ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হেরা গুহায় প্রথম ওহী

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৮ জুন ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ হেরা গুহায় প্রথম ওহী

ওহী আল্লাহর প্রত্যাদেশ, যা ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সাল্লামের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে হিদায়াত দান করার জন্য নবী-রসূলগণের নিকট বিভিন্ন যুগে নাজিল হয়েছে। ওহীর মাধ্যমে যেসব পুস্তিকা (সহীফা) বা কিতাব (গ্রন্থ) নাজিল হয়েছে সেগুলোকে বলা হয় আসমানী কিতাব। ওহী সম্পর্কে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়া মা কানা লি বাশারিন আয়ইউকাল্লি-মাহুল্লাহু ইল্লা ওয়াহ্ইয়ান আও মিউওয়ারায়ি হিজাবিন আও ইউরসিলা রসূলান্ ফাইউহিইয়া বিইউনিহী মাইয়াশাউ, ইন্নাহু আলীউন হাকীম- মানুষের এমন সাধ্য নেই যে, আল্লাহ্ তার সঙ্গে কথা বলবেন ওহীর মাধ্যমে ছাড়া অথবা পর্দার অন্তরাল ব্যতিরেকে কিংবা এমন দূত (বার্তাবাহক ফেরেশতা) প্রেরণ ব্যতিরেকে যে দূত তাঁর (আল্লাহর) অনুমতিক্রমে তিনি (আল্লাহ) যা চান তা ব্যক্ত করে, তিনি (আল্লাহ) মহান প্রজ্ঞাময়। (সূরা শূরা : আয়াত ৫১)। ওহীর মাধ্যমে হযরত মূসা (আ) যে কিতাব প্রাপ্ত হন তার নাম তওরাত, হযরত দাউদ (আ) প্রাপ্ত হন যবুর, হযরত ঈসা (আ) ইঞ্জিল এবং সর্বশেষ নবী সাইয়েদুল মুরসালিন সরওয়ারে কায়েনাত নূরে মুজাসসম হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম প্রাপ্ত হন কুরআন। কুরআন মজিদ নাজিলের সূত্রপাত হয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দের মাহে রমাদানের শেষ ভাগের কোন এক বেজোড় রাতে, অধিকাংশের মতে ২৭ রমাদান রাতে। কুরআন মজিদ আল্লাহর কালাম। এই কালাম শাশ্বত এবং চিরন্তন। এ অনাধিকাল থেকে সংরক্ষিত রয়েছে লওহে মাহফুজে। ইরশাদ হয়েছে : বাল হুয়া কুরআনুম মাজীদ, ফী লাওহিম মাহফুজ। (সূরা বুরুজ : আয়াত ২১-২২)। এই কুরআন মজিদকে সর্বশেষ নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট বিশ্বমানবের দিশারী হিসেবে নাজিলের জন্য লওহে মাহ্ফুজ থেকে সিদ্রাতুল মুন্তাহা মকামে ওহীবাহক ফেরেশতা হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সাল্লামের কাছে দেয়া হয়। হযরত জিবরাঈল (আ) সেই রাতেই তা বহন করে মক্কা-মুর্কারমার হিরা গুহায় নির্জন বাসরত (ইতিকাফ) হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহামদ মুজতবা সাল্লাল্লাহ আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট অবতরণ করেন। হেরা গুহা মক্কা-মুকাররর্মা বায়তুল্লাহ্ থেকে প্রায় তিন মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে হিরা পর্বত চূড়ায় অবস্থিত। হিরা পর্বতের নামকরণ জাবালুন নূর হয়ে গেলেও গুহার নাম হিরা গুহাই থেকে যায়। হেরা গুহায় প্রথম ওহী নাজিলের মধ্য দিয়ে পার্থিব জগতে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে নবুওয়ত ও রিসালতের অভিষেকে অভিষিক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিশ্বগত সৃষ্টির সূচনা করেন নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করে। আল্লাহর নূরের তাজাল্লির ফয়েযে অর্থাৎ প্রাচুর্য প্রবাহে যে নূর মুবারক বিকশিত হয় সেই নূর মুবারকই নূরে মুহম্মদী। সেই নূর মুবারক থেকেই আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিশ্বজগতের তাবত কিছু একে একে বিকশিত করেন। নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি জগতের মূল উৎস। আধুনিক বিগব্যাং থিওরি যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে নূরে মুহম্মদীর তাৎপর্য আরও অনুধাবিত হবে। সেই নূর মুবারক মানব সুরতে পৃথিবীতে আবির্ভূত হন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই আল্লাহ্র নিকট থেকে এক নূর এবং একটা স্পষ্ট কিতাব তোমাদের নিকট এসেছে। (সূরা মায়িদা : আয়াত ১৫)। