ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সাক্ষী এবং তদন্তকারীর নিরাপত্তা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৪ জুলাই ২০১৮

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সাক্ষী এবং তদন্তকারীর নিরাপত্তা

’৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকরও হয়েছে। কিন্তু রায় পরবর্তী পরিস্থিতিটি কোন পর্যায়ে? এর সাক্ষী কিংবা যারা এই বিচার প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁরা কিভাবে দিনাতিপাত করছেন? সম্প্রতি দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যাদের একজন সাক্ষী এবং অপরজন বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের বর্তমান জীবনযাপন জানতে পেরে নিদারুণ পীড়া অনুভব করছি। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল এবং পাঠকের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না। এক. আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল দেশের একজন খ্যাতিমান সুরকার, গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক। বাংলাদেশের জন্মের সময় ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছরের কিশোর বয়সে সরাসরি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তিনি দুঃসাহসিক অবদান রেখেছিলেন দেশের জন্য। দেশ স্বাধীন হলে সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করার পিছনে কাজ করেছেন নিরলসভাবে। তাঁর সৃষ্ট বেশ কিছু কালজয়ী দেশের গান আজকের প্রজন্মকেও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। সব কটা জানালা খুলে দাও না, ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে, সেই রেল লাইনের ধারে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি, মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেব না, একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না প্রভৃতি তাঁর কালজয়ী দেশের গান। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তারা ছোটবেলা থেকে বুলবুলের এই গানগুলো শুনে বড় হয়েছি। বিনিময়ে এতটুকু হলেও দেশকে ভালবাসতে শিখেছি। দেশের গান ছাড়াও অসংখ্য জনপ্রিয় আধুনিক গানের জন্যও তিনি আজীবন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকবেন। তাঁর অবদানের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার থেকে শুরু করে একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। ক’বছর আগে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ১৯৭১-এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দী দেন। একজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচার ত্বরান্বিত করতে তার এ জবানবন্দী বিরাট ভূমিকা পালন করে। ক’দিন আগে এক সকালে টিভি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হচ্ছিল। সেই সকালটির কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তাঁর কথা ছিল- ‘সবকিছু তো ভালই চলছিল। আমি আমার সৃষ্টিতে মগ্ন ছিলাম। সঙ্গীতের মেধাবী আগামী প্রজন্ম তৈরিতে নিয়োজিত ছিলাম। তবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের ১৯৭১-এ নৃশংসতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমি আমার বাকি জীবনটি শেষ করে দিয়েছি। ঐ সাক্ষ্য দেওয়ার পর আমার প্রিয় ছোট ভাইটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্র আজও যেটির কুলকিনারা করতে পারেনি। আমি আজকে পুলিশ প্রহরায় একপ্রকার বন্দী জীবনযাপন করছি। এখন আমার আর কোন স্বাধীনতা নেই। নিরাপত্তাজনিত কারণে চাইলেই যে কোন সময় কোন পারিবারিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারি না। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই আমাকে একপ্রকার এড়িয়ে চলে। বসবাসের জন্য কেউ বাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দিতে চায় না। একমাত্র ছেলে তাঁকে নিয়ে, তার ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। এদেশের একটি শ্রেণীর ভোটারের যে মনোভাব মুক্তিযুদ্ধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ কোন আবেগই তাদের স্পর্শ করতে পারে না। নইলে এখনও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী দেশের অনেক এলাকার বিভিন্ন নির্বাচনে জয়ী হয় কেন? এই অবস্থা চলতে থাকলে একদিন না একদিন স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি এবং তাদের দোসররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে। তখন তো আর পুলিশ প্রহরা থাকবে না। ১৯৭১-এর চেয়েও নৃসংশতম উপায়ে খুন হওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। নতুন সৃষ্টি করব কিভাবে? সারাক্ষণ এক চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আমার দিন কাটে।’ তাঁর এই কথাগুলো শুনে আমি ব্যক্তিগতভাবে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ অনুভব করেছি। নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারিনি। ফোনের এপাশে চোখের জলে ভেসেছি। আপনারাও একটু গভীরভাবে ভাবুন তো! সারাটি জীবন দেশের জন্য কাজ করেছেন যে মানুষটি; সৃষ্টিশীলতার জন্য কাজ করেছেন যে মানুষটি, আজ রাষ্ট্রের জন্য তাঁর স্বাভাবিক জীবন আমরা কেড়ে নিয়েছি। এই কথা হৃদয় দিয়ে অনুভব করলে আপনাদেরও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে বাধ্য। আপনারাও চোখের জলে ভাসতে বাধ্য হবেন। আমাকে বলা এই কথাগুলো তিনি কিছুদিন পরে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও লিখেছেন। একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন। কী মুক্তিযুদ্ধে? কী স্বাধীন বাংলাদেশে