ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পর্কগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৭:৪২, ১ জুন ২০১৮

সম্পর্কগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে

বিতস্তা ঘোষাল। তাঁর জন্ম ভারতের কলকাতায়, ১৯৭৩ সালে। তিনি একাধারে লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৬। তাঁর কবিতা হিন্দী, ইংরেজি, ওড়িয়া ও মারাঠী ভাষায় অনুদৃত হয়েছে। লেখালেখির জন্যে পেয়েছেন বাংলা একাদেমী সম্মান ২০১২, একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার ২০১৪। সম্প্রতি তার সাক্ষাৎ নিয়েছেন মুহাম্মদ ফরিদ হাসান। কেমন আছেন? বিতস্তা ঘোষাল : লেখালেখি নিয়ে ভালোই আছি। বাংলাদেশে কি এর এসেছেন কখনো? বিতস্তা ঘোষাল : বাংলাদেশে দুবার এসেছি। প্রথম যেটা অনুভূতি সেটা না বললে বোঝাতে পারব না। এয়ারপোর্টে নেমে যখন চারদিকে বাংলা বলা ও লেখা দেখছি, শুনছিÑ তখন মন এক অনাবিল আনন্দে ভরে উঠল। কর্মসূত্রে ও লেখা সম্পাদনার কারণে প্রায়ই ভারতের নানা জায়গায় যেতে হয়। সর্বত্র ইংরেজি আর হিন্দি। অথচ দেশের বাইরে এসে এই যে নিজের ভাষায় কথা বলা, তার মতো সুখ বিরল। এদেশে আরো যে জিনিস দুটো মন ছুঁয়ে যায় বারবার তার একটা অবশ্যই এখানকার মানুষদের ভালবাসা ও আন্তরিকতা। প্রথম যখন এদেশে এসেছিলাম সেটা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি। অমর একুশের গ্রন্থমেলায় চিত্রা প্রকাশনী থেকে আমার প্রথম বই ‘মাই স্টোরি’ প্রকাশিত হওয়ার কারণেই এসেছিলাম। যাঁর সূত্রে আসা তিনি একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি প্রয়াত সায্যাদ কাদির। মনে পড়ে এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি তিনি আর তাঁর এক ছাত্র মুনতাসীর আমাকে নিতে এসেছেন। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক মহিলাকে নিতে অমন এক মানুষ নিজে উপস্থিত, এটা বোধহয় এদেশেই সম্ভব। আপনার লেখালেখির সূচনা সম্পর্কে জানতে চাই। বিতস্তা ঘোষাল : এটা খুব মজার। আমি নিজে কোনোদিন ভাবিনি লিখব। স্কুল বা কলেজেও পড়ার বাইরে কিছু লিখিনি। আমি যেটা লিখতাম সেটা হলো নাচের স্ক্রিপ্ট। তখন ভেবেছিলাম নাচটাই পেশা করব। কিন্তু শেষ অবধি হলো না। অল্প বয়সে বিয়ে, বাচ্চা, সংসার... যা হয় আর কী! পড়াশোনাটা ছাড়িনি অবশ্য। ইতিহাসে এমে করার পর লাইব্রেরি সায়েন্স পাস করে কলেজে পড়াচ্ছিলাম। সেইসময় পড়াতে ভাল লাগছিল না। একটা ডিপ্রেশন তৈরি হচ্ছিল। সেখান থেকেই টুকরো টুকরো লেখার জন্ম হল। তারপর প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রতিভা বসু ও বুদ্ধদেব বসুর নাতনি কঙ্কাবতী দত্তকে একদিন সেগুলো শোনাচ্ছিলাম। তিনি সেগুলো নিয়ে রাখলেন পরে পড়বেন বলে। তারপর একদিন জনপ্রিয় মালিনী পত্রিকার সম্পাদক মায়া সিদ্ধান্ত বসুর ফোন এল। আমাকে উপন্যাস লিখতে বললেন। এরপর প্রতিদিন দৈনিক কাগজে, আজকাল দৈনিক, অরুপ আচার্য সম্পাদিত ‘একান্তর’-এ কিছু লেখা বেরোলো। সবগুলির যোগাযোগই কিন্তু কঙ্কাবতী দি। সূচনাটা এভাবেই হল। প্রথম গল্পের বই বেরোলো ২০০৯ সালে। আর সেই উপন্যাসটা বই হয়ে বেরলো ২০১২ সালে। প্যাপিরাস থেকে। (এখন তো পাঁচটে উপন্যাস, তিনটে গল্প সংকলন, চারটে কবিতার বই, চারটে প্রবন্ধর বই।) তারপর থেকে লিখেই চলেছি। আসলে এখন বুঝি, লেখা ছাড়া আমি কিছুই পারি না। কবিতা লিখছেন অনেকদিন। কবিতা কীভাবে আপনার কাছে ধরা দেয়? বিতস্তা