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীতে নবী আগমনের ক্রমধারায় সমস্ত নবীর শেষে আবির্ভূত হন, কিন্তু আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁকে সবার আগে নবুওয়ত ও রিসালত দান করেন। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমি তখনও নবী ছিলাম যখন আদম পানি ও মাটিতে বিলীন ছিল। তিনি আরও বলেন, আমি রসূলগণের ভূমিকা ও নবীদের উপসংহার। (মিশকাত শরীফ)। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, হযরত আদম আলায়হিস্ সাল্লামের সৃষ্টিরও বহু পূর্বে হযরত মুহম্মদ মুস্তাফা আহ্মদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নবী ও রসূল ছিলেন। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু আলমে আরওয়া অর্থাৎ আত্মার জগতে সমস্ত নবী-রসূলের রুহকে সমবেত করে তাঁদের কাছ থেকে মীসাক (চুক্তি বা অঙ্গীকার) গ্রহণ করেন যাতে তাঁরা হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রতি ইমান আনেন এবং তাঁকে রসূল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করেন। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : স্মরণ কর, যখন আল্লাহ্ নবীদের অঙ্গীকার (মীসাক) গ্রহণ করেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যা কিছু প্রদত্ত হয় অতঃপর তোমাদের কাছে যা কিছু থাকে তার সমর্থকরূপে যখন একজন রসূল আসবে তখন অবশ্যই তার প্রতি ইমান আনবে এবং তাঁকে সাহায্য করবে। তিনি (আল্লাহ্) বললেন : তোমরা কি স্বীকার করলে? এবং এ সম্পর্কে আমার অঙ্গীকার কি তোমরা গ্রহণ করলে? তারা বলল : আমরা স্বীকার করলাম। তিনি বললেন, তবে তোমরা সাক্ষী থাক এবং আমিও তোমাদের সঙ্গে সাক্ষী থাকলাম। (সূরা আল-ইমরান : আয়াত ৮১)। এই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, আল্লাহু তা’আলা প্রত্যেক নবী থেকে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, যদি তাঁদের পার্থিব জীবনে হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম আবির্ভূত হন তাহলে তাঁর ওপর ইমান এনে তাঁকে সাহায্য করবে এবং প্রত্যেক নবী তাঁদের নিজ নিজ উম্মতদেরও হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের আগাম খবর দিয়ে যান এবং তাঁর ওপর ইমান আনবার ও তাঁর আনুগত্য করার কথা বলে যান। হযরত আলী করমাল্লাহু ওয়াজহাহু ওই আয়াতে কারিমার ব্যাখ্যা ওই একইভাবে করেছেন। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট হযরত জিবরাঈল ‘আলায়হিস্ সালাম ৬১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭ রমাদান রাতে কুরআন মজিদ নাজিলের সূত্রপাত্র ঘটালেন আল্লাহ্র নির্দেশে এক অনন্য উৎসাহে। যে নবীর নবুওয়তের অভিষেকের মাধ্যমে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু পৃথিবীতে নবী প্রেরণের ধারাবাহিকভাবে সূত্রপাত ঘটান, যার সৌজন্যেই আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিকট কিতাব নাজিলের প্রথম মুহূর্তটা ছিল অত্যন্ত বরকতময়। যে কারণে সেই রাতটা সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : লায়লাতুল কাদ্রি খায়রুম্ মিন্ আলফি শাহ্র- লায়লাতুল কাদর হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। প্রত্যক্ষ ওহী নাজিলের পূর্বে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম এমন কিছু সত্য স্বপ্ন দেখতেন যার তাবিরও তিনি সকালে ঘটতে দেখতেন। এই স্বপ্নযোগে তাঁকে বহু গুপ্ত রহস্য ও নিগূঢ়তত্ত্ব অবহিত করা হয়। তিনি হেরা গুহায় গিয়ে নির্জনবাস গ্রহণ করে মুরাকাবা-মুশাহাদা ও যিক্র আয্কারে নিমগ্ন থাকেন। এক অজানা আকর্ষণ তাঁকে তন্ময় করে তোলে। তিনি লক্ষ্য করেন তরুলতা, গাছপালা এমনকি পাথরও তাঁকে সালাম জানাচ্ছে রসূল্লাল্লাহ সম্বোধন করে। তিনি স্পষ্ট শুনতে পান ওগুলো তাঁকে বলছে : আস্সালামু ‘আলায়কা ইয়া রসূল্লাল্লাহ। হেরা গুহায় গুজরান করতে একদিন রাতে সেই মুবারক ক্ষণটি এসে