ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

চরাঞ্চলে গ্রীষ্মের রসালো ফল

যেদিকে চোখ যায় কেবল তরমুজ আর তরমুজ, কৃষকের মুখে হাসি

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩০ মে ২০১৮

যেদিকে চোখ যায় কেবল তরমুজ আর তরমুজ, কৃষকের মুখে হাসি

শংকর লাল দাশ ॥ পটুয়াখালীর চরাঞ্চলে এখন তাপফাটা গ্রীষ্মের রসালো শীতল ফল তরমুজের ছড়াছড়ি। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই কেবল তরমুজ আর তরমুজ। ক্ষেত উপচে পড়ছে তরমুজে। মাঠ ঘাট হাটবাজার সর্বত্র তরমুজ। নদ-নদী, খাল-বিলেও নৌকা-ট্রলার ভর্তি তরমুজ। সড়কপথের গাড়িও ঠাসা তরমুজে। প্রতিদিন লাখ লাখ তরমুজ যাচ্ছে বিভিন্ন মোকামে। অনুকূল আবহাওয়া আর চাষীদের পরিশ্রমে যেন সবুজ সোনা ফলেছে ক্ষেতে। বাড়তি ফলনে ইদানীং দাম কিছুটা কমলেও লাভের মুখ দেখছেন চাষীরা। তাইতো চাষীদের চোখমুখে বইছে খুশির ঝিলিক। একদার রুক্ষ ক্ষেত জুড়ে চলছে যেন তরমুজের উৎসব। মাত্র এক-দেড় দশক আগেও পটুয়াখালীর চরাঞ্চলের জমি ছিল অনেকটাই অনুর্বর। বছরে একবারই মাত্র রোপা আমন ফলত। কিন্তু সময়ের চাহিদায় সে চিত্র এখন পাল্টে গেছে। চাষীরা এখন নানান ধরনের শস্য আবাদ করছেন। যার অন্যতম হয়ে উঠেছে গ্রীষ্মের এ রসালো ফল তরমুজ। গত কয়েক বছরে তরমুজের আবাদ ব্যাপক বেড়েছে। জেলা কৃষি দফতরের হিসেবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে পটুয়াখালীতে ১৭ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। এতে তরমুজ উৎপাদন হয়েছিল ৮ লাখ ১৬ হাজার ৯১০ টন। পরের বছরে ১৮ হাজার ৫০ হেক্টরে তরমুজ আবাদ হলেও এক নাগাড়ে কয়েকদিনের বর্ষণে উৎপাদন মার খায়। এরপরও তরমুজ উৎপাদন হয় ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩৫০ টন। চলতি বছরে ১৩ হাজার ৭১৮ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে সাগরপারের গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলাতে সর্বাধিক প্রায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজের আবাদ হয়েছে। ব্যাপক উৎপাদনশীলতা ও স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় গলাচিপা-রাঙ্গাবালীর চরাঞ্চলের তরমুজ এরই মধ্যে মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। অসংখ্য চাষীর কাছে তরমুজ এখন প্রধান অর্থকরি ফসলের জায়গা করে নিয়েছে। চাষীরা তরমুজ নিয়ে পৌষ-মাঘ মাস থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। চৈত্র-বৈশাখ মাস মানেই যেন পটুয়াখালীর উপকূলে চাষীদের কাছে তরমুজ উৎসব। রাঙ্গাবালী উপজেলার কাজিরহাওলা গ্রামের প্রবীণ তরমুজচাষী আবদুল করিম হাওলাদার বলেন, এ অঞ্চলের তরমুজ খেতে সুস্বাদু, আকারে বড় এবং রং লাল টুকটুকে হওয়ায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ক্রেতাদের কাছে খুবই পরিচিতি লাভ করেছে। এ কারণেই এখানকার তরমুজের চাহিদা অনেক বেশি। কদর বেশি থাকায় এখানকার মানুষের প্রধান অর্থকরি ফসল এখন তরমুজ। অনেক চাষী বছরে কেবল তরমুজ আবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখেন। গলাচিপা উপজেলা শহরে