ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফিরে দেখা ॥ ২০০১ খালেদা-নিজামীর শাসনকাল

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ৭ জুলাই ২০১৮

ফিরে দেখা ॥ ২০০১ খালেদা-নিজামীর শাসনকাল

২০০৮ মহাজোটের বিস্ময়কর বিজয়ে ওবামার মতোই ইতিহাস গড়লেন শেখ হাসিনা। দিনবদলের সনদ নিয়ে নির্বাচনের পর বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ঘুরে দাঁড়াল। ওয়াশিংটন প্রবাসী বাংলাদেশী নতুন প্রজন্মের ভাষায় বাংলাদেশের মানুষও অর্থনৈতিক মুক্তি চায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। দেশ পরিচালনার জন্য ‘জামায়াত সমর্থিত’ চারদলীয় জোট যে মহাপরিকল্পনা করে অঙ্ক কষে রেখেছিল। জামায়াত নেতা মুজাহিদীর ভাষায় আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় আসতে দেয়া হবে না। নতুন প্রজন্ম নির্বাচনে তার যোগফল পাল্টিয়ে দিল। তৎকালীন জামায়াত জোট সরকার তা মানতে রাজি নন। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তারা পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখল করেছে। বিএনপির নেতারা ঘোষণা করল তারা পুনরায় ক্ষমতায় গেলে কুশীলবদের (সামরিক বাহিনীর লোকদের) বিচার করবে জনতার আদালতে। অতএব সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারাও সাবধান। (যুগান্তর ১২ জানুয়ারি ২০১০)। আসলে ১/১১ আগে ২০০৭ সালে কি ঘটেছিল? কেন ১/১১ প্রয়োজন ছিল? বাংলাদেশের জনগণ তথা সারা বিশ্ব ভাল করেই জানে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও প্রিন্ট মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজ ও ছবিই তা প্রমাণ করে। চারদলীয় জোট ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হাওয়া ভবনের মাধ্যমে কি সব ষড়যন্ত্র করেছিল তাও মানুষ জানে। ২০০৮ মহাজোটের নির্বাচনে বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনা তৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা দিলেন ‘কোন বিজয় উল্লাস করা যাবে না।’ এমন বিজয়ের পরও মহাজোটের নেতা-কর্মীরা জননেত্রীর নির্দেশ মেনে নেয়। বিদেশেও তার এই নির্দেশ প্রশংসিত হয়। বর্তমান বিরোধী দল ঢাক্ ঢোল পিটিয়ে যতই অপ্রচার করুক না কেন বিরোধী দলের ওপর সরকারী দল নিপীড়ন-জুলুম অত্যাচার করছে। বর্তমানে মিডিয়া এতই তৎপর ও শক্তিশালী তারা নিরপেক্ষভাবে সত্যকে প্রকাশ করে চলছে। ২০০৮ নির্বাচনের পর প্রবাসী বাংলাদেশীরা ভেবেছিল দেশনেত্রী বলে পরিচিত খালেদা জিয়া হয়তো সকাল ৭টায় নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে জাতির উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজিত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইনের মতই ভাষণ দেবেন। ফুলের শুভেচ্ছা শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাবেন। খালেদা জিয়াও নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। ফল হলো তার উল্টো। খালেদা জিয়া নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে সাংবাদিক সম্মেলন করে নির্বাচন কমিশনারকে দোষারোপ করলেন। প্রবাসে বাসরত বাঙালীরা তার এই সংবাদ সম্মেলনে নিরাশ হলেন। সাধারণ মানুষের ম্যান্ডেটকে বিএনপি অসম্মানিত করল। খালেদা জিয়া সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নজরুল ইসলামের পরিবারকে দেখতে গিয়ে বললেন- হত্যা সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে দিন বদলের যাত্রা শুরু হলো আওয়ামী লীগের। দেশব্যাপী বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপর তা-ব চালানো হচ্ছে একের পর এক জমি দখল, লুটতরাজ সন্ত্রাস করে মানুষকে জিম্মি করে ফেলেছে। (ভিডিও ফুটেজ ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ৭ জানুয়ারি ২০০০) অপরদিকে যুগান্তরের সংবাদে জানা যায়, ব্যবসায়ী সমিতির বিরোধের কারণেই খুন হয়েছে নজরুল (যুগান্তর ৭ জানুয়ারি ২০০০)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিডিয়ার