যায়। তিনি শুনতে পেলেন কে যেন তাঁকে সম্বোধন করে ডাকছেন। তিনি উর্ধদিকে এবং আশপাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন। কিছুই তাঁর দৃষ্টিগোচর হলো না। তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন তাঁর সামনে এক আলোকোজ্জ্বল নূরানী মানব সুরত দ-ায়মান। তাঁর মাথায় নূরের মুকুট এবং পরিধানে সবুজ পোশাক। তিনি একখানি সোনার পাতের ওপর সোনালি হরফে লেখা কিতাব খুলে ধরে বললেন : পড়ুন। তিনি বললেন : আমি পড়তে পারিনে। তখন সেই নূর দেহধারী তাঁকে দুই বাহু দিয়ে আগলে ধরে বুকের সঙ্গে বুক মিলিয়ে এমন চাপ দিলেন যে তাঁর মনে হচ্ছিল যে, তাঁর সারা জিস্ম ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে। এভাবে পড়তে বলা, অপারগতা প্রকাশ করা এবং বুকে চাপ দেয়ার ঘটনা তিনবার ঘটার পর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের মধ্যে এমন এক প্রাচুর্য প্রবাহ প্রবাহিত হলো যে, তিনি এমন এক ফয়েজ লাভ করলেন যে, মুহূর্তের মধ্যে জ্ঞান রাজ্যের সমস্ত দুয়ার তাঁর সম্মুখে উন্মোচিত হয়ে গেল। তিনি কুরআন মজিদ থেকে সূরা আলাকের প্রথম পাঁচখানি আয়াতে কারিমা আত্মস্থ করলেন। সূরা আলাকের পাঁচখানি আয়াতে কারিমাতে ইরশাদ হয়েছে : ইক্রা বিইস্মি রব্বিকালাজ্জি খালাক, খালাকাল ইন্সানা মিনআলাক, ইক্রা ওয়া রব্বুকাল্ আকরামুল্লাযী আল্লামা বিল কালাম আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়া’লামÑ পাঠ কর তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে, পাঠ কর আর তোমার রব্ মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন- শিক্ষা দিয়েছে মানুষকে যা সে জানত না। আয়াতে কারিমা ক’খানা আত্মস্থ করা হয়ে গেলে সেই কিতাব বাহক নূরানী সুরত অদৃশ্য হয়ে আকাশ সীমানায় মিলে গেল। এই কিতাব বাহক নূরের সুরতই ছিলেন হযরত জিবরাঈল ‘আলায়হিস্ সালাম। তিনি ওই রাতেই কুরআন মজিদ প্রথম আসমানে অবস্থিত বায়তুল ইয্যাতে সংরক্ষণ করেন এবং বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কিংবা কোন প্রেক্ষাপটে আল্লাহ্র নির্দেশে তা খ- খ- করে ওহী আকারে প্রেরণ করেন। সূরা আলাকের এই কয়খানি আয়াত দিয়ে কুরআন নাজিল শুরু হয় এবং বিদায় হজের খুতবা শেষে আরাফাত ময়দানে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে ৯ জিলহজ একটি আয়াতের অংশবিশেষ হিসেবে সর্বশেষ যে ওহী নাজিল হয় তা হচ্ছে : আল ইয়াওমা আক্মালতু লাকুম দীনাকুম ওয়া আত্মামতু ‘আলায়কুম নিমাতী ওয়া রাদীতু লাকুমুল ইসলামা দীনাÑ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের দীন ইসলামকে সানন্দ অনুমোদন দান করলাম। (সূরা মায়িদা : আয়াত ৩)। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : যদি আমি এই কুরআন পাহাড়ের ওপর নাজিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে আল্লাহ্র ভয়ে তা (পাহাড়) বিনীত হয়ে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। (সূরা হাশর : আয়াত ২১)। সেই মহান কিতাব প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের নিকট নাজিলের যে সূত্রপাত হলো তা ২৩ বছর ধরে ক্রমান্বয়ে নাজিল হয়। হেরা গুহায় হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সাল্লাম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আলিঙ্গন করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর নির্দেশে যে ফয়েজ সঞ্চারিত করলেন ইল্মে তাসাওউফে একে ইত্তিহাদী ফয়েজ বলা হয়। এই ফয়েজের ফলে তার কল্ব মুবারকে যে প্রাচুর্য প্রবাহ সঞ্চারিত হয়েছিল তা আল্লাহ্র কুদ্রতের সামগ্রিক শক্তিতে ভরপুর। মূলত শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারুফাতের দুর্বার গতিধারার অগ্রসফরের নবদিগন্ত উন্মোচিত হয় সেদিন হেরা গুহায় কুরআন নাজিলের মধ্য দিয়ে। এই কুরআন হচ্ছে মানুষের দিশারী, সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)
×