ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক ॥ বয়স্ক ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভিসা সহজ করার চুক্তি সই

প্রয়োজনে যে কোন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা করবে ভারত

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৬ জুলাই ২০১৮

প্রয়োজনে যে কোন পরিস্থিতিতে সহযোগিতা করবে ভারত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে ভারত সরকার প্রয়োজনে যেকোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিন দিনের সফরের শেষদিন রবিবার সচিবালয়ে দুই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠকে এই সহযোগিতার কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এছাড়া বয়স্ক ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভিসা সহজ করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ভারত। সকালে সচিবালয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশের ৬৫ বছর ও এর বেশি বয়সী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ বছরের জন্য ভিসা দেবে। এদিকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং রবিবার সকালে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং জাদুঘরের পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। তিন দিনের সফর শেষে রবিবার তিনি দিল্লীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। রবিবার সকাল সাড়ে ১০টায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ভারত ও বাংলাদেশের ষষ্ঠ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এই বৈঠক শুরু হয়। এর আগে সকাল ১০টা ২২ মিনিটে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে উপস্থিত হলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাঙ্গণে অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একটি দলের সালাম গ্রহণ করেন রাজনাথ সিং। বৈঠকে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধি দল ও বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল অংশ নেন। বেলা ১২টায় শেষ হয় বৈঠক। দুপুরে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। বৈঠক শেষে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত আন্তরিক ও আবেগের। রোহিঙ্গা, সীমান্ত সমস্যাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। সমস্যাগুলোর সমাধানে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। প্রায় দেড় ঘণ্টার বৈঠক শেষে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্ত, রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল সাংবাদিকদের বলেন, রাজনাথ সিং বলেছেন যখনই যে সমস্যা আসবে, দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে সেটা সমাধান করে ফেলবে। বাংলাদেশের জন্য তারা সব সময় সজাগ রয়েছে এবং যে কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলে দিয়েছেন, এই আলোচনার মধ্যেও জোরের সঙ্গে বলে দিয়েছি এবং সিদ্ধান্তে অটল রয়েছি যে আমাদের দেশের এক ইঞ্চি জমিও আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশ কিংবা আমাদের প্রতিবেশী দেশের জায়গায় টেররিস্ট এ্যাটাক কিংবা সেপার্টিস্ট মুভমেন্ট পরিচালনা করবে, তা হতে দেব না। আমরা এমনি জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাস করি। সন্ত্রাস-জঙ্গী দমনের জন্য তাদের কাছে যত ধরনের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, তারা আমাদের সঙ্গে ইনফরমেশন এক্সচেঞ্জ করছেন। মিয়ানমার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গার জন্য তারাও আন্তর্জাতিকভাবে সহযোগিতার হাত বাড়াবে এবং তার জন্য কাজ করবে, সেটাও রাজনাথ বলে গিয়েছেন। রোহিঙ্গা নিয়ে এর আগে থেকেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা হচ্ছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, তারপরও আমরা বলেছি রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটা প্রবলেম হয়ে রয়েছে। আমাদের উদাহরণটায় তারা প্রশংসা করেছেন এবং এটা সমাধানের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকবেন। রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য সহযোগিতা করবেন। মাদক, সীমান্ত ও সন্ত্রাস প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ভারত থেকে যে ড্রাগ- ফেনসিডিল আসত সেটা অনেকাংশে কমে গেছে। তারা ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় ফেনসিডিলের কারখানা আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। যেগুলো তারা জানতে পারছেন, সেগুলো তারা বন্ধ করে দিচ্ছেন। তাদের বিএসএফ এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার। তারপরও ফাঁক- ফোকর দিয়ে যা আসে তার ইনফরমেশন দিচ্ছেন। চার হাজার কয়েক শ’ কিলোমিটার বর্ডার লাইনের মাধ্যমে দু’একটি জায়গায় অরক্ষিত এলাকা রয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এসব জায়গা দিয়ে যেকোন সময় কিছু ঢুকতে পারে, এগুলো নিরোধের জন্য তারাও কাজ করছে, আমরাও কাজ করছি। আমরা বলছি, সীমান্তবর্তী এলাকায় বিওপি করতে যাচ্ছি, যাতে আমাদের দুর্গম এলাকায় যেতে পারি এবং নজরদারি করতে পারি। আমরা সীমান্ত রোড করতে যাচ্ছি, সেখানে সহযোগিতার কথা বলেছেন। সীমান্তে সার্ভিলেন্স এবং সেন্সর লাগানোর প্রচেষ্টায় তারা সব ধরনের সহযোগিতা করবেন, যাতে মানবপাচার এবং মাদকপাচার একদম বন্ধ করতে পারি। বৈঠক শেষে আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের ভিসা সহজীকরণের জন্য আজকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যারা নাকি বয়স্ক, যাদের বয়স ৬৫ বছর এবং এর উর্ধে তারা ভিসা চাইলে ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের বয়স্ক সিটিজেনরা যারা ভিসা চান তারা (ভারত) তাদের এই ভিসা দেবেন। তিনি বলেন, সঙ্গে যারা দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একই ধরনের ভিসা সুবিধা তারা প্রদান করবেন, সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করেছেন। যেটার চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা বলেছেন, আমাদের পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, প্রিজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার যদি প্রয়োজন হয়, তারা সহযোগিতা করবেন। এছাড়া সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্যও তারা আমাদের সহযোগিতা করবেন। জাল মুদ্রা নিয়ে তারাও একটা ব্রিবতকর অবস্থা ছিল, আমরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমরা কী কী করেছি তাদেরকে জানিয়েছি। তারা আমাদের পদক্ষেপগুলোতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখন সেই জায়গাটিতে থেকে তারা আশঙ্কমুক্ত হয়েছেন। ভারত মানবপাচার, মাদক পাচার বন্ধে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা আশ্বাস দিয়েছে বলেও জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার দুই আসামি ভারতে পালিয়ে আছে বলে খবর রয়েছে। এ বিষয়টি আলোচনায় এসেছে কিনা- জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এখানে একটি কমিটি আছে। এ বিষয়েও আলাপ হয়েছে। তারা এটা দেখতেছেন। আমাদের কাছে তারাও কয়েকজনের নাম পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে এ্যাগ্রিমেন্ট রয়েছে। এ্যাগ্রিমেন্ট অনুযায়ী কাজ চলছে। আসাদুজ্জামান খান আরও বলেন, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শীঘ্রই আমাকে ভারতে সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। বলেছেন, আগামী দুই মাসের মধ্যে আপনি আসুন। আমরা একটা সময়-সুযোগ করে আবারও যাব। সফর শেষে বেলা ১টায় বিশেষ প্লেনে দিল্লীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন রাজনাথ সিং। এর আগেই তিনি নিজের টুইটারে লিখেছেন, বাংলাদেশে তিনদিন অবস্থানের পর দিল্লী ফিরে যাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষের উষ্ণ আন্তরিকতা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চিরজীবী হোক। বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে রাজনাথ সিং ॥ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং রবিবার সকালে রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি জাদুঘরের সামনে রক্ষিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং জাদুঘরের পরিদর্শক বইয়ে স্বাক্ষর করেন। পরিদর্শক বইয়ে রাজনাথ সিং লিখেছেন, বঙ্গবন্ধু ও তার শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বের মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। শোক বইয়ে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি পরিদর্শন করে তিনি অত্যন্ত আপ্লুত হয়েছেন।
×