ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রে পরিবেশ দূষণ- ডাহা মিথ্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৩ জুলাই ২০১৮

কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রে পরিবেশ দূষণ- ডাহা মিথ্যা

রশিদ মামুন, চীন থেকে ফিরে ॥ চীনের রাজধানী বেজিংয়ে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের সংবাদ গত কয়েক বছরে বেশ আলোচিত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমগুলো বলেছে, কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের ফলেই চীনে ভয়াবহ এ বিপর্যয় ঘটছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে চীন কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ থেকে সরে আসছে। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। বেজিংয়ের পথে পথে ঘুরে পরিবেশ দূষণের কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে বেজিং বা চীনের পরিবেশ দূষণ আর কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে কেন পশ্চিমা বিশ^ এত সরব। এশীয় হিসেবে চীনের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি তাকে থামিয়ে দেয়ার জন্যই কী এই প্রচার! চীনের মতোই এশীয় দেশগুলো যাতে বিদ্যুত জ¦ালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে না পারে সে জন্য কখনও কখনও এই প্রচারের ঢেউ বাংলাদেশেকেও ছুঁয়ে যায়। তবে এসব আশঙ্কা যে পরিবেশবাদীদের বানানো গল্প আর নতুন ব্যবসার ধান্ধা তা বেজিংয়ের নির্মল আকাশ দেখেই বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। উন্নত বিশে^র দিকে অগ্রসরের প্রথম শর্ত জ¦ালানি এবং পর্যাপ্ত বিদ্যুতের সংস্থান। সরকার শিল্পায়নের জন্য সস্তায় বিদ্যুত উৎপাদনে কয়লাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এটি ছাড়া উপায়ও নেই। বাংলাদেশের গ্যাসের অপ্রতুলতা আর বিশ^বাজারে তেল আর তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দর অস্থিতিশীল। অন্যদিকে কয়লার বাজার সেক্ষেত্রে অনেকটা স্থিতিশীল। ফলে টেকসই উন্নয়নে বিকল্প জ¦ালানি কয়লা ছাড়া বিকল্প নেই। সরকার কয়লাকে প্রাধান্য দেয়াতেই বাধছে গোল। একশ্রেণীর পরিবেশবাদী চীনের উদাহরণ টেনে বেজিংয়ের পরিবেশ দূষণের প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন। কিন্ত যারা দেশে বসে পশ্চিমা মিডিয়ার খবর স্রেফ অনুবাদ করে দিন পার করার চেষ্টা করেন তাদের বেজিং ঘুরে আসার পরামর্শ দেয়া যেতেই পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানির আমন্ত্রণে চীন সফরে যান দেশের প্রায় প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকরা। এই সফরে সাংবাদিকদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আমরা কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য চীনের পরিবেশ দূষনের যে খবর পড়ি তা এখানে কোথায়? বেজিংয়ের পরিবেশ দেখে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। তারা কেবল বলেছেন, না, আমরা সকলে অবাক হয়েছি। দেশী সংবাদ মাধ্যমের প্রচারে বলা হতো বেজিংয়ের আকাশ ধোঁয়াচ্ছন্ন। এখানকার মানুষকে সরকার ঘর থেকে বের হতে মানা করে। এমনকি এখানে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত ছুটি দিয়ে দেয়। আর বেশি সমস্যা হলে বাজার থেকে বোতলের বাতাস কিনে এনে সেবন করে জীবন বাঁচান বেজিংবাসী। সত্যি বলতে কি এই খবরের সঙ্গে বেজিংয়ের পরিবেশের বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন যায় না। ১৬ হাজার ৮০১ দশমিক ২৫ বর্গ কিলোমিটারের শহরটির সবখানেই সবুজে ঢাকা। শহরে এত সবুজ থাকতে পারে বেজিং ঘুরে না এলে তা অনুধাবন করা কঠিন বৈকি। রাস্তার মাঝখানে আইল্যান্ড আর পাশের ফুটপাথ ঘেঁষে বাহারি ফুলের গাছ নজর কাড়ে যে কারও। বড় গাছের কা-ের শুরুর দিকটা চমৎকার মার্বেল পাথরে বাঁধানো। কেউ কেউ তো আক্ষেপ করে বলেছেন আমাদের সোনার বাংলায় কবে এত সবুজ হবে। একজন সাংবাদিক বলার চেষ্টা করলেন বেজিংয়ে অনেক গাছ থাকলেও কোন পাখি নেই। কারণ হিসেবে তিনি কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের দূষণের কথাই যখন আরও বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করছিলেন তখন অন্য একজন বলে উঠলেন ওই যে পাখি, ওই তো পাখি। ফলশ্রুতিতে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নিয়ে যে প্রচার তার অনেকটাই যে অপপ্রচার তা বলা যেতেই পারে। গাছ যেমন আছে তেমনি ফুল আর পাখিও আছে বেজিং নগরীজুড়ে। বেজিংয়ে বেড়ে ওঠা আর ঢাকায় পেশাগত কারণে বসবাস করা লি রু বলছিলেন, ঢাকা আর বেজিংয়ের পরিবেশে যে পার্থক্য তা এই শহরে ঢাকার কেউ এলেই টের পাবেন। তার দেশ পরিবেশ দূষণ রোধে কঠোর হয়েছে। অন্তত তাদের নদীগুলো সেই আভাসই দেয়। তার শহরে যত সবুজ বনায়ন হয়েছে পৃথিবীর খুব কম শহরেই তা রয়েছে বলে দাবি লি’র। আদপে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র চীনের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ার। অন্যদিকে সরকারের বেঁধে দেয়া মাত্রার মধ্যেই পরিবেশে কার্বন ছাড়ে তার দেশের কেন্দ্রগুলো। পরিবেশের বিষয়ে চীন এতটাই কঠোর যে গত কয়েক বছরে চীনজুড়ে কোটি কোটি গাছ লাগানো হয়েছে। এখনও এই কার্যক্রম চলছে। অর্থাৎ বাতাসে কার্বন ছাড়ার পাশাপাশি অক্সিজেনের যোগান দিচ্ছে চীন। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি পটুয়াখালীর পায়রাতে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এই কেন্দ্র পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করবে চীনের দাতাং ওভারসিস ইলেক্ট্রিক টেকনোলজি এ্যান্ড ও এ্যান্ড এম কোম্পানি লিমিটেড। কোম্পানিটির একটি বিদ্যুত কেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায় আন্তর্জাতিক সব মান বজায় রেখেই কেন্দ্রটি পরিচালিত হচ্ছে। দাতাংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট দাইং ইয়াং বলেন, আমরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেই পরিবেশকে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড ঠিক রেখেই কাজ করা হয় এখানে। কোন ক্ষেত্রে যাতে ব্যত্যয় না ঘটে সে বিষয়ে সব সময় সরকার নজরদারি করে। আমরা যেমন পরিবেশ দূষন প্রতিরোধে বাতাসে ছাই ছাড়ি না ঠিক একই ভাবে কার্বন ধরে উচ্চদামে বিক্রি করি। একইভাবে এখানকার হিট’ (গরম বাতাস) শিল্প কারখানার কাছে বিক্রি করা হয়। ইয়াং বলছিলেন তারা বাংলাদেশের পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষন করবেন। তিনি পায়রাতেও সব মানদন্ড ঠিক রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানান। যখন বিশ^ব্যাপী প্রচারণা রয়েছে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ থেকে চীন সরে আসছে তখন ইয়াং বলছেন প্রচারটি সঠিক নয়। তারা নিজেরাও নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। সিডিটিও এন্ড এম নামের এই বিদ্যুত কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) ইয়াং চাকী বলছেন, ৩০ বছর আগে থেকে আমরা নিজেদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনা করছি। আমাদের প্রযুক্তির বিশেষ দিক হচ্ছে পরিবেশ দূষন না করা। প্রকল্পের নক্সা প্রণয়ন থেকেই বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয় বলে জানান তিনি। সিডিটিও এন্ড এম বিদ্যুত কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, তাদের কয়লা রাখার স্থানটি স্থায়ীভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে। বাইরে থেকে কয়লা দেখা যায় না। এমনকি কোন ছাইও বাইরে থেকে দেখা যায় না। বিদ্যুত কেন্দ্র যে পানি ব্যবহার করে তাও আবার ঠান্ডা করে নদীতে ফেরত পাঠানো হয়। বাইরে থেকে কোন এ্যাশ দেখা যায় না। কালো ধোঁয়া যেমন নেই, তেমনি কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়েও শব্দ টের পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এম খোরশেদুল আলম বলছিলেন, পায়রাতেও কয়লা রাখা হবে এমন শেডের মধ্যে। বড় আকৃতির পুকুরের মধ্যে উপরে থাকবে ঢাকনা। ফলে বাতাসে কয়লা থেকে কোন ধুলো ছড়াবে না। একইভাবে পায়রাতে এফজিডি (ফ্লু-গ্যাস ডিসালফারাইজার্স) অথবা সালফার অক্সাইডের নিঃসরণ কমানোর জন্য এফজিডি ব্যবহার করা হবে। সালফার অক্সাইডও বায়ুদূষণ করে। কয়লা পোড়ানোর সময় এটি নির্গত হয়। এর ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, যা পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রে হবে না। তিনি বলেন, বিদ্যুত কেন্দ্রটি হবে সবশেষ প্রযুক্তি আল্ট্রাসুপার ক্রিটিকাল। এতে কয়লার ব্যবহার কম হবে। বেশি বিদ্যুত পাওয়া যাবে একই সঙ্গে পরিবেশ দূষন হবে না। প্রসঙ্গত আগামী বছর মাঝামাঝি সময়ে পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রথম ইউনিট এবং বছরের শেষের দিকে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে আসবে। দেশের বৃহৎ কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে পায়রাই প্রথম উৎপাদনে আসবে। বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি বিদ্যুত কেন্দ্রের মালিক। কেন্দ্রটি নির্মাণে রাষ্ট্রীয় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি এবং চীনের সিএমসি মিলে এই যৌথ মূলধনী কোম্পানিটি গঠন করেছে।
×