সৃষ্টিশীলতায়? আজকে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে তাঁর জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র আমরা উপহার দিতে পারিনি। ’৭৫-এর পর একটি সময় ছিল যখন মুক্তিযোদ্ধাদেরও চরম নিগৃহীত হতে হয়েছে এই দেশে। কিন্তু এখন তো সেই দিন নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে। তবে যে এক নতুন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে অর্থাৎ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিচারের যে যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের যে যোদ্ধাগণ তাদের কারোই নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে আমরা হয়ত আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছি! কিন্তু বিচার পরবর্তী ব্যবস্থা? দুই. ক’দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টার বাসভবনে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুন্যালের তদন্ত সংস্থার প্রধান তদন্ত কর্মকর্তা মো. সানাউল হকের সঙ্গে দেখা। কুশলাদি জিজ্ঞেস করে তার পাশে বসে অপর একজনের সঙ্গে তাঁর আলাপের যে সারমর্ম পেলাম, সেটিও চরম দুঃখজনক। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করার শীর্ষ ক’জন ব্যক্তির মধ্যে অন্যতম একজন। উপরে উল্লিখিত আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো তাঁর জীবনও বিপন্ন প্রায়। স্থূলতার কারণে ডাক্তার নিয়মিত হাঁটতে বলেছেন। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে চাইলেই হাঁটতে যেতে পারেন না। ভোজনরসিক মানুষ হিসেবে বাজারে গিয়ে নিজের পছন্দমতো চিরাচরিত বাজার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হয়েছে। সমাজে স্বাভাবিক চলাফেরা একপ্রকার ভুলে যেতে হয়েছে। তার কথাতেও একই বেদনার সুর। এই দেশের ভোটারদের যে মনোভাব, সরকার কখনও পরিবর্তন হয়ে যদি বিপক্ষ শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে, তখন কী হবে? সত্যিই তাই। তখন আসলে কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর এবং সমাধান মনে হয় এখন খোঁজার সময় এসেছে। বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে এই বিচারের সঙ্গে যুক্ত একজন বিশিষ্ট সাক্ষী এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার একজন শীর্ষ ব্যক্তির মনোভাবটি এই পর্যায়ে। তাহলে অতি সাধারণ মানুষ যারা এই মামলাগুলোর সাক্ষী, তাঁদের কী অবস্থা? বাস্তবতা হলো, ইতোমধ্যে যারা বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী হয়েছেন তারা মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। নিজ নিজ এলাকায় নিরাপত্তাহীন ও আতঙ্কে দিনযাপন করছেন। সারা দেশে এ রকম সাক্ষীর সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক বলে জানা গেছে। আর বর্তমানে তৃণমূলের মামলাগুলোতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে প্রথমে সাক্ষ্য দিতে তালিকাভুক্ত হলেও শেষ পর্যন্ত ভয়ে অনেকে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিতে রাজিই হন না। তাতে প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আইসিটি এ্যাক্টে সাক্ষীদের যে সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, সেখানে শুধু সাক্ষীকে বাড়ি থেকে আনা এবং ট্রাইব্যুনাল থেকে বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত নিরাপত্তা দেয়ার বিধান রয়েছে। সে জন্য আইসিটি অ্যাক্ট-২৫-এর সঙ্গে ‘এ’ ও ‘বি’ নতুন দুটি ধারা যোগ করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এতে ধীরগতি দেখে সংশ্লিষ্ট সবাই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখার অনুরোধ জানান সরকারকে। কেননা, এখন যে মামলাগুলো আসছে তাতে অনেক মামলার সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। সাক্ষীরা নিরাপত্তার অভাবে সাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না। ফলে মামলার কাজে বিঘœ ঘটছে। কোন কোন সাক্ষী গোপনে সাক্ষ্য দিলেও তা মিডিয়ায় প্রচার না করতে তদন্ত কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানান। এ অবস্থায় সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের দাবি সংশ্লিষ্টদের। সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে সাক্ষীদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, সামাজিক মর্যাদা, পেশাগত এবং আর্থিক ও পুনর্বাসন সহায়তা দান করতে হবে। শুধু সাক্ষীই নয়, যারা এই বিচার বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত আছেন, আজীবন তাঁদের প্রত্যেকের সুরক্ষারও কঠোর আইন পাশ করা এবং বাস্তবায়নে কঠিন পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমরা চাইব একজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এদেশে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা পাবেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা চলমান থাকুক। কারণ তাঁর কাছ থেকে আমরা আরও দীর্ঘদিন অনেক কালজয়ী সৃষ্টি পেতে পারি। সেই পরিবেশ আমাদের তৈরি করতে হবে। অন্যদিকে, বর্তমান সময়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানগণ যারা শত বাধা পেরিয়ে এই বিচার বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদেরও যাতে স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন মোঃ সানাউল হকের মতো বাস্তবায়নকারী সংস্থায় যারা কর্মরত আছেন, তাঁরা প্রত্যেকে যাতে নির্বিঘ্নে তাঁদের জীবন যাপন করতে পারেন, সেই পরিবেশ নিশ্চিত করতেই হবে। নইলে এই বিচার বাস্তবায়নের কোন সার্থকতা থাকবে না। লেখক : বিটিভির উপস্থাপক, তথ্যচিত্র নির্মাতা [email protected]
×