ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী

মৌলভীবাজারে মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৪ জুন ২০১৮

 মৌলভীবাজারে মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত

নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার ১৩ জুন ॥ গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে মনু ও ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের১৩ স্থান ভেঙ্গেপ্রবল বেগে পানি প্রবেশ করে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করেছে। কুলাউড়া উপজেলায় টিলাগাঁও, শরিফপুর ও হাজীপুর ইউনিয়নের ৫টি ভাঙ্গন ও কমলগঞ্জ উপজেলার কমলগঞ্জ পৌর এলাকা, মুন্সীবাজার ইউনিয়ন, আদমপুর ও মাধবপুর ইউনিয়নের ৮টি ভাঙ্গন দিয়ে প্রবেশ করছে বন্যার পানি। তলিয়ে গেছে এ সব এলাকার বাড়িঘর, রাস্তাঘাটসহ ফসলি জমি। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ। বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় শমশেরনগর-চাতলাপুর ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট সড়ক, মুন্সীবাজার-কমলগঞ্জ-কুরমা সড়ক ও শমশেরনগর-কুলাউড়া সড়কের একাংশ তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এসব সড়কে কোথাও কোথাও দেড় থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে যানবাহন চলাচলে চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। এদিকে মনু নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে মঙ্গলবার রাতে কুলাউড়ার শরীফপুর ইউনিয়নের বাঘজুর ও তেলিবিল গ্রাম এলাকায়, বুধবার সকালে চাতলাপুর সেতুর উত্তরপাশে ও দুপুরে হাজীপুর ইউনিয়নের মিঞারপাড়া এলাকায় নদী ভাঙ্গনের ফলে পানি দ্রুতগতিতে গ্রামে প্রবেশ করে। ফলে ১৫ গ্রামের প্রায় ৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। শরীফপুরের বটতলা থেকে চাঁনপুর পর্যন্ত প্রায় ২ কি.মি. সড়ক ৩ ফুট পরিমাণ পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় এবং কুলাউড়া-শমশেরনগর সড়কে টিলাগাঁও এলাকায় সড়কে পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় কুলাউড়া-শমশেরনগর ও বাংলাদেশ-ভারত সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন, কুলাউড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোঃ গোলাম রাব্বি শরীফপুর ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। সাংসদ আব্দুল মতিন, উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম ও নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী মোঃ গোলাম রাব্বি বলেন, এ ইউনিয়নের পানিবন্দী মানুষের জন্য জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ প্রদানসহ আর্থিক সহায়তার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া পানি কমলে ও জরুরী ভিত্তিতে সড়ক যোগাযোগ চালু রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করা হবে বলেও তারা জানান। কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জনাব আলী বলেন, মঙ্গলবার শব-ই- কদরের রাত সাড়ে ৮টায় আমতলা বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙ্গন শুরু হলে গ্রামবাসী ও বিজিবি সদস্যরা মিলে শতাধিক বস্তা বালু দিয়ে এ স্থান রক্ষা করেন। তবে রাত আড়াইটায় বাঘজুর ও তেলিবিল গ্রাম এলাকার প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে দ্রুতগতিতে ঢলের পানি গ্রামে প্রবেশ করে। এ পানি বসতঘরসহ ফসলি জমি তলিয়ে নেয়। বাঘজুর, তেলিবিল, চাঁনপুর, খাম্বারঘাট, শরীফপুর, বটতলা, সঞ্জরপুর গ্রামের ২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার ও মঙ্গলবার দুই দিন দুই রাত অবিরাম মাঝারি বৃষ্টিপাতে ধলাই নদীর কমলগঞ্জ পৌরসভার করিমপুর, মুন্সীবাজার ইউনিয়নের সুরানন্দপুর, বাদে করিমপুর, রহিমপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর, আদমপুর ইউনিয়নের কেওয়ালীঘাট, ঘোড়ামারা, মাধবপুর ইউনিয়নের কাটাবিল, ইসলামপুর ইউনিয়নের শ্রীপুর নামক স্থানে ধলাই প্রতিরক্ষা বাঁধের পুরাতন ও নতুন ভাঙ্গন দিয়ে ৬টি ইউনিয়নের করিমপুর, ঘোড়ামারা, বাসুদেবপুর, সুরানন্দপুর, বাদে করিমপুর, বনগাঁও, ধলাইরপার, শ্রীপুর, ঘোড়ামারা, হীরামতি, যুদ্ধাপুর, নাগড়া, গোপালনগর, নাজাতকোনা, কেওয়ালীঘাট, কান্দিগাঁও, হোমেরজানসহ ৫০টি গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানিতে ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। এছাড়া ধলাই নদীর মাধবপুর ইউনিয়নের হীরামতি গ্রামের মেরামতকৃত বাঁধ ও কমলগঞ্জ সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ এবং রামপাশা গ্রামে খুবই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। টানা বর্ষণে ধলাই নদীর পানি বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোঃ জুয়েল আহমদ বলেন, করিমপুর এলাকায় নদীর ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবেশ করায় পৌর এলাকার গোপাল নগর, করিমপুর, যুদ্ধাপুর ও নাগড়া গ্রামের তিন শ’ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকায় প্রাথমিকভাবে কিছু ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ চলছে। মুন্সীবাজার ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মোতালিব তরফদার জানান, ধলাই নদীর বাদে করিমপুর ও সুরানন্দপুর এলাকায় সৃষ্ট ভাঙ্গনে প্রায় ৮০টি পরিবার বিধ্বস্ত হয়েছে। ৫ শতাধিক হেক্টর আউশ ফসল পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতির কারণে যথাসময়ে ধলাই নদীর ভাঙ্গন মেরামত না করায় এবার বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। ধলাই নদীর ভাঙ্গা বাঁধ মেরামতের জন্য জরুরী ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদাল হোসেন জানান, নদীর একাধিক স্থানে ভাঙ্গনের ফলে ঘোড়ামারা, খেওয়ানিঘাট, কান্দিগাঁও, বন্দরগাঁও, মধ্যভাগ, হেরেঙ্গাবাজার গ্রামের প্রায় আড়াই হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নদীর পানি এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, করিমপুর এলাকার প্রায় দেড় শ’ ফুট ভাঙ্গন পরিদর্শন করেছি। এছাড়া পুরনো কয়েকটি ভাঙ্গন দিয়ে পানি বেরুচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন এ দিকে সতর্কতার সঙ্গে নজরদারি করছে। আপাতত কয়েকটি এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোঃ তোফায়েল ইসলাম জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তাৎক্ষণিক বিতরণের জন্য কুলাউড়া উপজেলায় ৫০ টন, কমলগঞ্জ উপজেলায় ৪৫, রাজনগরে ১০ টন ও শ্রীমঙ্গলে ৫ টন চাল বরাদ্দের প্রক্রিয়া চলছে। এ ছাড়াও কুলাউড়া ও কমলগঞ্জে নগদ এক লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী শরীফপুরে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ৪ টি স্থানের ভাঙ্গনের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ভারতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। মনু নদীর বাঁধ উপচে পানি এসে বাঁধ ভেঙ্গেছে। নদীতে পানির গতি অত্যধিক। মনু নদীর পানি মনু রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপদ সীমার ১৭৭ সে. মি., শহরের চাঁদনীঘাটে ৪৫ সে. মি. ও কমলগঞ্জের ধলাই নদীর পানি ৫৩ মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে মনু নদীর শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করতে পারে। হবিগঞ্জে খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ওপরে ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, ভারত স্লুইস গেট খুলে দেয়ায় হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর পানি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে বুধবার নদীর পানি বিপদ সীমার অন্তত ২’শ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে খোয়াই প্রতিরক্ষা বাঁধ যে কোন সময় ভেঙ্গে হবিগঞ্জ শহর ও আশপাশ এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। বাপাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ তাওহিদুল ইসলাম জানান, খোয়াইর উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরায় একটানা ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় কর্তৃপক্ষ তাদের স্লুইস গেট খুলে দেয়ার কারণেই মূলত খোয়াই নদীর এমন বর্তমান অবস্থা। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক প্রস্তুতি রেখেছে বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়িতে এখনও জলাবদ্ধ নিম্নাঞ্চল ॥ পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জানান, খাগড়াছড়িতে পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বুধবার ভোর থেকে কিছু কিছু এলাকায় পানি সরে যাওয়ার পর ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাদা ও ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। এখনও খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা ও মহালছড়ির বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে আছে। বন্যায় ফসলি ক্ষেত ও সড়ক ডুবে থাকায় বাজারে শাক সবজির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ত্রাণ ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটের কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা নারী ও শিশুরা দুর্ভোগে রয়েছে। গত সোমবার ি রাতে হঠাৎ করে চেঙ্গী ও মাইনী নদীর পানি বেড়ে গিয়ে ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন অফিস আদালতে ঢুকে পরায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সকাল থেকে বৃষ্টিপাত না থাকলেও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারী জনগণকে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে প্রচার চালাচ্ছে। কয়েক দিনের টানা বর্ষণে গত সোমবার রাত থেকে খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, মহালছড়ি ও রামগড় উপজেলার চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর পানি বেড়ে গিয়ে প্রায় দশ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। তলিয়ে যায় খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম-ঢাকা আঞ্চলিক ও জেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলো। টিয়াখালীর হাজারো পরিবার পানিবন্দী ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার টিয়াখালী ইউনিয়নের অন্তত দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিনদিনের টানা বৃষ্টিতে তারা এমন বন্দীদশায় পড়েছেন। তবে পায়রা বন্দরের সঙ্গে নির্মাণাধীন ফোর লেন সড়কের কারণে পানি অপসারণের তিনটি কালভার্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং চারটি খালের পানি প্রবাহের পথ বন্ধ হওয়ায় পানিবন্দী হওয়ার প্রধান কারণ বলে সচেতন মহলের দাবি। স্থানীয়রা জানান, ফোর লেন সড়ক করায় হেতালবাড়িয়া স্লুইস গেট সংযুক্ত খালের সঙ্গে কালভার্টের পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া চারটি খালের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে বলে ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান শিমু জানান। তিনি আরও জানান, এসব পয়েন্টের পানি অপসারণে ঠিকাদার নামেমাত্র চিকন পাইপ দিয়েছে। যা দিয়ে আগামী ১৫দিনেও আটকে থাকা পানি অপসারণ হবেনা। তিনি আজ-কালের মধ্যে প্রত্যেক স্পটে অন্তত ১০/১২টি মোটা পাইপ দিয়ে পানি অপসারণের দাবি করেছেন। টিয়াখালী ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে নির্মাণাধীন ফোর লেন সড়ক করায় গোটা ইউনিয়টি এখন পানিবন্দী হয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন খালে বাঁধ দেয়াও পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে কোথাও কোমর, কোথাও বুক সমান পানিতে ডুবে আছে অধিকাংশ বাড়িঘর। পুকুর, পথ-ঘাট, টয়লেট সব ডুবে একাকার হয়ে গেছে। জেলা প্রশাসক ড. মোঃ মাছুমুর রহমান জানান, টিয়াখালীর মানুষের ভোগান্তি লাঘবে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
×