ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ট্রাম্পকে পছন্দ আমেরিকার কর্পোরেট শ্রেণীর

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১১ জুন ২০১৮

ট্রাম্পকে পছন্দ আমেরিকার কর্পোরেট শ্রেণীর

আমেরিকার এলিট শ্রেণীর সিংহভাগ মনে করে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। পররাষ্ট্র নীতির বোদ্ধারা শঙ্কিত বোধ করছেন যে, ট্রাম্পের কারণে নিরাপত্তা জোটগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ট্রাম্পের আমলে ঋণ গ্রহণ এত বেড়ে গেছে যে, তা কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়ায় বিজ্ঞানী মহল ট্রাম্পের নিন্দায় মুখর। কোন কোন আইন বিশেষজ্ঞ মনে করেন একটা সাংবিধানিক সঙ্কটের অশনি সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে। এমন এক হ-য-ব-র-ল অবস্থার মধ্যেও একটা লক্ষণীয় ব্যতিক্রম আছে। যারা কোম্পানি চালায় তারা ট্রাম্পের যুগ সম্পর্কে একটা হিসাব নিকাশ করে ফেলেছেন। লাভ-ক্ষতি বিচার করে তারা ট্রাম্পের অধ্যায়টিকে পছন্দ করছেন। তারা মনে করেন কর হ্রাস, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রত্যাহার এবং চীনের কাছ থেকে সম্ভাব্য বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের সুফল বাণিজ্য যুদ্ধের মাশুলকে ছাড়িয়ে যায়। তাই তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক ভিশনকে সমর্থন করেন। কারণ, ট্রাম্পের অর্থনৈতিক দৃষ্টিকল্পে কোম্পানিগুলো রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও অসম বিদেশী প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত এবং পরিণতিতে মুনাফা, বিনিয়োগ ও পরিশেষে মজুরি বেড়ে যায়। এ বছরের প্রথম প্রান্তিকের আর্থিক চিত্র বিচার করলে বলতে হয় ট্রাম্পের ভিশন সত্য হতে চলেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেড়েছে। বিনিয়োগ বেড়েছে ১৯ শতাংশ। তবে বিনিয়োগে আগের যে কোন সময়ের চাইতে জোয়ার এলেও সেটা বৃহৎ টেক কোম্পানিগুলোর দিকেই কেন্দ্রীভূত থেকেছে কল-কারখানা বিশিষ্ট কোম্পানিগুলোর দিকে নয়। ট্রাম্পের অধ্যায়ের লাভ-ক্ষতির পুরো হিসাব নিলে দেখা যাবে যে, আমেরিকা এক পিচ্ছিল পথে হেঁটে চলেছে। ক্ষমতায় আসার পর পরই ট্রাম্প ব্যবসায় টাইকুনদের সঙ্গে বেশ কয়েক দফা বৈঠক বসেন। যা এখনও অব্যাহত। কারণ, গত ডিসেম্বরে কর্পোরেট কর থেকে এই প্রথম। এতে গড় কর্পোরেট কর হার ইউরোপীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল পুরোদমে চলেছে। ব্যাংকিং নিয়মকানুনও শিথিল করা হয়েছে। বেশকিছু সংস্থার শীর্ষ পদে ট্রাম্পের পছন্দের লোকজনকে বসানো হয়েছে যাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ী নেতারা বেশ সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন। কর্পোরেটগুলোর পরিচালকমন্ডলীর বিস্ময়কর অংশ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রশ্নে কঠোর ভূমিকার সমর্থক। যুক্তির খাতিরেও যদি ধরে নেয়া হয় যে চীন আমেরিকার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে বছরে আরও ২০ হাজার কোটি ডলারের মার্কিন পণ্য আমদানি করছে তা হলেই আমেরিকার আয় বছরে আরও ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। অর্থাৎ ট্রাম্পের ব্রবসায় নীতির সুবিধাগুলো পরিষ্কার- কর ও লালফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাস, বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় লাভ এবং ৬ থেকে ৮ শতাংশ আয় বৃদ্ধি। সমস্যা হচ্ছে ট্রাম্পের নীতির ঝুঁকিগুলো মূল্যায়ন করতে কোম্পানিগুলো অনেক সময়ই অক্ষম এবং বাণিজ্যিক পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কেও কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ভ্রান্ত থাকে। ওবামা যুগে কর্পোরেট আমেরিকার বদ্ধমূল ধারণা ছিল তারা একটা অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। অথচ সংখ্যার বিচার ওটা ছিল স্বর্ণযুগ সেখানে গড় মুনাফা ছিল দীর্ঘমেয়াদী মাত্রার চাইতে ৩১ শতাংশ বেশি। এখন কোম্পানির কর্মকর্তাদের ধারণা জন্মেছে যে, তারা নির্মাণ যুগে প্রবেশ করেছে। অথচ বাস্তব অবস্থা দাঁড়িয়েছে দেশের বাণিজ্য ব্যবস্থা নিয়মকানুন, অকপটতা ও বহুপক্ষীয় চুক্তি থেকে স্বেচ্ছাচারিতা, সঙ্কীর্ণতা ও ক্ষণস্থায়িত্বের দিকে সরে যাচ্ছে এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হবে বেশি। দাবি করা হয় যে, ইস্পাত ও এ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রে আরও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা ইস্পাত ও এ্যালুমিনিয়াম খাতে ১৫ হাজারের মতো নতুন চাকরির সৃষ্টি হতে পারে। সাপ্লাই চেন আছে। বাণিজ্য প্রকারান্তরে আরও বেশি নিয়ন্ত্রিত বা পুনর্নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। তার ফলে নতুন নরজদারিমূলক আমলাতন্ত্র গজিয়ে উঠবে। গত ২৩ মে বাণিজ্য বিভাগ গাড়ি আমদানির ওপর তদন্ত চালায়। কংগ্রেসে আনীত একটি বিলে বলা আছে যে, আমেরিকায় সমস্ত বিদেশী বিনিয়োগ পরীক্ষা করে দেখা হবে। উদ্দেশ্য এটা সুনিশ্চিত করা যে এসব বিনিয়োগের কারণে যাতে জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ক্ষেত্রগুলোতে দেশের প্রযুক্তিগত ও শিল্পগত নেতৃত্ব ক্ষুণ্ণ না হয়। বিদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলোর মূলধন বিনিয়োগ আছে ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আমেরিকায় বিদেশী ফার্মগুলোর বিনিয়োগ আছে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০০৮ সাল থেকে আমেরিকার সঙ্গে বিদেশীদের চুক্তি হয়েছে ১৫ হাজার। এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের তদারকিতে যুক্ত খরচের অঙ্ক শেষ পর্যন্ত বিশাল হয়ে যেতে পারে। বাণিজ্যের ওপর নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপের খরচ স্বদেশে নিয়ন্ত্রণ বিলোপের সুফলকে বহুলাংশে ছাপিয়ে যেতে পারে। গুটিকয়েক তালিকাভুক্ত কোম্পানি বিশেষ করে টেক ও জ্বালানি সেক্টর ছাড়া সামগ্রিকভাবে আমেরিকার অর্থনীতির চিত্রটা খুব একটা ভাল নয়। টেক ও জ্বালানি খাত বাদ দিলে গতানুগতিক খাতগুলোতে বিনিয়োগ প্রথম প্রান্তিকে বেড়ে ১২ শতাংশ হলেও কোম্পানিগুলোর বাজেট থেকে বোঝা যায় ২০১৮ সালের গোটা সময়টায় বিনিয়োগ প্রকৃতপক্ষে বাড়বে ৫ শতাংশ। এটা দেশটির জন্য মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। সূত্র : দি ইকনোমিস্ট
×