সাংবাদিকরা উক্ত ঘটনার বিষয় জিজ্ঞেস করলে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিএনপি এই হত্যাকা-কে পুঁজি করে ফায়দা লুটতে চাইছে। আমরা কি ভুলে গেছি ২০০১ সালের কথা! সে নির্বাচনের পর পর চারদলীয় জোটের নেতাকর্মীরা কি রকম তা-ব চালিয়েছিল আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর। অনেকের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। সংখ্যালঘুদের ঘরছাড়া করেছে, ধর্ষণ হত্যা ছিল তাদের সন্ত্রাসী কর্মীদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কই তখন তো খালেদা জিয়া এক বারও নেতা-কর্মীদের বিরত থাকার জন্য মুখে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। অনেকে স্ত্রী পুত্রকে বাড়িতে রেখে প্রাণনাশের ভয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছে। আসলেই ২০০১ সালের নির্বাচনের পর কি ঘটেছিল? যদি খালেদা-নিজামীর শাসন আমলের দিকে ফিরে তাকাই তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের থেকে দেখা যায়। চার দল সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বঙ্গবন্ধুর ছবি সংরক্ষণ আইন বাতিল করার জন্য প্রস্তাব আনার প্রস্তুতি নেয় (আমাদের কাগজ) ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে না পারলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হারাধনকে ঘরছাড়া করে। কয়েকজন যুবক তার পালিত কন্যাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেও চাঁদা দাবি করে। সংবাদকর্মীরা সরেজমিনে গিয়ে জানতে পারে এরা সবাই চারদলীয় জোটের কর্মী। খবর নিয়ে তারা আরও জানতে পারে এমন হারাধনের সংখ্যা অনেক (১৩ ডিসেম্বর ২০০১ দৈনিক জনকণ্ঠ)। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় সবার পরিচিত মানবাধিকার কর্মী বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে ২২ নবেম্বর ২০০১ বাংলাদেশ দ-বিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করে সাবেক জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। তার অপরাধ জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের ক্যাডারদের নির্যাতনের কাহিনী ফাঁস করে দিয়েছিলেন। শাহরিয়ার কবিরকে ফাঁসানোর জন্য জামায়াত-জোট সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করে ১৬ দিন পর। সিআইডিকে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু সিআইডির কর্মকর্তা জনকণ্ঠের সাংবাদিককে বলেনÑ এই বিভাগটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই বদকর্মের দায়িত্ব কুড়ানোর কাজে ব্যবহার হচ্ছে। তার পরও এর শেষ কোথায়? দেশের আর এক বরণ্য ব্যক্তি খ্যাতিনামা কলামিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনকে রাতের আঁধারে জামায়াত-জোট সরকারের নির্দেশে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলার হোতা দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়। শাহরিয়ার কবির ও মুনতাসীর মামুনকে চোখবেঁধে তালেবানী কায়দায় নির্যাতন করা হয়। তাদের রিমান্ডে নিয়ে বিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শাহরিয়ার কবিরের জামিনের বিষয় আলাপ করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে লন্ডনভিত্তিক এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারী জেনারেল আইরিন খান লন্ডন থেকে এসে দেখা করেন। সাক্ষাতের পর আইরিন খান সাংবাদিকদের বলেনÑ “ও ঃড়ষফ যবৎ (চগ) ডব পড়হংরফবৎ ংযধযধৎরধৎ ধং ঢ়ৎরংড়হবৎ ড়ভ পড়হংপরবহপব ধহফ ফবসধহফবফ যরং জবষবধংব. ঞযব চৎরসব গরহরংঃবৎ ঃড়ষফ সব ঃযধঃ রঃ রং ধ পড়সঢ়ষরপধঃবফ পধংব ধহফ যরং জবষবধংব জরমযঃ ঘড়ি রং হড়ঃ ঢ়ড়ংংরনষব (১২/২৭/২০০১টঘই) মর্মকথা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মহাসচিব আইরিন খানের কাছে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, শাহরিয়ার কবিরের কেইস জটিল, এখনই