ঘোষাল : কবিতা আসলে অনেকটা বৃষ্টির মতো। কখন কোন সময় আসবে সেটা কেউ জানে না। অন্তত আমি তো জানিই না। পথ চলতে গিয়ে কোনো কিছু দেখলাম, তা ভাল মন্দ যাইহোক না কেন, কিংবা কোনো কিছু নিয়ে খুব যন্ত্রণায় আছি, আবার হয়তো প্রেমে পরলাম, বা প্রিয় কারোর থেকে আঘাত পেলাম... এই প্রেমটা যে শুধু হিউম্যান বিয়িং এর প্রতি তাই নয়, মোট কথা একটা মুহূর্ত যেভাবে ধরা পরছে আমার মনের সাদা খাতায় তাই কোনো একসময় সাদা ক্যানভাসে তুলির টানে হয়তো কবিতা বা কবিতার মতো কিছু হয়ে উঠছে। অনুবাদ করার আগ্রহ কীভাবে জন্মালো। বিতস্তা ঘোষাল : আমার বাবা শ্রী বৈশম্পায়ন ঘোষাল ২৩ বছর বয়সে ভারত দর্শনে বেড়িয়েছিলেন পরিব্রাজক হয়ে। সেই সময় কেরালার এক প্রত্যন্ত গ্রামের মহিলাকে, যাকে দেখে নেহাতই কাঠুরে রমনী মনে হয়েছিল, তাঁর কাছে একটি স্থানীয় ইংরেজি স্কুলের ঠিকানা জানতে চান। তিনি ইশারায় ঠিকানাটা বুঝিয়ে দেন। তারপরে সেই স্কুলে পৌঁছে দেখেন সেই কাঠুরে মহিলা সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি বাবাকে বলেন, শুধু ইংরেজি পড়তে বা লিখতে জানলেই সারা বিশ্বকে জানা যায় না। তারপর তিনি দুই বাংলার অনেক সাহিত্যিকদের লেখার কথা বলে জানতে চান বাবা দক্ষিণের কোন কোন সাহিত্যিকদের লেখা পড়েছেন বা তাঁদের নাম জানেন। বাবা লজ্জায় মাথা নিচু করেছিলেন সেদিন। তারপর যখন ভারত ভ্রমণ শেষ করে বাড়ি ফিরলেন তখন সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্বসাহিত্য ও দেশীয় সাহিত্যকে বাঙালি পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন অনুবাদের মাধ্যমে। এই চিন্তার থেকেই তৈরি হলো সম্পূর্ণ অনুবাদ সাহিত্যের একমাত্র বাংলা পত্রিকা ‘অনুবাদ পত্রিকা’ ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি যার উদ্বোধন করেছিলেন শ্রী অন্নদাশংকর রায়। বাবার পর সেই ‘অনুবাদ পত্রিকা’র দায়িত্ব আমি নিই এবং তাঁর সূত্রেই জড়িয়ে পড়ি অনুবাদ কর্মের সঙ্গে। আপনার কয়েকটি অনুদৃত গ্রন্থ রয়েছে। বব ডিলানের ‘পথিকের দুঃস্বপ্ন’ এ বছর গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন। বিতস্তা ঘোষাল : এই মুহূর্তে আমার অনূদিত গ্রন্থ চারটি। এছাড়া আমার করা বহু দেশী বিদেশী লেখকের লেখার অনুবাদ নানা পত্র পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। নিজে অনুবাদ পত্রিকার সম্পাদক বলে সেখানেও নিয়মিত অনুবাদ করতেই হয়। কমলা দাসের ‘মাই স্টোরি’ উপন্যাসটি অনুবাদ করে এতটাই আবেগপ্রবণ ও খুশি হয়েছিলাম যে বেশ কিছুদিন নিজের লেখা থেকে দূরে ছিলাম, কোনো লেখাই যথার্থ লেখা হচ্ছে না আমার, এই ভেবে। এই উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তারা জানবেন একটি মেয়ের চোখে দেখা উনবিংশ- বিংশ শতকের সমাজ, সংসার, রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন ছিল। বিতর্কিত এই উপন্যাসটি নোবেলের জন্যও মনোনীত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য প্রশাসন সেটিতে মত দেননি। নইলে এই উপমহাদেশ রবীন্দ্রনাথের পর পেতেন আরেক নোবেলজয়ীকে। আর বব ডিলানের গান বা কবিতা যাই বলুন না কেন, করার সময় প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছিল, যথার্থ শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এতবার শব্দ পাল্টেছি যে মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, প্রকাশক আর ছাপবেই না