ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘আপনে রথের পাছে ঠেলে মাথা দিয়া হড় হড় করি রথ চলিল ধাইয়া।’

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ॥ প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৪ জুলাই ২০১৮

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ॥ প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য

কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী পাদ রচিত চৈতন্য চরিতামৃত মধ্যলীলার চতুর্দশ পরিচ্ছেদ থেকে আমরা জানতে পারি, উরিষ্যার পুরীতে জগতের নাথ জগন্নাথদেবের বিশাল রথযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। রথের দিন হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছে আর রথের দড়ি ধরে টানছে প্রাণপণে, সমস্ত শক্তি দিয়ে, কিন্তু রথ একচুল পরিমাণও নড়াতে পারছেন না। হাজারো মানুষের মাঝে তার প্রিয় ভক্ত নেই তাই জগন্নাথ দেব চলতে নারাজ। তিনি অনড়, অটল। এদিকে হাজার হাজার মানুষের এহেন করুণ অবস্থা অনুধাবন করে করুণাসিন্ধু, দীনবন্ধু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভু আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি এলেন, ভক্তি ভরে স্পর্শ করলেন জগতের নাথ জগন্নাথদেবের রথের দড়ি। ব্যস ভক্তের স্পর্শ পেয়ে হড় হড় করে চলতে শুরু করল রথ। যারা সময়ের অভাবে বা আগ্রহ না থাকার কারণে মন্দিরে গিয়ে জগন্নাথদেবকে দর্শন করতে না পেরে তাঁর কৃপা লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদেরকে বিশেষভাবে কৃপা করে দর্শন দেয়ার জন্য তিনি নিজেই রাজপথে বের হয়ে আসেন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, রথে তু বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে। অর্থাৎ রথে আরোহণরত জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। জন্মমৃত্যু চক্রের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবদ্ধামের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া যায়। তাই এমন সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সকলেরই মানব জীবন ধন্য করা উচিত। অনন্ত কোটি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের যিনি সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা, যার ইচ্ছায় কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড ও ব্রহ্মান্ড জীব সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিপালিত হচ্ছে এবং এক সময় বিলীন হয়ে যাবে, সেই তিনি হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বেদে আছে ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’। ‘গোবিন্দং আদি পুরুষং’। গোবিন্দ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই অনাদির আদি পুরুষ। আর এই শ্রীকৃষ্ণই শ্রীশ্রী জগন্নাথদেব। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতের কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে সূর্য গ্রহণ-এ পুণ্যস্নান করা উপলক্ষে দ্বারকা থেকে শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম ও শ্রীমতি সুভদ্রাদেবী সামন্তপঞ্চক নামক তীর্থে পুণ্যস্নান করতে যান। শ্রীকৃষ্ণ এসেছেন শোনামাত্র শ্রীমতি রাধারাণীসহ বৃন্দাবনবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছুটতে থাকেন তাদের ছোটবেলার খেলার সাথী- প্রাণপ্রিয় নন্দলালকে দুচোখ ভরে দেখার জন্য। তারা সেখানে গিয়ে তাদের সেই চেনা কৃষ্ণকে এই কৃষ্ণের সঙ্গে কিছুতেই মিলাতে পারেন না। তাদের দেখা সেই ছোটবেলার কৃষ্ণ, যার হাতে ছিল বাঁশি, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, গলায় সুগন্ধে আমোদিত বুনো ফুলের মালা, আর তাঁর প্রাণপ্রিয় গোপ সখাদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতেন। আর এ কৃষ্ণের পরনে ঝলমলে রাজ পোশাক, কোমরে