ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্ত্রীর মর্যাদা দাবিতে ১৮ বছর ঘুরছেন রিনা

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১৩ জুলাই ২০১৮

স্ত্রীর মর্যাদা দাবিতে ১৮ বছর ঘুরছেন রিনা

নিজস্ব সংবাদদাতা, কুমিল্লা, ১২ জুলাই ॥ মুরাদনগর উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের লিল মিয়ার মেয়ে দরিদ্র রিনা আক্তারের সঙ্গে ১৮ বছর আগে ওই গ্রামের প্রভাবশালী শহিদুল ইসলাম হুরণ মিয়ার পুত্র মামুন মিয়া জোরপূর্বক দৈহিক মেলামেশা হয়। পরে ইসলামী বিধানমতে কাবিনবিহীন বিয়ের নামে প্রতারণার জেরে রিনার গর্ভে মনির হোসেন নামে পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। বর্তমানে ওই সন্তানের বয়স ১৭ বছর। এদিকে স্বামীর অধিকার ও সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের দাবিতে ১৮ বছর ধরে সমাজপতি ও বিভিন্ন মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রিনা আক্তার। একই দাবিতে কুমিল্লার আদালতে মামলা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগসহ মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট নিজের ও সন্তানের নিরাপত্তার আবেদনের পর প্রভাবশালীদের রোষানলের শিকার হয়েছেন রিনা ও তার সন্তান। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুমিল্লা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে দুঃসহ স্মৃতি ও প্রতারণার দীর্ঘ কাহিনী তুলে ধরে মা ও ছেলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অভিযোগে বলা হয়, রিনা যখন কিশোরী তখন তিনি পার্শ্ববর্তী বাড়ির প্রভাবশালী মামুন মিয়া কর্তৃক জোরপূর্বক ধর্ষণের শিকার হন। ১৩ বছর বয়সে রিনা গর্ভবর্তী হয়ে পড়লে বিষয়টি এলাকায় জানাজানি হয়। এতে স্থানীয় মসজিদের ইমামের মাধ্যমে মামুন মিয়ার বন্ধু জাকির ভূঁইয়াসহ াক্ষীদের উপস্থিতিতে ৩ লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে সম্পন্ন হলেও কাবিন হয়নি। বিয়ের সময় রিনার গর্ভের সন্তানের বয়স ছিল ৭ মাস। বিয়ের পর একপর্যায়ে মামুন বিদেশে চলে যায় এবং রিনা পুত্রসন্তান জন্ম দেয়। বিদেশে যাওয়ার পর মামুন তার স্ত্রী ও সন্তানের খোঁজখবর নেয়নি। ২০০৭ সালে মামুন দেশে এসে দ্বিতীয় বিয়ে করে এবং রিনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ না করে এবং সন্তান তার নয় বলে দাবি করে নানা অপবাদ দেয়। রিনা জানান, যতবারই স্ত্রীর মর্যাদা ও সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের দাবি নিয়ে স্বামীর (মামুন) বাড়ি গেছি ততবারই নির্যাতনের শিকার হয়েছি এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরেও বিচার পাইনি। একই দাবিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নিকট আইনী সহায়তা চেয়ে আবেদন করলে ৩০ মের মধ্যে বিষয়টি তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ওই কমিশন থেকে গত ২২ এপ্রিল মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট পত্র প্রেরণ করা হয়। এছাড়া নির্যাতনের অভিযোগে গত ১৪ মে কুমিল্লা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৩নং বিশেষ আদালতে মামুন মিয়া, ফুল মিয়া ওরফে টুক্কু, দুলাল মিয়া, কামাল ভূঁইয়াসহ ৭জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন তিনি। আদালত এক আদেশে মুরাদনগর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ওই অভিযোগ প্রাপ্তির ৭ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেয়। রিনা অভিযোগ করে বলেন, মামলা ও অভিযোগ করার কারণে মামুন ও তার লোকজন আমাকে ও সন্তানকে প্রাণনাশ ও গুম করাসহ এলাকাছাড়া করার হুমকি দিয়ে আসছে। যাত্রাপুর একে উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ুয়া মনির স্কুলে যেতে পারছে না এবং আসামিরা মামলাসহ অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। সন্তান ও নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে গত ২৬ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আবেদন করেন। সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন রিনার সন্তান মনির হোসেন, স্থানীয় পারভেজ ভূঁইয়া, জুয়েল ভূঁইয়া, জসিম উদ্দিন প্রমুখ। এ বিষয়ে মামুন মিয়া জানান, আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক। রিনা আক্তার নামে ওই মহিলার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক কখনও ছিল না এবং তার সঙ্গে আমার কোন বিয়ে হয়নি এবং কাবিনও দেখাতে পারবে না। যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাদী রিনা আক্তার আদালতের আদেশের একটি কপি হাতে হাতে এনে দিয়েছে, কিন্তু আদালতের মাধ্যমে এখনও কপি পাইনি, পেলে আদালতের আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিতু মরিয়ম জানান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পত্র মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রেরণ করেছি। তদন্তে জেনেছি রিনা আক্তার একসময় মামুন মিয়ার বাড়িতে কাজ করত। ওই সময় তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে এক সময় মামুন মিয়া মুচলেকা দিয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। তবে তার গর্ভের সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া পিতৃ পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব নয়। মুরাদনগর থানার ওসি একেএম মনজুর আলম জানান, রিনা আক্তার থানায় তার ও তার সন্তানের জীবনের নিরাপত্তা চাইলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
×