বই। কিন্তু শেষঅবধি প্রকাশক পাঠক ও আমি খুশি কাজটা সম্পূর্ণ করতে পেরে। বর্তমানে কী নিয়ে লিখছেন? বিতস্তা ঘোষাল : উপন্যাস লিখছি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমরা সবাই খুব জোড়ে দৌড়াচ্ছি কিছু পেতে হবে ভেবে। একদম রোবটের মত কাজ করছি। সম্পর্কর দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তারমধ্যে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপÑএ কিছুটা মুক্তি খুঁজছি। এক ধরনের সম্পর্কও দানা বাঁধছে, যাকে চিনি না, দেখিনি কখনো সেও আমাদের অজান্তেই ঢুকে পড়ছে, জেনে যাচ্ছে প্রতিদিনের সব দিনলিপি। সেটা আবার বিপদ যেমন ঢেকে আনে, তেমনি একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকেও অনেকসময় মুক্তি দিচ্ছে। এসব ভ্যাট্যুয়াল জগত আমাকে ভাবায়। কারণ প্রতিটি মানুষ কিন্তু দিনের শেষে পরিবারের কাছে ফিরতে চায়। ভালবাসা চায়। অথচ সময় আমাদের দূরে করে দিচ্ছে। সেইসব নিয়েই লিখছি। আপনার লেখা হিন্দি, ইংরেজি, ওড়িয়াসহ বিভিন্ন ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে। পাঠকের কাছে পৌঁছাতে অনুবাদের গুরুত্ব কতটুকু বলে আপনি মনে করেন? বিতস্তা ঘোষাল : অনুবাদ না হলে সারা বিশ্বে কী লেখা হয়েছে বা হচ্ছে, সেটা যে কোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন-আর্ট, সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান-জানা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে যোগ-সাধনের অন্যতম মাধ্যম অনুবাদ। কাজেই অনুবাদের গুরুত্ব অপরিসীম। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে কিছু বলুন। বিতস্তা ঘোষাল : আমার ধারণা সারা দেশে যত মানুষ সাহিত্য চর্চা করেন, তাঁর বেশিরভাগটাই বাঙলায় হয়। কবিতা এখানকার মানুষের রক্তেই মিশে আছে। হয়তো ঐতিহ্যর পরম্পরা। এটা তো ঠিক একটা সময় অবিভক্ত ভারতে যেসব সাহিত্যিক উঠে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাঙালিরা শ্রেষ্ঠতার নিদর্শন রেখেছেন। সেটাই এখনো চলছে। আপনার প্রিয় লেখক কারা? যাদের রচনা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে? বিতস্তা ঘোষাল : প্রিয় লেখক অনেকেই। বাঙলার সেখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শরত-বিভূতি-মানিক, সুনীল, সমরেশ বসু, মজুমদার, সুনীল, হুমায়ুন আহমেদসহ অনেকেই আছেন। কিন্তু যদি বলেন অনুপ্রাণীত, তবে বলব, রবীন্দ্রনাথ বাদে দু’জনেই ভিন্ন ভাষার। মালায়লাম লেখিকা কমলা দাশ, উর্দু লেখিকা ইসমত চুগতাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই এঁদের মতো লিখতে। আপনি বাংলা একাদেমী সম্মান ২০১৪ সালে পেয়েছেন। পেয়েছেন একান্তর কথাসাহিত্যিক পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি কেমন? বিতস্তা ঘোষাল : এইরে! নিশ্চয়ই ভালো। তবে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, যখন একজন পাঠক বলেন, দিদি আপনার অমুক লেখাটা মন ছুঁয়ে গেল তখন মনে হয় এর থেকে ভাল পুরস্কার হতে পারে না। আদতে পাঠকই তো বাঁচিয়ে রাখে লেখকদের। তাদের মনের মধ্যে থাকাটাই লেখকের সেরা স্বীকৃতি। অবসর সময়ে কী করেন? বিতস্তা ঘোষাল : অবসর জীবন ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে। একদিকে পত্রিকা, প্রকাশনার কাজ, অন্যদিকে নিজের লেখা নিয়ে খুব চাপ। তারমধ্যেই যখন সময় পাই নাচ করি, নাচের শো করি। এটাই আমার বিনোদন বা অবসর।
×