ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রশীদ হায়দারের মেসি-রোলান্দো নয়, শান্তি গোপাল

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২ জুলাই ২০১৮

রশীদ হায়দারের মেসি-রোলান্দো নয়, শান্তি গোপাল

মান্য পাঠককুলের কাছে মার্জনাপ্রার্থী। কেন, পরে বিস্তারিত। এই লেখা, সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘মজারু’। নিছকই মজা। কাউকে আঘাত নয়। ল্যাং মেরে কুপোকাত করা নয়। আমাদের একমাত্র মামাত ভাই, ডাকনাম মোগল। সার্টিফিকেটে খন্দকার গোলাম মোস্তফা। নানা শোক-দুঃখে মারা গেছেন মাস কয়েক আগে, বয়স হয়েছিল। অসম্ভব রসিক ছিলেন, তাঁর রসিকতায় মশগুল বয়স্ক নারী-পুরুষ, এমনকি ছাওয়ালপলও। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে পাবনায় নামী ফুটবলার। মূলত গোলকিপার। জনমুখে গুঞ্জন প্রবাদ : ‘মোগলের দুই হাতের ফাঁক দিয়ে বাতাসও গলিয়ে যেতে পারে না, বল দূরের কথা।’ জিজ্ঞেস করেছিলুম একদিন। উত্তর, ‘গোলপোস্টে বলই আসে না। এলেও মাথার উপর দিয়ে। কিংবা কুড়ি হাত বাঁয়ে বা ডাইনে।’ হায়ারে খেলতে গিয়েছেন পাবনার নানা ক্লাবে। বললেন, আমি বারো নম্বর খেলোয়াড়, মানে, এক্সট্রা। পেছন থেকে গোলকিপারকে উৎসাহ দিতে দিতেই টাইম ওভার।’ মোগল ভাই বলতেন, ‘ওই প্লেয়ার খ্যালে ভালো, কিন্তু বল পায় না।’ না-পাওয়ার কারণ কী? ‘ছাওয়ালডা লাফায় বেশি, বল যেদিকে, তার উল্টোদিকে দৌড়ায়। বিপক্ষের গোলের কাছে গিয়ে অব সাইড খায়।’ ইংরেজীতে মজার কথা আছে, প্রেম-ভালবাসার পূর্বাভাস নিয়ে, বাটারফ্লাই এ্যাফেক্ট। এই এ্যাফেক্ট ‘মন মজিল হাওয়ার দোষে।’ তো, আত্মীয়কুলে মোগল ভাই যেহেতু খেলোয়াড়, আমরাও মজে গেলুম। বাড়িতেই ফুটবল ক্লাব। লোয়াভাই, রোকন (মাকিদ নামে খ্যাত) ক্লাবের নামকরণ করেন, ‘থাকে-থাকে যায়-যায়।’ নামকরণের কারণও আছেন। ক্লাবের কে সভাপতি, তাই নিয়ে ঝামেলা। মাসে দুই আনা চাঁদা কেউ দেবে কি না সন্দেহ। চাঁদা না দিলে বাদ। চার আনা চাঁদা দিলে ‘প্রেসিডেন্ট’ পদ চায়। বাড়িতে ক্লাব হলেও পাড়ার (দোহারপাড়ার) ছাওয়ালপল নিয়ে ক্লাব। ফুটবল ক্লাব। আরিফপুরের সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয় খেলায় জয়ী। মহেন্দ্রপুরে গিয়ে খেলা শেষ হওয়ার আগেই, দুই গোলে এগিয়ে, হৈ হৈ করে একদল ছাওয়াল, তাগড়া-জোয়ান, আমাদের পিটিয়ে কয়, ‘পদ্মায় ভাসায়ে দেব।’ সন্ধ্যার অন্ধকারে পালিয়ে এলুম। ফুটবল খেলায় সেই যে ইতি, মোগল ভাইয়ের সবক, ‘খ্যালে ভালো, বল পায় না, মারপিটেও পারে না।’ প্রত্যেকে জানেন, সর্দি বড্ড ছোঁয়াচে, কাছাকাছি তথা সান্নিধ্যে থাকলেই এ্যাফেক্ট নিশ্চিত। এই রোগ সংক্রামক। কোন পথ্যিতেই আরোগ্য নয়। ভুগতেই হবে। যথাসময়ে সারবে বটে। ধকল কিছুদিন থাকবে তবে। যেমন আমাদের পরিবারে। সর্দি, না বাটারফ্লাই এ্যাফেক্ট? অনুজ জাহিদের টেলিফোনে শুনেছিলুম, ‘বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশ দুই ভাগে বিভক্ত। ডাইনে-বামে-সামনে-পেছনে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা। পতাকায় সয়লাব। বাড়িতে, বারান্দায়, ছাদে। গোটা দেশ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল হয়ে গেছে। ভুলেছে নিজস্ব দেশ। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার উন্মাদনা জলে-স্থলে-হাওয়ায়। বিশ্বকাপ ফুটবলে আর কোন দেশ খেলোয়াড় নেই যেন। নেই উরুগুয়ে, মেক্সিকো, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়ামের পতাকা। জার্মান-ফ্রান্সের পতাকাও খুঁজে পাওয়া প্রায় দুষ্কর। ক্রোয়েশিয়া? কারোর বাড়ির ছাদে, বারান্দায়? পর্তুগালের পতাকা? -না।’ জাহিদের আরও কথা, ‘রোলান্দোকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় কত কথা, কত গপ্পো, কত কেচ্ছা, কত জল্পনা কিন্তু পর্তুগালের পতাকা দেখতে কী, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের অধিকাংশ সমর্থকই হয়ত চেনে না, দ্যাখেওনি।’ উরুগুয়ে-মেক্সিকো-ক্রোয়েশিয়ায় মেসি-রোলান্দো নেই, তবে প্রত্যেক খেলোয়াড়ই মেসি-রোলান্দো। এই রিপোর্ট বার্লিনের বহুল প্রচারিত দৈনিক বার্লিনার-সাইটুডের। বলছিলুম বাটারফ্লাই এ্যাফেক্টের মহব্বত, ছোঁয়াছুঁয়ি। সংক্রামকতার গরল। বার্লিনে যারা বাংলাদেশী, জার্মানির খায়-দায়-পরে, ইউরো কামায় অধিকাংশই হয় আর্জেন্টিনা নয় ব্রাজিলের সমর্থক। জার্মানির নয় কিংবা ইউরোপ বা অন্য কোন দেশের নয়। হেতু কী, জানতে চাই। চমৎকার ব্যাখ্যা শুনি। দু’জন বলেন, ‘আমাগো ভাইবেরাদার, বন্ধুরা হ¹লে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সাপোর্টার। তার মানে, দেশীয় বাটারফ্লাই এ্যাফেক্টে আচ্ছন্ন। অনুজ জাহিদের কথায় জানলুম (টেলিফোনে), অগ্রজ রশীদও আর্জেন্টিনায় পাগলপারা। পতাকাও কেনেন। ফ্ল্যাটের বারান্দায় শোভিত। আর্জেন্টিনার প্রথম হারে পতাকা আর নেই। বোধ হয় লজ্জিত। পতাকা উধাও। আর্জেন্টিনা আর জেতে না। আমাদের বিলাভেড দোহারপাড়ার ভাষায় ‘আর জিতে না’। কেন মার্জনাপ্রার্থী, বলা আবশ্যক। কলকাতার ‘নট্টকোম্পানি’ যাত্রার পয়লা নট (নায়ক) শান্তিগোপাল। বহুরূপী। যাত্রায় রাম-শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীচৈতন্য-কার্ল মার্ক্স-লেনিন-গান্ধী-বিবেকানন্দ-নেতাজি সুভাষ সব ভূমিকায় অবতীর্ণ। হুবহু মেকআপ। চেহারা। ১৯৭৮ সালে ব্রাজিলের দল নিয়ে পেলে খেলতে গেছেন কলকাতায়। প্রতিপক্ষ মোহনবাগান। ইডেন গার্ডেনের মাঠে দর্শকের ঠাসাঠাসি। পেলেকে দেখেই মহাউচ্ছ্বাস। ‘গুরু, গুরু।’ ব্রাজিল তথা পেলে এক গোলে মোহনবাগানের কাছে পরাজিত (তখনও খেলা শেষ হয়নি), গ্যালারি থেকে সমস্বরে চিৎকার, ‘ও শ্লা পেলে নয়, ও শ্লা শান্তিগোপাল।’ -মেসি, রোলান্দোর খেলা দেখে মোগল ভাইয়ের কথা মনে পড়ল ‘খ্যালে ভালো, বল পায় না।’ নিশ্চয় মেসি, রোলান্দো নয়, মেসি-রোলান্দোর চেহারায় শান্তি গোপাল। মুখোশে। জয়তু শান্তিগোপাল। ‘তোমাকে বধিছে যে মহাসমরে।’ ১ জুলাই ২০১৮ বার্লিন, জার্মানি
×