ছোটবেলা থেকে বাবার হাত ধরে বীজের ব্যবসা করেন যুবক আল আমিন। নিজের কোন জমি নেই। তারপরও তিনি এখন সফল তরমুজচাষী। এ বছর মাঝের চরে মালিকদের কাছ থেকে ৬৫ একর জমি একসনা লিজ নিয়েছেন। এর মধ্যে ৬০ একরেই তরমুজ চাষ করেছেন। তরমুজ চাষে খরচ করেছেন ৩৫ লাখ টাকা। মাসখানেক ধরে ক্ষেতের তরমুজ বিক্রি করছেন। আরও কয়েকদিন তরমুজ বিক্রি করবেন। কথায় কথায় আল আমিন জানালেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে তরমুজ বিক্রি কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ডাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ৩০ একর জমিতে তরমুজ চাষ করে ২৫-৩০ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন। রাঙ্গাবালী উপজেলার চতলাখালী গ্রামের চরমুজ চাষী আরিফ হাওলাদার জানান, এ বছর ২ একর জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। সব মিলিয়ে খরচ ৭৫ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে লাখ দুয়েক টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন। আরও ৫ লাখ টাকা লাভের আশা করছেন। দক্ষিণ কাজিরহাওলা গ্রামের তরমুজচাষী জসিম আলী ৮ একর জমিতে তরমুজের চাষ করেছেন। তাতে সাড়ে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এ পর্যন্ত ১০ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। আরও ৫-৬ লাখ টাকা বিক্রির আশা করছেন। পটুয়াখালীর চরাঞ্চলে তরমুজচাষীদের এমন সাফল্যগাথা এখন সর্বত্র। কেবল তরমুজ চাষ করে কোটি টাকা আয় করেছেন, এমন চাষীর সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কৃষি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান জানান, কেবল গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলাতে প্রায় পাঁচ শ’ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। এ অঞ্চলের বহু চাষী এখন তরমুজ চাষ করে শুধু স্বাবলম্বী নয়, সাফল্যের শীর্ষে উঠেছেন। কৃষি বিভাগ তরমুজ চাষকে আরও ছড়িয়ে দিতে বিভিন্নভাবে কাজ করছে বলেও জানান তিনি। এদিকে সরেজমিনে বোয়ালিয়া, হরিদেবপুর, আমখোলা, চরকাজল, চরবিশ্বাস, পানপট্টি, পক্ষিয়া, খালগোড়া, কোড়ালিয়া, বাহেরচর, চরইমারশন, গহিনখালী, কাজিরহাওলাসহ কয়েকটি নদীর ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকেই তরমুজের ছড়াছড়ি। কেউ ট্রলি থেকে তরমুজ নামিয়ে ঘাটে স্তূপ করছে। কেউ ঘাট থেকে লঞ্চ কিংবা ট্রলার বোঝাই করে তরমুজ উঠাচ্ছে। বাজারজাত করতে নৌযান ভর্তি করে প্রতিদিন আগুনমুখা, বুড়াগৌরাঙ্গ, দারচিরা এবং রামনাবাদ নদী হয়ে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মোকামে যাচ্ছে। সড়ক পথেও প্রতিদিন লাখ লাখ তরমুজ বিভিন্ন মোকামে যাচ্ছে। কয়েকটি তরমুজ ক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এলাকায় উপচে পড়া তরমুজ। প্রতিটি ক্ষেতে যেন তরমুজ উৎসব। চাষী পরিবারের নারী-পুরুষদের পাশাপাশি শিশুরাও মেতে উঠেছে তরমুজের এ উৎসবে। অতিথি আপ্যায়নে দেয়া হচ্ছে-আস্ত তরমুজ। ১৫-২০ কেজি ওজনের তরমুজ নিয়ে অতিথিদের আনন্দ চাষীদের মন ছুঁয়ে যাচ্ছে।
×