তলোয়ার, মাথায় সোনা ও হীরায় কারুকাজ করা মুকুট আর অসংখ্য রাজসৈন্য দ্বারা বেষ্টিত। এই কৃষ্ণকে দেখে তাদের মন ভরেনি বরং বিস্ময়ে নিরাশ হয়ে যান। বিশেষ করে রাধারাণী বললেন, এই কৃষ্ণ আমাদের সেই কৃষ্ণ নয়, যাকে আমরা চিনতাম, বৃন্দাবনে বনে বনে আমাদের সঙ্গে খেলা করত। এহেন অবস্থায় বিষণ্ণ রাধারাণীর মনের অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে ব্রজবাসীগণ কৃষ্ণের রথের দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন বৃন্দাবনের দিকে, সঙ্গে ছিলেন ভাই বলরাম আর ছোট বোন সুভদ্রা দেবী। এটাই হলো রথ যাত্রার ইতিহাস। সেই থেকে হাজার বছর ধরে রথযাত্রা আজও চলে আসছে, বিশেষ করে পুরীতে। আর এ যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে স্কন্দপুরাণ ও উৎকল খন্ডের ৩৩-৩৪ অধ্যায়ের কথায়, শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর পরম ভক্ত মহারাজ ইন্দ্রদুম্ন্যকে স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন ‘আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে সুভদ্রার সহিত আমাকে ও শ্রীবলরামকে রথে আরোহণ করাইয়া নবযাত্রা উৎসব সম্পন্ন করিবে। যে স্থানে আমি আবির্ভুত হইয়া ছিলাম এবং যে স্থানে তোমার সহ¯্র অশ্বমেধ যজ্ঞের মহাবেদী বর্তমান, সেই গু-িচা মন্দিরে আমাকে লইয়া যাইবে।’ শ্রীজগন্নাথ দেবই যে শ্রীকৃষ্ণ তা একটি ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি। একদিন শ্রীকৃষ্ণ রাজসভায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। সেই সময় তিনি খুব ব্যস্ত ছিলেন। তখন মহারাণী রুক্সিনী দেবী শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন, প্রভু রাধারাণী মাতাজি কে? আমরা সকল রাণী আপনার এত সেবা করি তারপরও ঘুমের মধ্যে আপনি রাধা রাধা বলে চিৎকার করেন, আমাদের সেবায় আপনি কি সন্তুষ্ট নন। কৃপা করে বলবেন কি তিনি কে? তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, প্রিয়ে তুমি একথা রোহিণী মায়ের কাছ থেকে অনুগ্রহ করে জেনে নিও। রুক্সিনী দেবী রোহিণী মায়ের কাছে গেলে রোহিণী মা বললেন, এই কথাটি অতি গূঢ় ও সুন্দর। আর সেই ব্রজের এমনই আকর্ষণ যে তা কৃষ্ণের কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই সে এই স্থানে এসে উপস্থিত হবে। যেই মাত্র ব্রজের মহিমা বর্ণনা শুরু করলেন আর অষ্টপাট রাণী ভাবাবিষ্ট হয়ে যান। এই ফাঁকে ঠিকই শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম সুভদ্রা দেবীর দুপাশে দু’জন দাঁড়িয়ে ব্রজলীলার কাহিনী শুনতে লাগলেন। ভক্ত এবং ভক্তির মহিমা, রাসের ও ভক্তিরসের মহিমা শুনে শ্রীকৃষ্ণের মহাপ্রেম জাগ্রত হলো, হস্ত পদ সঙ্কুচিত ও চক্ষু বিস্ফোরিত হলো। এই মহাভাব অবস্থায় শ্রীজগন্নাথ দ-ায়মান। এমন সময় নারদ মুনি সেখানে উপস্থিত হয়ে এই অপরূপ রূপ দর্শন করে বললেন, ‘প্রভু একি অপরূপ রূপ আপনার- আপনার শ্রীচরণ কমলে প্রার্থনা, আপনি এই পতিত পাবন রূপে শ্রীক্ষেত্র নীলাচলে কলিযুগে বিরাজমান হউন।’ তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘তথাস্তু’। অতএব, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলদেব ও শ্রীমতি সুভদ্রা দেবীর মহাভাবের প্রকাশ রূপই হচ্ছে- শ্রীজগন্নাথ, শ্রীবলদেব ও শ্রীমতি সুভদ্রা দেবীর রূপ। যা আজ আমরা পৃথিবীজুড়ে দর্শন করছি। রথে অধিষ্ঠিত জগন্নাথদেবকে দর্শন লাভে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি সর্বপ্রকার যজ্ঞানুষ্ঠান, সর্বতীর্থে স্নান ও সর্ববিধ দানের ফল লাভ করে। ভক্তি ব্যতীত কেবল কৌতুকবশে রথারূঢ় শ্রীজগন্নাথদেবের অনুগমন করলেও অশেষ ফল লাভ হয় বলে স্কন্দ পুরাণে বলা আছে। পদ্ম পুরাণে বলা হয়েছে- রথে তু বামনং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে। অর্থাৎ রথে আরোহণ রত জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, ইসকন স্বামীবাগ, ঢাকা
×