ পুরো সংসার ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে কেন গিয়েছিলেন? (সমাপ্ত) লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ
×