তাকে মুক্তি দেয়া সম্ভব নয়। (সংসদ ইউএনবির)। ২০০১ সালে ১৯ ডিসেম্বর নিউ ন্যাশেনের সংবাদÑ“চার দিনে রাজধানীতে ১৫ জন সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিহত। ২২ ডিসেম্বর ২০০১ এর সংবাদ আড়াই হাজারে বিএনপির ঘোষণা দিয়ে তা-বÑউক্ত থানার মাহমুদপুর ইউনিয়নের আশুয়ানন্দি গ্রামে নৌকার পক্ষে কাজ করায় ১৮ বাড়িতে ক্যাডাররা লুটপাট চালায়। তাদের গরু ছাগল, আসবাবপত্র, হাঁস-মুরগী, খড়ের টিন, বাঁশ বেড়া টিউবওয়েলের মাথা পর্যন্ত খুলে সন্ত্রাসীরা লুট করে নিয়ে যায়। হামলায় ২৫ জন আহত হয় (১৮টি পরিবারের নারী ও শিশুরা নদী সাঁতরিয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সরকারী দলের সংসদ সদস্যের ভয়ে পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে। বাগেরহাটের সংবাদ : সংখ্যালঘুর বাড়িতে ডাকাতি। মাছের ডিপোতে লুট। বিএনপির ক্যাডারদের সন্ত্রাস চাঁদা দিতে না পারায় গাজীপুরে আওয়ামী লীগ নেতাকে পিটিয়ে যখম। রাজশাহীতে ঘরে আগুন, চার দলীয় জোটের সন্ত্রাসীদের তা-ব। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ টিভিতেও ইতিহাস বিকৃতির নাটক করে দেখানো হয়। বিজয় দিবসের নাটক ‘একটি বুলেটের ইতিহাস’। বিএনপি-জামায়াত মিলে আজগুবি তথ্য প্রচার করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে প্রচার করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কাছে নিজেই আত্মসমর্পণ করে ধরা দেয়। বঙ্গবন্ধু নাকি একজন আপোসকামী ক্ষমতালিপ্সু, ভীতু প্রকৃতিরও রাজনৈতিক নেতা এসব চিত্রায়িত করা হয়। নাটকটি ১৬ ডিসেম্বর ৮:৩০ মি: ২০০১ সালে বিটিভিতে প্রচারিত হয়। (জনকণ্ঠ সংবাদ) ১৯ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জে চর ডুমুরিয়া গ্রামে বিএনপি সন্ত্রাসিরা আওয়ামী লীগের কর্মীর নেতার লাশ দাফনে ৬০ হাজার টাকা দাবি করে। চাঁদা দিতে না পারায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় মোজাফর হোসেন। চট্টাগ্রামের মীরসরাইয়ে দুস্থদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল লুটের সময় বাধা দেয়ায় বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় ৮ জন আহত হয়। পিটিয়ে আহত করে একজন ব্যবসায়ীকে। ১৮ ডিসেম্বর ২০০১ জনকণ্ঠের সংবাদÑসিআইডির তদন্ত অফিসার মুন্সি আতিকুর রহমান শুক্রবার শাহরিয়ার কবিরকে ৪ দিনের রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে, আজও তদন্ত অফিসার তিন দিনের রিমান্ডের আবেদন জানান। আদালত ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। আদালতে শাহরিয়ার করিব তার ওপর অমানুষিক নির্যাতনের বর্ণনা তুলে ধরলে উপস্থিত আইনজীবীসহ অনেকেই মর্মাহত হন। অশ্রুসজল হয়ে পড়েন। জোট সরকারের কি আশ্চর্য ফরমুলা বোমাবাজি হয় ময়মনসিংহে আর ঢাকায় আসামি করা হয় দেশের বরণ্য ব্যক্তিদের। এ থেকে দেশের প্রগতিশীল সাংবাদিক আবেদ খানও বাদ যায়নি। এ সব কাদের ইঙ্গিতে করা হয়েছে। দেশবাসীর জানা একই মাসে জনকণ্ঠের সংবাদ ছিলÑ চাঁদা না দেয়ায় রাঙ্গুনিয়ায় সোনার দোকান লুট করেছে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। রংপুরে কালী মন্দির ভাঙচুর। মুন্সীগঞ্জে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলায় মারাত্মক আহত হয়েছে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা জামাল হোসেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ভেজিটেবল অয়েল মিলের শ্রমিক কলোনিতে বিএনপির সন্ত্রাসীরা ভাঙচুর ও লুটতরাজ করে আওয়ামী সমর্থিত লোকদের ঘরে। থানায় অভিযোগ করা সত্ত্বেও পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়নি। চট্টগ্রামে দুর্ধর্ষ ডাকাতি-দিনেদুপুরে গামেন্টের ১৬ লাখ টাকা লুট। পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে তারা সবাই ছাত্রদল ক্যাডার (১২ ডিসেম্বর ২০০১ জনকণ্ঠ)। চলবে... লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও আমেরিকা প্রবাসী
×